অতীত ভুলে গেছে ব্রাজিল
অতীত ভুলে গেছে ব্রাজিল

ব্রাজিলীয় ফুটবল ঐতিহ্যের জন্য শোকগাথা

‘আমরা ব্রাজিলকে ভালোবাসি কারণ তারা ব্রাজিলিয়ান’-অ্যালেক্স বেলোস

১৮৯৪ সালের কোনো এক কল্পিত দুপুর। পাতার ওপর সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পোর্ট অব সান্তোসের আশপাশে। বন্দর এলাকার সাধারণ দুপুরগুলো যেমন হয়, এ–ও তার ব্যতিক্রম নয়। আশপাশে মানুষের ছোটাছুটি আর কর্মব্যস্ততার ভিড়ে চার্লস মিলারকে তাই কারও সেভাবে চোখেই পড়েনি।

তবে এদিনের মিলার একটু অন্য রকম ছিলেন। তাঁর দুই হাতে ছিল দুটি ফুটবল, যা খুব স্বাভাবিকভাবেই চোখ এড়ায়নি ডক সাইটে অপেক্ষায় থাকা তাঁর বাবা জন মিলারের। তিনি চার্লসকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার দুই হাতে এ দুটো কী চার্লস?’ হাস্যোজ্জ্বল চার্লস উত্তরে বললেন, ‘আমার ডিগ্রি।’ বিষয়টা ধরতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন করে মিলার বললেন, ‘কী?’ এবার হাসিটা আরও চওড়া করে বিলেতফেরত চার্লস উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, তোমার ছেলে ফুটবলে স্নাতক পাস করেছে।’

এর আগে ফুটবল ব্রাজিলে ফুটবল খেলা হতো নাকি হতো না, তার পক্ষে বিপক্ষে নানা মত-দ্বিমত আছে। তবে চার্লস যে ব্রাজিলে ফুটবলের পথপ্রদর্শকদের একজন তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। বিলেত থেকে নিয়ে আসা দুটি ফুটবলই পরে তাঁকে জাতীয় নায়কে পরিণত করেছিল। দিয়েছে অমরত্বও। সেন্ট্রাল সাও পাওলোর একটি সড়কের নামও হয়েছে তাঁর নামে। এমনকি ফুটবলসংক্রান্ত কারিকুরিতেও যুক্ত হয়েছে তাঁর নাম। নিজের পায়ের পেছন দিয়ে বল চিপ করাকে যেমন বলা হয় ‘চালেইরা।’

মজার ব্যাপার হচ্ছে চার্লসকে তাঁর আনা বলগুলোকে কাজে লাগাতে কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কারণ, সে সময় ব্রিটিশ কমিউনিটিতে চলছিল ক্রিকেটের মৌসুম। ভাবা যায়, কতটা অনুল্লেখযোগ্যভাবে ব্রাজিলে ফুটবলের বিস্তার শুরু হয়েছিল।

বন্দর শহর থেকে ২০০ মাইল দূরে রিওতেও ফুটবলের যাত্রা শুরু হয়েছিল এমন সাদামাটাভাবে। যেখানে ফুটবলকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অস্কার কক্স নামে একজন অ্যাংলো-ব্রাজিলিয়ান। তিনি ফুটবল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ড থেকে। ১৯০১ সালে তিনি রিও ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক অ্যাসোসিয়েশন, স্থানীয় তরুণদের নিয়ে একটি ম্যাচও আয়োজন করেন। সেটিই ছিল প্রথম ফুটবল ম্যাচ, যাতে বিলেতিদের বাইরের লোকজনও অংশ নিয়েছিল। যদিও এই আয়োজন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। খেলোয়াড়দের পরিবারের সদস্যরা, দুজন বন্ধু ও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে এসে পড়া এগারোজন টেনিস খেলোয়াড় ছিলেন সেই ম্যাচের দর্শক।

