ময়মনসিংহ শহর ঘেঁষে ব্রহ্মপুত্র নদী। নদীর পাড়ে বেড়াতে যায় শত শত মানুষ। এক পাশে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন জাদুঘর। শহরের হৃৎপিণ্ডে আছে ১২৬ বছরের পুরোনো ময়মনসিংহ মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। টাউন হল মোড়ে সার্কিট হাউস মাঠসংলগ্ন দোতলা ক্লাব ভবনের দেয়ালে লেখা, ‘মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, স্থাপিত ১৮৯৮, ময়মনসিংহ।’
১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা মোহামেডানেরও ৩৮ বছর আগে জন্ম ময়মনসিংহ মোহামেডানের। এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো মোহামেডান ক্লাব। দেশের বিভিন্ন জেলায় আছে আরও কিছু মোহামেডান। প্রতিটি মোহামেডানই স্বতন্ত্র, কোনোটির সঙ্গে কোনোটির সংশ্লিষ্টতা নেই। উপমহাদেশে সবচেয়ে পুরোনো মোহামেডান অবশ্য বাংলাদেশের কোনো মোহামেডান নয়, ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মোহামেডান। বাংলাদেশে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবের জন্ম ১৯০৩ সালে। ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়ারী ক্লাব। ওয়ারী ও ময়মনসিংহ মোহামেডানের জন্ম একই বছর। এই দুটি ক্লাবই বাংলাদেশের সবচেয়ে আদি ক্রীড়া ক্লাব।
ময়মনসিংহ মোহামেডানের প্রতিষ্ঠাতা কে বা কারা, সেটি জানা যায়নি। সেই ইতিহাসই যে নেই ক্লাবটিতে! তবে স্থানীয়রা বলছেন, ১২৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত মোহামেডান ক্লাবের সঙ্গে মুসলিম জাগরণের সম্পর্ক আছে। ব্রিটিশ ভারতের এই অঞ্চলের মুসলমানরা যখন নানাভাবে নিগৃহীত, মুসলমানদের একজোট করতে তখনই ক্লাবটির জন্ম।
জন্মের পর ফুটবলেই সবচেয়ে উজ্জ্বল ছিল ময়মনসিংহ মোহামেডান। ১৯৫৩ ও ’৫৪ সালে আন্তজেলা ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন ময়মনসিংহের বেশির ভাগ খেলোয়াড় ছিলেন এই ক্লাবের। ক্লাব সূত্রের তথ্য, কলকাতা মোহামেডানে সঙ্গে ১৯৩৮ সালে প্রীতি ম্যাচ ড্র করেছিল ময়মনসিংহ মোহামেডান। ক্লাবটির হয়ে একসময় খেলেছেন মনোয়ার হোসেন নান্নু, শামসুল আলম মঞ্জু, মেজর হাফিজের মতো ফুটবলাররা।
ময়মনসিংহ মোহামেডান স্থানীয় ফুটবল লিগে সর্বশেষ কবে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, ক্লাবের কর্মকর্তারাও তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। আশি ও নব্বইয়ের দশকে নাকি কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। জাতীয় দলের ক্রিকেটার মোসাদ্দেক হোসেন এই ক্লাবে খেলেছেন। সদরুল আনাম, মাহবুবুর রহমান সেলিমের মতো ক্রিকেটাররাও খেলেছেন ক্লাবটিতে। ২০০৮ সালে প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ থেকে অবনমিত হয়ে গিয়েছিল ময়মনসিংহ মোহামেডান। ২০১০ সালে প্রথম বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আবার ফিরে আসে। তবে ফুটবলের মতো ক্রিকেটেও ক্লাবটি সর্বশেষ কবে শীর্ষ স্তরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, বলতে পারেননি কেউ।
