ছোট্ট ছেলে, বয়স মোটে বিশ। দেখতে লাগে আরও ছোট। সেই আনসু ফাতির গল্প করা যাক। নামটি বেশ বড়—আনসুমানে আনসু ফাতি ভিয়েরা। স্পেন জাতীয় ফুটবল দলের এই ফরোয়ার্ডকে বলা হচ্ছে ভবিষ্যতের বড় তারকা।
বার্সেলোনায় খেলছেন তিন বছর হলো। নিজের প্রতিভার ঝলক পুরোপুরি দেখাতে পেরেছেন, বলা যাবে না। চোট তাঁকে বারবার পেছনে টেনে ধরেছে। বার্সা কোচ জাভি হার্নান্দেজ সব সময় সংশয়ে থাকেন, কখন চোটে পড়েন ছেলেটি! এ জন্যই কি না, বেশির ভাগ ম্যাচে পুরো সময় খেলার সুযোগ পান না। এ নিয়ে আবার ছেলেটির মন খারাপ হয়। সতীর্থদের কাছে সে কথা বলে নিজেকে হালকা করেন।
তবে প্রতিভাকে এগিয়ে নেওয়ার দূরদর্শিতা আছে স্প্যানিশ কোচ লুইস এনরিকের। থিয়াগো আলকানতারা, সের্হিও রামোস বিশ্বকাপ দলে জায়গা না পেলেও সাইকেল চালাতে চালাতে দল ঘোষণায় ফাতিকে রেখেছিলেন তিনি।
কাতার বিশ্বকাপে স্পেনের প্রথম ম্যাচ আজ কোস্টারিকার বিপক্ষে। প্রথম একাদশেই ফাতি থাকবেন, এমনটা আশা করা যায়। আম্মানে বিশ্বকাপের আগে শেষ প্রস্তুতি ম্যাচে জর্ডানের বিপক্ষে গোল পেয়েছেন ফাতি। সেটা ছিল দুই বছর পর জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁর প্রথম গোল।
আনসু ফাতি বল নিয়ে মাঠে দৌড়ান, গোল করেন, গোল করান। উদ্যাপন করেন নিজস্ব ধরনে। কিন্তু এই ছেলে, যাঁর জন্ম স্পেনে নয় আর দলের অন্য সবার চেয়ে যিনি আলাদা, তাঁর জন্য এত বড় মঞ্চে খেলাটাই তো একটা বিস্ময়! বলা যেতে পারে, বিরূপ পরিস্থিতিই আজ ছেলেটিকে এই অবস্থানে এনেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ছেলেটি হয়তো থাকতেন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনি বিসাউয়ে। সেখানেই হয়তো পাড়ার ক্লাবে ফুটবল খেলতেন, কিংবা বাবার পেশা গাড়িচালকের চাকরি বেছে নিতেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।
সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা বোঝা যে কত কঠিন, তা আনসু ফাতির জীবনের ছোট্ট পাণ্ডুলিপি পাঠ করলেই বোঝা যায়।
একবিংশ শতাব্দীর শুরু। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনি বিসাউতে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। রাজধানী শহর বিসাউতে পরিবার নিয়ে ছোট্ট একটা কুঠুরিতে থাকেন বরি ফাতি। স্থানীয় ক্লাবে ফুটবল খেলতেন, কিন্তু তাতে পেট চলে না। চাকরি করেন গাড়িচালকের। দেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান, যা দেশটিকে চরম দারিদ্র্যের দিকে নিয়ে যায়। আনসু ফাতি তখন দুধের শিশু।
সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন বরি-লারডেস দম্পতি। একদিন পরিবার দেশে রেখে বরি পাড়ি জমান ভাগ্যের অন্বেষণে, পর্তুগালে। সেখানে গিয়ে তৃতীয় সারির কোনো দলে ফুটবল খেলে অনেকটা পেটেভাতে জীবনধারণের চেষ্টা করেন। তবু সফল হননি। এর মধ্যে একদিন শোনেন, প্রতিবেশী দেশ স্পেনের মারিনালেডা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ অভিবাসীদের কাজ দিচ্ছে। দেরি না করে দ্রুত সেখানে চলে যান বরি। কিন্তু ভাগ্য তাঁর সহায় ছিল না। এ সময় একটু খাবারের জন্য রাস্তায় রাস্তায় মানুষের কাছে হাত পাততে হয়েছে তাঁকে।
‘চিরদিন কাহারও দিন সমান নাহি যায়’—আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের এ বাণীর মতোই ভাগ্যদেবতার সন্ধান পেয়ে যান ফাতির বাবা বরি। মারিনালেডার মেয়রের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে এবং মেয়র তাঁকে নিজের গাড়িচালক পদে নিয়োগ দেন। মারিনালেডা পৌরসভাটি স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল আন্দালুসিয়ার সবচেয়ে বড় শহর সেভিয়ার অন্তর্গত।