এরপরও আমাজান পারের দেশটিতে ফুটবলের বারুদ ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। ফুটবল হাতে চার্লস হাজির হওয়ার মাত্র ৬ বছর পর ১৯০০ সালে উরুগুয়ের সীমান্তের কাছে রিও গ্র্যান্ডের জার্মান কলোনিতে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম ফুটবল ক্লাব। এরপর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেই ফুটবলই হয়ে ওঠে ব্রাজিলিয়ানদের প্রধান আত্মপরিচয়। একই সময়ে লেখা এক চিঠিতে চার্লস মিলার ফুটবলের প্রতি উন্মাদনা নিয়ে লিখেছিলেন, একটি ম্যাচ দেখতে ১ হাজার ৫০০ মানুষ একসঙ্গে উপস্থিত হয়েছিল। এক বছরের মধ্যে বিক্রি হয়েছে প্রায় ২ হাজার বল। এমনকি গ্রামে গ্রামে তখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল ক্লাবও।

ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরোতে পারছে না ব্রাজিল

শুরুতে অবশ্য ব্রাজিলের শীর্ষস্থানীয় ক্লাবগুলোর ফুটবলে শুধু অভিজাতদেরই প্রবেশাধিকার ছিল। উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা স্যুট–বুট পরে খেলা দেখতে আসত। আধুনিক ইউরোপিয়ান ফুটবলের ফিটনেস এবং পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনেই সেই ম্যাচগুলো আয়োজিত হতো। কিন্তু ফুটবলের এই অভিজাত সংস্করণের বিপরীতে নীরবে ঘটে যাচ্ছিল অন্য এক বিপ্লব।

ফুটবল যখন ব্রাজিলিয়ান শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছিল, একই সময়ে দেশটি বৃহত্তর এক সামাজিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। ১৮৮৮ সালেই কেবলই দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে ব্রাজিল থেকে। এর আগে ব্রাজিল ছিল সবচেয়ে বেশি দাস রপ্তানি করা দেশ। কিন্তু দাসপ্রথার বিলুপ্তির পর মুক্ত দাসেরা ব্রাজিলের অলিগলি আর বস্তিগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারা ব্রাজিলে তৈরি করেছিল নতুন এক নিম্নবিত্ত শ্রেণি। যারা ফুটবলকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু একেবারে নিজেদের মতো করে। ব্রাজিলিয়ান সাম্বা নাচ কিংবা জিঙ্গার সঙ্গে ফুটবলকে মিশিয়ে যা তারা সৃষ্টি করেছিল, সেটি ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত ফুটবল থেকে অনেক দূরের ফেনোমেনা। যদিও শীর্ষস্থানীয় ফুটবলে অনেক দিন পর্যন্ত তারা ছিল অচ্ছুত।

তাঁদের নিয়ে ‘ফুটবল দ্য ব্রাজিলিয়ান ওয়ে অব লাইফ’ বইয়ে অ্যালেক্স বেলোস লিখেছিলেন, ‘ফুটবল কেবল তখনই ব্রাজিলিয়ান হয়েছে, যখন কৃষ্ণাঙ্গরাও শীর্ষ ফুটবলে অংশগ্রহণ করেছে। শুরুতে তাদের অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। কিন্তু তাতে সেই মানুষগুলোর আগ্রহে কোনো ভাটা পড়েনি। তারা ফ্লুমিনেন্সের সামনের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারত না। তারা পাশের ভবনের দেয়াল বেয়ে ছাদে উঠত এবং সেখানে বসেই খেলা দেখত। এরপর তারা দেখল এই খেলাটি ক্রিকেটের চেয়ে মজাদার এবং এটি নকল করাও সহজ। এর জন্য দরকার শুধু একটি বল। যদি তুমি তা কিনতেও না পারো, যেকোনোভাবে চাইলে বানিয়ে নিতে পারো।’

আর এভাবেই শুরু হয়ে গেল ব্রাজিলের তথা বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিপ্লবটি। সেই কৃষ্ণাঙ্গ, দরিদ্র ও অসহায় মানুষগুলোর পায়েই ফুটবল ফুটতে শুরু করল ফুল হয়ে। বলটিকে নিয়ে তারা শুধু খেলতই না, নিজেদের সব গ্লানি ও না পাওয়ার যে যন্ত্রণা, সেটাকেও তারা সেই বলে লাথি দিয়ে উড়িয়ে দিতে। ফুটবল তখন আর স্রেফ একটি খেলা থাকল না। মার খেতে থাকা একটি জনগোষ্ঠীর আর্তচিৎকার যেন প্রতিটি কিকের সঙ্গে উড়ে যেত। পাশাপাশি নিজেদের যত নান্দনিক ও সৃষ্টিশীল কারিকুরি ভেতরে জমাট মেঘের মতো থির হয়ে ছিল, তা–ও নানা ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। আর এভাবেই ফুটবল হয়ে উঠল ব্রাজিলের নিজস্ব সম্পদ।

