ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড রানডাল কোলো মুয়ানি
ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড রানডাল কোলো মুয়ানি

ফাইনালে গোল মিস করা মুয়ানি যেন ‘অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’–এর সেই বৃদ্ধ নাবিক

স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের ‘দ্য রাইম অব দ্য অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’-এর চরিত্র সেই বৃদ্ধ নাবিক সমুদ্রে গুলি করে অ্যালবাট্রস মেরেছিলেন। আর ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড রানডাল কোলো মুয়ানি আর্জেন্টিনার বিপক্ষে কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালের শেষ মুহূর্তে একটি সহজ সুযোগ পেয়েও গোল করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

দুটি ঘটনাকে কি এক বিন্দুতে মেলানো যায়? হয়তো কোনোভাবেই নয়। ‘অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’-এর বৃদ্ধ নাবিককে তাঁর সতীর্থ নাবিকেরা অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং সমুদ্রে থাকা জাহাজের জন্য সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত অ্যালবাট্রস হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। এর শাস্তি হিসেবে মৃত অ্যালবাট্রস তাঁর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিল অন্য নাবিকেরা। কিন্তু মুয়ানি গোল মিস করায় তেমন কিছু করেননি তাঁর সতীর্থেরা। এই মিসকে ফুটবলের অংশ হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন সবাই।

একটি জায়গায় অবশ্য ওই বৃদ্ধ নাবিক আর কোলো মুয়ানি মিলে যাচ্ছেন একই বিন্দুতে। বৃদ্ধ নাবিক অ্যালবাট্রস হত্যাকে ধরে নিয়েছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসেবে। কোলো মুয়ানিও কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালের ওই গোল মিসকে সে রকম কিছুই ভাবছেন। বৃদ্ধ নাবিকের মতো কোলো মুয়ানিও শাপমোচনের কথা বলেন।

‘অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’-এ বৃদ্ধ ওই নাবিক প্রাথমিক মুক্তি পেয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি জীবের প্রতি মায়া দেখিয়ে। যখন ওই নাবিকের জাহাজ মাঝ সমুদ্রে স্থবির হয়েছিল, তাঁর গলায় ঝোলানো ছিল মৃত অ্যালবাট্রস, ঘুমাতে পারছিলেন না তিনি; তখন সেই জাহাজের চারপাশ দিয়ে সামুদ্রিক কিছু সাপ দেখতে পান নাবিক। চন্দ্রালোকে সাপগুলোকে দেখে তিনি মন থেকে ভালোবাসা অনুভব করেন। ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর গলা থেকে খসে পড়ে মৃত অ্যালবাট্রস, সমুদ্রে বাতাস প্রবাহিত হয়, তাঁর জাহাজ নিয়ে যায় পোতাশ্রয়ে। তিনি মুক্ত হন।

কিন্তু গল্পের শেষ এখানেই নয়। পোতাশ্রয় থেকে বেরিয়ে বৃদ্ধ নাবিক চলে যান একটি গীর্জার কাছে। সেখানে বসে তিনি দেখতে থাকেন একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছে কিছু মানুষ। তাদেরই একজনকে থামিয়ে বৃদ্ধ নাবিক তাঁর অ্যালবাট্রসকে গুলি করে হত্যা করার পাপ আর সেই পাপমোচনের গল্প বলেন। প্রাথমিকভাবে ওই নাবিক মুক্ত হলেও তাঁর পাপমোচন কি আসলেই হয়েছিল? নাবিক নিজেই বলেছেন, না! কারণ, অ্যালবাট্রস হত্যার শাস্তি হিসেবে এই গল্প নাবিককে আমৃত্যু শুনিয়ে যেতে হবে জন থেকে জনে!

১২৩ মিনিটে মার্তিনেজের সেই সেভ

কোলো মুয়ানির ক্ষেত্রেও যেন বিষয়টা অনেকটা সে রকম হয়ে যাচ্ছে। কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালের পরই ওই মিস নিয়ে কথা বলতে হয়েছে তাঁকে। ফরাসি ফরোয়ার্ড তখনও বলেন, ওই মুহূর্ত তিনি কখনোই ভুলবেন না। বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর দেশে ফিরেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। এখন আবার বিন স্পোর্টসকে কোলো মুয়ানি বলেছেন, এই তাঁর জীবনের শেষ পর্যন্ত গলার কাঁটা হয়ে থাকবে!

দারুণ রোমাঞ্চকর সেই ফাইনালে লিওনেল মেসি ও আনহেল দি মারিয়ার গোলে ৩৬ মিনিটের মধ্যে ২-০ তে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিলিয়ান এমবাপ্পের ৯০ সেকেন্ডের ঝড়ে ফ্রান্স সমতায় ফেরে। এমবাপ্পের ৮০ ও ৮১ মিনিটের গোলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেখানে মেসির ১০৮ মিনিটের গোলে আবার এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু ১১৮ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে এমবাপ্পে ম্যাচ নিয়ে যান টাইব্রেকারে। সেখানে আর্জেন্টিনার কাছে ৪-২ গোলে হেরেছে ফ্রান্স।

ম্যাচ টাইব্রেকারে গড়ানোর আগেই অবশ্য খেলা শেষ করে দিতে পারতেন কোলো মুয়ানি। অতিরিক্ত সময়ের যোগ করা সময় সুবর্ণ এক সুযোগই পেয়েছিলেন ফরাসি ফরোয়ার্ড। ১২৩ মিনিটে বক্সের মধ্যে তিনি একা পেয়ে গিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজকে। বলটি তিনি মার্তিনেজের বাঁ পাশ দিয়ে জালে জড়ানোর জন্য শট নেন। কিন্তু মার্তিনেজ বাঁ পা বাড়িয়ে সেই শট ঠেকিয়ে দেন!

এই মুহূর্তটা কোলো মুয়ানি কখনোই ভুলতে পারবেন না বলে বিন স্পোর্টসকে বলেছেন, ‘আমি এখনো এটা দেখি। এখনো সবকিছু পরিষ্কার মনে করতে পারি। আমি নিজেকে বলছিলাম, “রানডাল, শট নাও। আমি কাছের পোস্টে শট নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু গোলকিপার খুব ভালো একটি সেভ করেছে। কিন্তু আমার কাছে আরও বিকল্প ছিল।’

‘অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’-এর সেই বৃদ্ধ নাবিকের মতো নিজের ভুলগুলো বিড়বিড় করে বলে যান কোলো মুয়ানি, ‘আমি তার ওপর দিয়ে লব করতে পারতাম। অথবা বাঁ দিকে কিলিয়ান এমবাপ্পেকে দিতে পারতাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি তাকে দেখতে পাইনি। আসলে আপনি পরে যখন এটা দেখবেন, তখনই বিকল্পগুলো খুঁজে পাবেন।’

কোলো মুয়ানি এরপর যোগ করেন, ‘এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখনো আমার কণ্ঠ রূদ্ধ হয়ে আছে এবং এটা সারা জীবনই থাকবে।’ কোলো মুয়ানির কথা শুনে কী মনে হচ্ছে? গল্পটা আজীবন এভাবেই হয়তো বলে যাবেন ফরাসি ফরোয়ার্ড। তাহলে তো স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের অনন্য সৃষ্টি ‘অ্যানসিয়েন্ট মেরিনার’-এর সেই বৃদ্ধ নাবিকের মতো অবস্থাই হয়েছে তাঁর!