মোহামেডান ক্লাব ঘেঁষেই সার্কিট হাউস মাঠে হয় ক্রিকেট। রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে ফুটবল। ক্রিকেট-ফুটবল দুটি লিগই এখন চলছে। ফুটবলে ময়মনসিংহ মোহামেডান ১০ ম্যাচে ১ জয়, ৩ ড্রয়ে পেয়েছে মাত্র ৬ পয়েন্ট। ক্রিকেটে হেরেছে প্রথম চার ম্যাচই। ১৯৬৭ সালে ময়মনসিংহ হকি লিগে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেই ছবি ক্লাবের দেয়ালের গায়ে টানানো আছে। সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন ২০০৯ সালে।
বিবর্ণ বর্তমান প্রসঙ্গে ময়মনসিংহ মোহামেডানের আর্থিক সংকটের কথাই আসে ঘুরেফিরে। ক্লাবের আজীবন সদস্য হতে এককালীন ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। আজীবন সদস্যসংখ্যা ১০০ পেরিয়েছে, তা-ও দু-তিনজন নাকি এখনো পুরো টাকা দেননি। ঢাকায় ২০১৯ সালে ক্যাসিনো অভিযানের আগপর্যন্ত ময়মনসিংহ মোহামেডানের ক্লাব ভবনের দোতলায় হল রুমে কার্ড খেলা বাবদ প্রতিদিন ১ হাজার টাকা করে আসত। ক্যাসিনো-কাণ্ডের পর পুলিশ শহরের সব ক্লাবেই তাস খেলা বন্ধ করে দেয়। ক্লাবের আয়ের উৎস বলতে এখন মূলত একটি দোকান ও তিনটি গাড়ির গ্যারেজ। এই খাত থেকে মাসে ভাড়া আসে ১০-১২ হাজার টাকা।
ময়মনসিংহ মোহামেডানের পরিচালনা কমিটি সর্বশেষ কবে হয়েছে, সেটাও ভুলতে বসেছে সবাই। ৩৫ সদস্যের কমিটির কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ কেউ হয়ে গেছেন নিষ্ক্রিয়। ১৯৯৭ থেকে সর্বশেষ সভাপতি ছিলেন সাবেক সচিব ও সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন। ২০২০ সালে ১৭ অক্টোবর তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর থেকে সভাপতির পদ শূন্য।
২০০৭ থেকে সাধারণ সম্পাদক পদে আছেন ষাটের দশকে ক্লাবটির হয়ে খেলা এ কে এম শফিকুল ইসলাম। স্থানীয় একটি কলেজে একসময় অধ্যাপনা করতেন। ৭৭ বছরে পা দেওয়া শফিকুল ইসলামই ক্লাবটিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন অনেকে। গত শনিবার রাতে তাঁকে পাওয়া গেল ক্লাব ভবনের নিচতলায় তাঁর কক্ষে।
ক্লাব কেমন চলছে, জানতে চাইলে প্রবীণ এই অধ্যাপক বলেন, ‘আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। ভালো দল গড়তে আর্থিক ভিত্তি লাগে, যেটা আমাদের নেই। সদস্যদের চাঁদার ওপর নির্ভর করতে হয়। ক্রিকেটে মোটামুটি দল গড়লেও ফুটবলে ভালো করতে পারছি না। টিকে থাকার মতো ফুটবল, ক্রিকেটে দল গড়তে বছরে আমাদের ১৩-১৪ লাখ টাকা লাগে। সেই টাকা জোগাড়ে আমরা হিমশিম খাই।’
ময়মনসিংহ মোহামেডানের কোষাধ্যক্ষ এ কে এম মাহবুবুল আলম টানা ১৪ বছর ফুটবল খেলেছেন এই ক্লাবে। ২০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন ফুটবল সম্পাদক হিসেবেও। ক্লাব ভবনে বসে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরছিলেন তিনি, ‘আর্থিক সমস্যাই আমাদের মূল সংকট। যে কারণে মনমতো দল গড়তে পারি না। ক্যাম্প করা সম্ভব হয় না।’
তারপরও আরও অনেকের মতো বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো মোহামেডানকে নিয়ে আশাবাদী মাহবুবুল, ‘আবার সুদিন ফিরে আসবে, সেই আশাতেই আছি আমরা।’