ফাইনালে ব্রাজিল জেতার পর উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু পেলে

এমন অদম্য ও সৃষ্টিশীল মানুষগুলোকেও খুব বেশি দিন আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারল না ক্লাবগুলো। নিজেদের প্রয়োজনেই তাদের কাছে টেনে নিতে হয়। ১৯১০–এর দশকে ফুটবল হয়ে উঠল ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। এমনকি রিওতে নাকি সে সময় দক্ষিণ আমেরিকার যেকোনো দেশের চেয়ে সবচেয়ে বেশি ফুটবল মাঠ ছিল।

এর মধ্যে ১৯১২ সালে হয়ে গেল ব্রাজিলের ইতিহাসের প্রথম মহাকাব্যিক ম্যাচটিও। যাকে উরুগুয়ের বিখ্যাত ক্রীড়া সাহিত্যিক এদোয়ার্দো গ্যালিয়ানো বলেছিলেন, ‘ফ্লা এবং ফ্লুর গল্প’। ফ্লা মানে ফ্লামেঙ্গো এবং ফ্লু মানে ফ্লুমিনেন্স। মূলত ফ্লুমিনেন্স ক্লাব ভেঙেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ফ্লামেঙ্গো। এরপর শুরু হয় দুই ক্লাবের ঐতিহাসিক দ্বৈরথ। এই দুই দলের ম্যাচকে গ্যালিয়ানো বলেছিলেন, ‘অন্তহীন অসমাপ্ত যুদ্ধের একটি চিত্র’। যার শুরু থাকলেও কোনো শেষ নেই। এই দুই দলের দ্বৈরথ যেন রিও ডে জেনেইরোর দখল নেওয়ার যুদ্ধ। এই দ্বৈরথে অবশ্য যতই তিক্ততা থাকুক, এটি ব্রাজিলের ফুটবলে বিকাশেও যে বেশ ভূমিকা রেখেছিল।

সেই কৃষ্ণাঙ্গ, দরিদ্র ও অসহায় মানুষগুলোর পায়েই ফুটবল ফুটতে শুরু করল ফুল হয়ে। বলটিকে নিয়ে তারা শুধু খেলতই না, নিজেদের সব গ্লানি ও না পাওয়ার যে যন্ত্রণা, সেটাকেও তারা সেই বলে লাথি দিয়ে উড়িয়ে দিতে।

১৯১৯ সালে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব জিতে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় ব্রাজিলের ফুটবল। ব্রাজিলের এই অর্জনের নায়ক ছিলেন আর্থুর ফ্রিদেনরিচ। উরুগুয়েকে ১-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জেতার পর সেদিন রিও দে জেনেইরোর রাস্তায় নেমেছিল জনতার ঢল। সেই সব মানুষের উদ্‌যাপন নিয়ে গালিয়ানো লিখেছেন, ‘সেদিন উদ্‌যাপনের সময় যারা সামনে ছিল, তারা আকাশে তুলে ধরেছিল কর্দমাক্ত এক জোড়া ফুটবল বুট। এভাবেই তারা প্রিয় খেলোয়াড়কে ভালোবেসেছিল।’ তাদের কাছে এই জুতাজোড়া ছিল সোনায় মোড়া দুটি পা। পরদিন ফ্রিদেনরিচের জুতাজোড়া দেখা গেল নগরের একটি গয়নার দোকানে সাজিয়ে রাখতে।

