‘আমরা যাইনি ম’রে আজো-তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়। ’গত বছরের জুলাইয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতার এ লাইনটির মতো অমর এক দৃশ্যের জন্ম দিয়েছিলেন লিওনেল মেসি। সেদিন মেজর লিগ সকারে (এমএলএস) নিজের অভিষেকে মেসি যখন বদলি হিসেবে মাঠে নামার জন্য বুটের ফিতা বাঁধছিলেন, তখন স্ট্যান্ড থেকে দৃশ্যটি মুঠোফোনের ক্যামেরায় বন্দী করে রাখছিলেন বাস্কেটবল কিংবদন্তি লেব্রন জেমস ও টেনিস কিংবদন্তি সেরেনা উইলিয়ামসসহ যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়াজগতের মহাতারকারা। দৃশ্যের ভেতর তৈরি হওয়া এই দৃশ্য সেদিন স্টেডিয়ামজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল অদ্ভুত এক বিহ্বলতা। ফটোসাংবাদিকদের ধারণ করা সেই বিহ্বলতা পরে অন্তর্জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল ফুটবল–বিশ্বে।
সেদিন জেমস-সেরেনাদের মেসির ছবি তোলার দৃশ্যটি সাধারণ কোনো দৃশ্য ছিল না। সেটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়াজগতের পালাবদলের একটি প্রতীকী ছবি। এর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীড়াজগৎ ক্রমেই হয়ে উঠেছে মেসিময়। টিকিট বিক্রি থেকে পৃষ্ঠপোষকদের আগ্রহ—সব জায়গাতেই পড়েছে মেসির আগমনের প্রভাব।
জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে থাকা ফুটবলও এর পর থেকে টক্কর দিচ্ছে বাস্কেটবল-বেসবলের মতো তুমুল জনপ্রিয় খেলাগুলোর সঙ্গে। একজন ব্যক্তির প্রভাবে একটি দেশের খেলার জগতের এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন খেলাধুলার ইতিহাসেই বিরল ঘটনা।
এই দৃশ্যের মতো করেই এবার আরেকটি দৃশ্য কল্পনা করা যাক, যে দৃশ্যটির দেখা মিলতে পারে ১৫ জুন। সেদিন মেসির আঙিনা ফ্লোরিডার লডারহিলের সেন্ট্রাল ব্রোওয়ার্ড সেন্টার মাঠে কানাডার বিপক্ষে খেলতে নামবে বিরাট কোহলির ভারত। সেই ম্যাচে কোহলি ব্যাট হাতে মাঠে নামার সময় মেসি-জেমস-সেরেনারা কি কোহলির ছবি তুলতে গিয়ে ২২ জুলাইয়ের মতো আরেকটি দৃশ্যের জন্ম দেবেন? কোহলি, অনেকের কাছে যিনি ক্রিকেটের মেসি। রেকর্ড বা পরিসংখ্যানের দিক থেকেও আধুনিক গ্রেটদের ওপরের দিকেই তর্কাতীতভাবে থাকবে কোহলির নাম। ক্রিকেটের সেই মহানতম খেলোয়াড়কে দেখতে ভিড় করতেই পারেন মেসি-সেরেনারা! বিশেষ করে মেসির কথাই বলতে হয়। যেহেতু তাঁর শহরে খেলা, অন্য একটি খেলার কিংবদন্তিকে দেখতে তিনি তো আসতেই পারেন, নাকি?
বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। এতটাই যে কল্পিত এ দৃশ্যটি অনেকের কাছে একটু হাস্যকর বলেও মনে হতে পারে। প্রচারণা বা পৃষ্ঠপোষকদের খুশি করার দায় বা চাপ না থাকলে কোহলিকে দেখার জন্য মেসির মাঠে আসার দৃশ্যও হতে পারে আকাশকুসুম কোনো কল্পনা। হ্যাঁ, বাস্তবতা এমনই। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছিলেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।’ হ্যাঁ, কঠিন হলেও এ সত্যকে মেনে নিতে হবে।
প্রথমত, ক্রিকেট ফুটবলের মতো বৈশ্বিক কোনো খেলা নয়। এমনকি ফুটবলের ২১০ নম্বর র্যাংকিয়ের বিপরীতে ক্রিকেটের র্যাংঙ্কিং থেমে যায় ২০–এ গিয়ে। এই দুই খেলার মধ্যে তুলনাটাই তাই মস্ত বড় এক ফাঁকি।
তা ছাড়া ফুটবলের বিস্তারে ফিফার যে উদ্যোগ, তার বিপরীতে ক্রিকেটের বিস্তার নিয়ে আইসিসি বা সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা নেই বললেই চলে। উল্টো, এই ২০ দেশের মধ্যে বিগ থ্রি বা বিগ ফোর ফর্মুলা বের করে খেলাটাকে আরও বেশি সংকুচিত করে রাখার চেষ্টাই যেন প্রতিনিয়ত করা হচ্ছে। এমনকি র্যাংঙ্কিংয়ে ২০ দলের নাম থাকলেও শেষ পর্যন্ত লড়াইটা হয় সেই ৭-৮ দলের মধ্যেই। যেখানে ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত দলগুলো কেবলই ‘দুধভাত’। এবারের বিশ্বকাপেও অনেকগুলো দল সেই ‘দুধভাত’ প্রকল্পেরই অংশ। যাদের জন্য অংশগ্রহণই শেষ কথা। কারণ যা–ই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে ক্রিকেটের পরিসর খুই সীমিত। তাই বৈশ্বিক জনপ্রিয়তার নিরিখে মেসির বাস্কেটবল দেখতে যাওয়ার সম্ভাবনা যতটা প্রবল, ক্রিকেট দেখতে যাওয়ার সম্ভাবনা ততটাই কম।