বরির কঠোর পরিশ্রম, সততা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হন মারিনালেডার মেয়র। মেয়রের প্রচেষ্টায় বরি দেশে থাকা স্ত্রী-সন্তানদের স্পেনে নিয়ে যেতে পারেন। তখন ২০০৮ সাল চলছে। ফাতির বয়স ৬। এ সময় বরি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন, সন্তানদের মধ্য দিয়ে নিজের অপূর্ণ আশা পূরণ করবেন। অর্থাৎ সন্তানদের তারকা ফুটবলার বানাবেন।
২০০৯ সালটি ছিল স্প্যানিশ ফুটবলের জন্য সোনার হরফে লেখা বছর। সে বছর রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাব মহাতারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে সই করায়। আর ফাতি ছিলেন রিয়ালের কঠিন ভক্ত। ক্লাবটির সবকিছুই তিনি অনুসরণ করতেন। ফাতির বড় ভাই ব্রেইমা তখন নামডাক হয়ে গেছে। নাম লিখিয়েছেন সেভিয়া এফসি ক্লাবে। দিন যায়, মাস যায়। স্থানীয় ক্লাব হেরেরা হয়ে একদিন সেভিয়াতে নাম লেখান ফাতিও। বরি ও তাঁর সন্তানদের ফুটবল পারদর্শিতা তখন আন্দালুসিয়া ছাড়িয়ে মাদ্রিদ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদ—দুই দলের কর্তারাই ফাতিকে নেওয়ার আগ্রহ দেখান। রিয়ালের কর্মকর্তারা তাঁদের বাসায় পর্যন্ত গিয়ে বোঝান যে বার্সা থেকে তাঁরা বেশি সুযোগ–সুবিধা দেবেন। এদিকে এ খবরে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ে সেভিয়া। একপর্যায়ে তারা ব্রাইমারকে রেখে ফাতিকে ছেড়ে দিতে সম্মত হয়। এভাবে ৯ বছর বয়সে বার্সার যুব একাডেমি লা মাসিয়াতে যোগ দেন ফাতি। এই ক্লাবই ফুটবল ক্যারিয়ারে তাঁর ভিত্তি গড়ে দেয়। মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, ফ্যাব্রিগাস—সবাইকে বড় করেছে এই লা মাসিয়া।
নিজেকে একটু একটু করে তৈরি করে একদিন লা মাসিয়া ক্লাবের অধিনায়ক হন ফাতি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে আসে দুঃসংবাদ। এস্পানিওলের এক ডিফেন্ডার তাঁকে বিপজ্জনকভাবে ট্যাকল করে বসেন। ডান পায়ের নিচের অংশে গুরুতর আঘাত পান ফাতি। ১০ মাস মাঠের বাইরে থাকতে হয় তাঁকে। এ সময় বড় ভাই ব্রেইমা ছায়ার মতো পাশে ছিলেন।
ওই চোট ছিল ফাতির জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। সেবার সেরে উঠে আরও দারুণভাবে ফিরে আসেন তিনি।
বার্সেলোনার সঙ্গে তাঁর প্রথম পেশাদার চুক্তি হয় ২০১৯ সালের ২৪ জুলাই, ১৭তম জন্মদিনের আগেই। পরের মাসেই লা লিগা অভিষেক। ৩১ আগস্ট ওসাসুনার বিপক্ষে গোল করে বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হয়ে যান ফাতি। একই সঙ্গে হন লা লিগার ইতিহাসের তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা। এরপর একের পর এক ইতিহাস রচনা করে চলেছেন এই তরুণ। মাঝখানে আবার চোট পেয়ে প্রায় ১১ মাস মাঠের বাইরে ছিলেন। আবার ফেরেন চিরচেনা গণ্ডিতে।
পেশাদার ফুটবলারদের জীবনটা এমনই। ফাতির ক্যারিয়ারে চোট একটু বেশি। এটা ফুটবলের প্রতি তাঁর আবেগের কারণেই। হয়তো এখনো পুরোপুরি পেশাদার হতে পারেননি। বয়সই বা কত! প্রত্যাশা বেশি বলেই কোচ এনরিকে বলছেন, ‘এখনো ফাতির সেরাটা দেখিনি আমরা।’
সেরা পারদর্শিতা দেখাতে বিশ্বকাপের মঞ্চকেই কি বেছে নেবেন ‘অতি সাধারণ’ ফাতি!