ফ্রিদেনরিচ ছিলেন এক জার্মানি অভিবাসীর সন্তান। কোনো অর্থ ছাড়াই ২৬ বছর যিনি প্রথম বিভাগ ফুটবলে খেলে গেছেন। বলা হয়, ফুটবল ইতিহাসে তার চেয়ে বেশি গোল আর কোনো খেলোয়াড় করেনি। পেলেও না। ফ্রিদেনরিচের মোট গোলের সংখ্যা ছিল ১৩২৯টি। তবে গোলের চেয়েও বেশি তিনি ছিলেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলশৈলীর প্রথম ও প্রধান প্রাণভোমরা। গালিয়ানোর ভাষায়, ‘তার পায়ে ভর করা শয়তানের আত্মা ব্রিটিশদের ফুটবল কৌশলকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছিল।’ তাঁর হাত ধরেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল ফুটবলের সেই ব্রাজিলিয়ান নীতির, যেখানে ফল লাভের চেয়েও বড় ছিল খেলার আনন্দ। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এটি আজ ব্রাজিলের ফুটবল থেকেও হারিয়ে গেছে।

ব্রাজিলের ফুটবলের অন্যতম সেরা তারকা গারিঞ্চা

ব্রাজিলের ফুটবলের অগ্রসরের ধারা অবশ্য কখনোই সরলরৈখিক ছিল না। ১৯২১ সালে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট এপিতাসিয়ো পেসোয়া হুলিয়া জারি করেছিল এই বলে যে ঐতিহ্য অক্ষুণ্ন রাখতে ব্রাজিল দলে কোনো বাদামি বর্ণের খেলোয়াড় থাকতে পারবে না। যে কারণে ফ্রিদেনরিচ সেবার কোপায় খেলতে পারল না। যদিও এই কালো আইন বেশি দিন বলবৎ থাকল না। ফলে দ্রুতই সব বর্ণের অংশগ্রহণে ব্রাজিলের ফুটবল স্পর্শ করল শিল্পের চূড়া। যে ধারা থেকেই একে একে বেরিয়ে আসেন দমিঙ্গোস দা গিয়া, লেওনিদাস, জিজিনিও, গ্যারিঞ্চা, পেলে, ডিডি, সক্রেটিস, রোমারিও, রোনালদো নাজারিও এবং রোনালদিনিওরা। বিভিন্ন সময়ে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ঐতিহ্যের করিডর ধরে বেরিয়ে আসা এই মানুষগুলোর মধ্যে দুটি বিষয় পুরোপুরি মিলে যায়। এরা সবাই বর্ণসংকর এবং প্রত্যেকের উত্থান দারিদ্র্য থেকে।

এরা উঠে আসতে পেরেছেন কারণ ফুটবল কিনতে খুব বেশি টাকা লাগে না এবং খেলার জন্য মাঠ হিসেবে বাড়ির পাশের উঠান কিংবা গলিগুলোই যথেষ্ট। ওহ, তাদের উঠে আসার পেছনে আরও একটি বড় সত্য লুকিয়ে আছে। তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে ফুটবল নামক খেলাটিকে ভালোবাসতে পেরেছিল।

এর মধ্যে ব্রাজিলের খেলা যতই বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল, ততই একটা বিষয় স্পষ্ট হতে থাকল; ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবল খেলে অন্যদের চেয়ে একেবারে আলাদাভাবে। এটা সত্যি যে প্রথম দুটি বিশ্বকাপে ব্রাজিল তেমন ভালো করতে পারেনি। কিন্তু বল পায়ে তারা কি করতে পারে তা মানুষের মুখে মুখে তখন ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ড্রিবলগুলো এতটাই নান্দনিক যে ব্রাজিলিয়ান কোনো ফুটবলার যখন গোটা শরীরটাকে নাচিয়ে বল নিয়ে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে কাটাত; দর্শকেরা তখন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যেতেন। ঐতিহাসিকেরা অবশ্য এর অন্য ব্যাখ্যাও নিয়ে এসেছেন।