এর বাইরে আরও একধরনের বাস্তবতা আছে। সেটি হচ্ছে ফুটবলীয় বাস্তবতা। কোহলিরা ফ্লোরিডা মাতাতে যাবেন, তখন মেসির ফুটবল নিয়ে ব্যস্ততা থাকবে তুঙ্গে। ভারত-কানাডা ম্যাচের দিনই মেসির আর্জেন্টিনার হয়ে কোপা আমেরিকার প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবেন গুয়াতেমালার বিপক্ষে। আর এর বাইরে ২১ জুন শুরু হতে যাওয়া কোপা আমেরিকার ব্যস্ততা তো আছেই। সব মিলিয়ে কোহলির ম্যাচে মেসিকে গ্যালারিতে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
এরপরও কল্পনার স্রোতে ভেসে মেসিকে কেউ ফ্লোরিডার ব্রোওয়ার্ড সেন্ট্রালে দেখার কথা ভাবলেও ভেবে নিতে পারেন। গত নভেম্বরে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল দেখতে ইন্টার মায়ামির মালিক ও ইংলিশ কিংবদন্তি ডেভিড বেকহামের মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে উপস্থিতির উদাহরণও দিতে পারেন। কিন্তু ফুটবলের বাস্তবতা ও ব্যস্ততা বিবেচনায় নিলে দূত হিসেবেও মেসির ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে আসার সম্ভাবনা শূন্যই বলা যায়।
যুক্তরাষ্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে যৌথভাবে আয়োজিত বিশ্বকাপে ফ্লোরিডায় ম্যাচ হবে সব মিলিয়ে তিনটি। যেখানে আগামীকাল প্রথম ম্যাচটি খেলবে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। এরপর ১৫ জুন ভারত মুখোমুখি হবে কানাডার। আর এক দিন পর একই মাঠে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ আয়ারল্যান্ড। ফ্লোরিডার বাইরে নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্য শহরেও খেলা হবে বিশ্বকাপের ম্যাচ। নিজের ব্যস্ততার ফাঁকে কোনো ছুতোয় মেসির সেই ম্যাচ দেখতে হাজির হয়ে যাওয়ার কথা কেউ চাইলে তো ভাবতেই পারেন। তেমনটা হলে সেটা ক্রিকেটের জন্যই বড়সড় এক ঘটনা হয়ে থাকবে।
মেসিকে নিজেদের খেলায় পাওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা না থাকলেও মেসির শহরে খেলা বলে হয়তো বাড়তি উচ্ছ্বাস বোধ করতে পারেন কোহলি-বাবররা। কে জানে, মেসি তাঁদের দেখতে না এলেও, খেলা বা অনুশীলনের ফাঁকে সুযোগ পেলে তাঁরা নিজেরাই চলে যেতে পারেন মেসিকে দেখতে। কাছাকাছি সময়ে এবং কাছাকাছি মাঠে একই সময়ে জাতীয় দলের হয়ে ম্যাচ খেলবেন মেসিরা। ব্যাটে-বলে মিললে মেসির খেলা দেখতে কোহলি-বাবররা যেতেও পারেন।
মেসির সঙ্গে এমন তুলনায় বাবর-কোহলি সমর্থকদের মন খারাপ হতে পারে, কেউ কেউ নিশ্চয় মনঃক্ষুণ্নও হবেন। সত্যি কথা হচ্ছে, আকাশের সব নক্ষত্রের আভা কখনো একই রকম হয় না। রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা লুব্ধক এবং নামহীন অন্য কোনো তারা এক নয়। এমনকি ফুটবলেও সব তারকা একই মাপের নন। একজন মেসি কিংবা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর তুলনা কেবল তাঁরাই।
পাশাপাশি এমন একটি দেশের কথা এখানে বলা হচ্ছে, যেখানে ফুটবলকে জনপ্রিয় করতে রীতিমতো মেসিকে নিয়ে আসতে হয়েছে। এমন দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা তো আরও দূরের বাতিঘর। তবু ক্রিকেটের বিশ্বায়ন ঘটাতেই বিশ্বকাপকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া। মেসির উপস্থিতি ফুটবলে যে বিপ্লব নিয়ে এসেছে, বিদ্যমান বাস্তবতায় ক্রিকেটে হয়তো সেটা এখনই সম্ভব নয়। কিন্তু ক্রিকেট বিশ্বকাপ কিংবা কোহলি-বাবর-সাকিবদের উপস্থিতি খেলাটিকে নিয়ে সাধারণের আগ্রহের পরিধিকে আরেকটু বিস্তৃত তো করতেই পারে। পাশাপাশি এমন একটি উপলক্ষে মেসির উপস্থিতি খেলাটির জনপ্রিয়তাকে একলাফে বাড়িয়ে দিতে পারে অনেকটাই।