ব্রাজিলের অন্দরমহলে বর্ণবাদের যে থাবা লুকিয়ে ছিল তা থেকে বাঁচতেই নাকি ড্রিবলের এমন শৈল্পিক রূপ দিতে পেরেছিল ব্রাজিলিয়ানরা। দুর্বল ও পুষ্টিহীন মানুষগুলো নিজেদের শ্বেতাঙ্গদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এ কৌশল বের করেছিলেন। যাতে কোনো ধরনের শারীরিক সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি না হয়।
নান্দনিকতা ও শিল্প যখন ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে ফুটবলকে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে গেল তখনই মারাকানায় বোমার মতো বিস্ফোরিত হলো ‘মারাকানাজোর’। অর্থাৎ ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল।

ব্রাজিলের অন্দরমহলে বর্ণবাদের যে থাবা লুকিয়ে ছিল তা থেকে বাঁচতেই নাকি ড্রিবলের এমন শৈল্পিক রূপ দিতে পেরেছিল ব্রাজিলিয়ানরা।

ব্রাজিলে আয়োজিত সে বিশ্বকাপে স্বাগতিকেরা ছিল হট ফেবারিট। ফাইনালের আগেই ব্রাজিল শহর-গ্রাম সব জায়গায় শুরু হয়ে গিয়েছিল উৎসব। ফাইনাল ব্রাজিল জিতবে, এ ছিল সূর্য পূর্ব দিকে ওঠার মতোই ধ্রুব সত্য এক ঘটনা। ফাইনালের আগে ব্রাজিলের খেলোয়াড়দের যে ঘড়ি উপহার দেওয়া হয়েছিল, তার পেছনে লেখা ছিল, ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের জন্য।’ পরদিন সকালের পত্রিকাও ব্রাজিলের বিজয়ের খবর দিয়ে ছাপা হয়ে গিয়েছিল। বিশ্ব জয়ের স্লোগান–সংবলিত ৫ লাখ টি-শার্টও ছাপা শেষ।

গালিয়ানো লিখেছেন, ‘ব্রাজিলের ফ্রিয়াকা যখন প্রথম গোলটি করলেন, দুই লাখ মানুষের গর্জন আর পটকার আওয়াজে মারাকানার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠেছিল।’ কিন্তু এরপরই বদলে যেতে শুরু করল গোটা অ্যাখ্যান। ম্যাচ শেষ হলো উরুগুয়ের ২-১ গোলের জয়ে। গোটা ব্রাজিলে মুহূর্তের মধ্যে নেমে আসল কবরের নিস্তব্ধতা। ফিফা সভাপতি জুলে রিমে পর্যন্ত গোটা ব্যাপারটি হজম করতে পারেননি। তিনি ব্রাজিল দলকে অভিনন্দন জানানোর জন্য একটি চিঠিও লিখে এনেছিলেন, যা শেষ পর্যন্ত তাঁর পকেটেই থেকে গিয়েছিল। ব্রাজিলের ইতিহাসের ভয়ংকর এই ট্র্যাজেডি নিয়ে বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান লেখক নেলসন রদ্রিগেজ লিখেছিলেন, ‘প্রতিটি জায়গার অপূরণীয় জাতীয় বিপর্যয় আছে, যা অনেকটা হিরোশিমার মতো। আমাদের হিরোশিমা হচ্ছে উরুগুয়ের কাছে ১৯৫০ বিশ্বকাপের ফাইনালে হার।’

ব্রাজিল ফরোয়ার্ড নেইমার

ব্রাজিলের সেই হার থেকেই প্রতিশোধের মন্ত্রে বেরিয়ে এসেছিল নতুন একটি প্রজন্ম, যা শুধু ব্রাজিলেরই নয়, ফুটবলের চিরকালীন ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিল চিরকালের জন্য। ব্রাজিলের ফুটবলের স্বর্ণযুগের শুরুটা ১৯৫৮ বিশ্বকাপ দিয়ে। তার আগেই অবশ্য ব্রাজিলের ফুটবল মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছিল বাকি বিশ্বের জন্য। যেমন ১৯৫৮ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে ব্রাজিল প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল ইতালিয়ান ক্লাব ফিওরেন্তিনার সঙ্গে। সেই ম্যচের ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি গারিঞ্চা নাকি ফিওরেন্তিনার পেনাল্টি বক্সের ভেতর এমন কচুকাটা করেছিল যে, যা অনেক দিন পর্যন্ত ক্লাবটির সমর্থকদের তাড়া করে বেড়িয়েছিল।

আর ১৯৫৮ বিশ্বকাপে গোটা দুনিয়াকে ব্রাজিল জানিয়ে দেয়, আমরা এসে গেছি। একই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরও শুনিয়েছিল তাঁর আগমনী গান। সে বছরটায় গোটা পৃথিবী পার করছিল অন্যরকম এক সময়। সে বছরই মার্কিনিরা মহাশূন্যে প্রথম উপগ্রহ পাঠাল, ইউরোপ নিজেদের জন্য চালু করেছিল একই বাজারব্যবস্থা, বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো কিউবায় বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে শুরু করেছিল ‘টোটাল ওয়ার।’ আলজেরিয়া জ্বলছিল এবং পুড়ছিল ফ্রান্সও। পুতুল রাজ্য শাসনের জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল ‘বার্বি ডলও।’ আর এমন নানা ঘটনার মধ্যে বিশ্বকাপে অভিষেক হয়ে গেল পেলে নামের সেই কিশোরের। পরে যিনি একাই হয়ে উঠবেন ফুটবলের ইতিহাস।

সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শুরুটা অবশ্য ভালো ছিল না। কোচের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অতিরিক্ত খেলোয়াড়দের নিয়ে খেলোয়াড়েরা নিজেরাই দল গঠন করে, যা বদলে দিয়েছিল ফুটবলের বাঁকও। এরপর ব্রাজিলের খেলা এমনই বিধ্বংসী ও দৃষ্টিনন্দন ছিল যে লন্ডনের ‘ওয়াল্ড স্পোর্ট’ পত্রিকা লিখেছিল, ‘চোখ পরিষ্কার করে বুঝতে হচ্ছিল, খেলাটা কি আসলেই এই পৃথিবীতে হচ্ছে!’ ব্রাজিল মাঠে নামলে গোটা মাঠজুড়ে প্রজাপতির মতো উড়তে থাকা পেলে-গ্যারিঞ্চা-ভাভা-জাগালোদের ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।

পেলের আগে যে মানুষটি বিশ্ব ফুটবলে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের আত্মপরিচয়কে খোদাই করে দিয়েছিল তাঁর নাম ছিল গারিঞ্চা। অথচ তাঁর পা দুটো সমান ছিল না, মস্তিষ্কও পুরোপুরি বিকশিত নয়। এমন কারও পক্ষে খেলোয়াড় হওয়া ছিল অসম্ভব। গালিয়ানো বলেছিলেন, সেই মানুষটি যখন বল পায়ে উইং ধরে ছুটতে শুরু করতেন, গোটা মাঠ হয়ে উঠত সার্কাসের রিং আর ফুটবল নামের খেলাটা হতো একটা আনন্দযজ্ঞ। তবে বলের খোঁজে গারিঞ্চাকে কখনো ছুটতে হতো না। বল নিজেই ধরা দিত তাঁর কাছে। বাঁকানো পায়ের সেই মানুষটি ছাড়া গোলক বস্তুটাকে এতটা সম্মানিত আর কে করতে পেরেছিল! অথচ ফুটবলকে নিয়ে ছেলেখেলা করা সেই মানুষটি যখন মারা গেলেন, তখন তিনি নিঃসঙ্গ, নিঃস্ব ও মাতাল।

সর্বশেষ ২০০২ বিশ্বকাপ জিতেছে ব্রাজিল

গারিঞ্চা যদি হন ফুটবলের বিদ্রোহী আত্মা, তবে পেলে ছিলেন তার বরপুত্র। যার পায়ের স্পর্শে ফুটবল অবতীর্ণ হতো ঐশ্বরিক ভূমিকায়। ফুটবল দিয়ে যা যা করা সম্ভব ছিল, পেলে তার সবটাই করতে পারতেন। মাঠে পেলের পায়ে বল মানেই অবিশ্বাস্য কিছুর সম্ভাবনা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন ফুটবল রাজার উপাধি। আর ২০ হওয়ার আগেই তাঁকে রপ্তানি নিষিদ্ধ জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করে ব্রাজিল সরকার। সে নিষেধাজ্ঞার বলয়ের ভেতর থেকেই ব্রাজিলের হয়ে তিনটা বিশ্বকাপ জেতেন পেলে। ফুটবলকে যদি দুটি পর্বে ভাগ করা হয়, তবে একটি হবে পেলের আবির্ভাবের আগে এবং আরেকটি পরে।

গালিয়ানো লিখেছিলেন, ‘পেলে যখন বল পায়ে দ্রুত গতিতে দৌড়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণ দুর্গ গুঁড়িয়ে দিত, মনে হতো একতাল মাখনের মধ্য দিয়ে কেউ ছুরি চালিয়ে দিয়েছে।’ ফুটবলে পেলে এসেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি আর কখনো হারাননি। ফুটবলের সঙ্গে জড়িয়ে পেলে এখন চিরন্তন। তিনি নিজে অবশ্য বলেছিলেন, যা কিছু তার প্রাপ্তি, সে জন্য তিনি ফুটবলের কাছে ঋণী। কিন্তু উল্টোটাও মিথ্যা নয়। ফুটবলও পেলের কাছে সমানভাবে ঋণী। এর মধ্যে পেলের হাত ধরেই তিনটি বিশ্বকাপ জিতে ব্রাজিলের ফুটবলও নিশ্চিত করে ফেলেছে অমরত্ব।

পেলের বিদায়েও ডুবে যায়নি ব্রাজিলের ফুটবল সূর্য। জিকো-ফ্যালকাও-সক্রেটিসরা বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও ব্রাজিলের ফুটবলের সুন্দর ফুটবল তথা জোগো বনিতোকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। এরপরও অবশ্য ২০ বছর বিশ্বকাপ শিরোপার দেখা পায়নি ব্রাজিলীয়রা। ১৯৯৪ সালে রোমারিওর নামের আরেক জাদুকরের হাত ধরে আসল ব্রাজিলের চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা। বিশ্বকাপ জিতে রোমারিও পর্দার আড়ালে যাওয়ার আগেই চলে আসেন রোনালদো নাজারিও। সেরা সময়ের রোনালদোকে থামানোর ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো রক্ষণভাগেরই ছিল না। প্রতিপক্ষের রক্ষণ দুর্গ তাক করে ছুটতে থাকা রোনালদোর ছিলেন বুলেটের চেয়ে গতিময় ও তীব্র।

ফেনোমেনন রোনালদো যখন বল নিয়ে ছুটতে শুরু করতেন, ভয়ে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পা কাঁপতে শুরু করত। এমনকি তাঁদের কী করা উচিত, তা–ও তাঁরা ভুলে যেতেন। তবে অপয়া চোট কালো জাদুর মতো সারাক্ষণ রোনালদোর পেছনে লেগে ছিল, যার ভোগে গেছে রোনালদোর সেরা সময়ের অনেকটাই। তবে আধা ফিট রোনালদোই ব্রাজিলকে পঞ্চম বিশ্বকাপ শিরোপা এনে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলেন। যাঁর জাদু সঙ্গী ছিলেন একজন রোনালদিনিও। যার পায়ে বল হয়ে উঠত ছোট্ট শিশু। রোনালদিনিও ছিলেন এমন একজন যিনি বলকে নিয়ে যা করতে চেয়েছেন, তাই করেছেন। তবে উদ্দাম জীবন ভোগে নিয়েছে এই অলস জাদুকরের ফুটবল প্রতিভার অনেকটাই।

২০০২–এ বিশ্বকাপ জেতার পর থেকেই শুরু হয় ব্রাজিলের ফুটবলের অগস্ত্যযাত্রা। পরবর্তী সময়ে কাকা-নেইমাররা এসেছেন বটে, ব্যক্তিগত প্রতিভায় তাঁরা ব্রাজিলের ফুটবলকে নিজেদের রক্তে বহনও করেছেন। দল হিসেবে ব্রাজিল ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল তলানিতে। অতিরিক্ত ইউরোপমুখিতা ও পুঁজির আগ্রাসনই মূলত ব্রাজিলের ফুটবলের ভিতকে পুরোপুরি ধসিয়ে দিয়েছে। যার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ব্রাজিলীয় ফুটবলের অন্ধকার যুগও। একের পর এক বিশ্বকাপ ব্যর্থতা ব্রাজিলকে কোণঠাসা করে দিল। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ঘরের মাঠে জার্মানির কাছে ৭-১ গোলে কচুকাটা হওয়ার ঘটনা ছিল ব্রাজিলের ইতিহাসে দ্বিতীয় ‘মারাকানাজ্জো’। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি যা হয়েছে, তা হলো ব্রাজিল তাদের ফুটবল ডিএনএ যে চিরতরে হারিয়ে বসল। ব্রাজিলের ফুটবলের ভেতরে ও বাইরের বিশৃঙ্খলা দেশটির ফুটবল-ঐতিহ্যকে এখন হাসির খোরাকে পরিণত করেছে। এমন নয় যে ব্রাজিল আর তারকা ফুটবলার তৈরি করছে না!

কিন্তু ভিনিসিয়ুস-রদ্রিগো-রাফিনিয়ারা এখন পর্যন্ত থেকে গেছেন শুধুই ক্লাবের ফুটবলার হয়ে। তাঁরা এখন আর আনন্দের জন্য ফুটবল খেলেন না। ফ্রিদেনরিচের হাত ধরে যে ফুটবল–ঐতিহ্য ব্রাজিলিয়ানরা তাঁদের রক্তে বয়ে নিয়ে আসছিল, তা এক মুহূর্তের মধ্যে তছনছ হয়ে গেল। ভেঙে পড়ল ব্রাজিলের ঘরোয়া ফুটবলের ভিতও। একসময় ব্রাজিলের ক্লাব ফুটবল যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী লিগ হিসেবে পরিচিত ছিল, তা এখন পরিণত হয়েছে ঐতিহ্যের কঙ্কালে। অতিরিক্ত ইউরোপমুখী হওয়ায় মূলত কাল হয়েছে ব্রাজিলের জন্য, যা তাদের করেছে শিকড় বিচ্ছিন্ন। যার ফলে অঙ্কুরে থাকা অবস্থাতেই এনদ্রিক বা ভিতর রোকেরা চলে যাচ্ছেন ইউরোপে। কয়েক বছরের মধ্যে ধুয়েমুছে যাবে তাঁদের শরীরে লেগে থাকা ব্রাজিলীয় ফুটবলের শেষ ঘ্রাণটুকুও। আর যখনই জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নামছেন, বেরিয়ে আসছে ফুটবলের কঙ্কালসার রূপটুকু। যেখানে ব্রাজিলের ফুটবল বলে আর কিছু নেই।

ব্রাজিলের এমন নখদন্তহীন ফুটবলের সর্বশেষ উদাহরণ চলমান কোপা আমেরিকা। যেখানে যাচ্ছেতাই ফুটবল খেলে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছে ‘সেলেসাও’রা। যেন অন্তহীন বিশাল এক শূন্যকে ঘিরে ঘুরছে ব্রাজিলের ফুটবল, যা আর কখনো তাঁর প্রকৃত ঠিকানা খুঁজে পাবে কি না, সেই প্রশ্নও এখন উঠতে শুরু করেছে। ব্রাজিলের ফুটবলারদের এই অতিরিক্ত ইউরোপমুখী হওয়াকে তাদের তলানিতে পৌঁছানোর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কিংবদন্তি আর্জেন্টাইন কোচ মার্সেলো বিয়েলসাও। গায়ে জোগো বনিতোর হাওয়া লাগার আগেই দূরের নক্ষত্র হয়ে যাচ্ছেন তরুণেরা। প্রশ্ন হচ্ছে এর সমাধান কী?

বাস্তবিক অর্থে মানুষের যখন আর হারানোর কিছু থাকে না কিংবা পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায়, তখনই শুরু হয় তাঁর নতুন পথচলা। ব্রাজিলও হারতে হারতে এখন শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেছে। এখান থেকে হয় সে চিরতরে হারিয়ে যাবে কিংবা ঘুরে দাঁড়িয়ে শুরু করবে নিজের আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়ার লড়াই। এটি সে লড়াই, যা ব্রাজিলকে আবার ব্রাজিল করে তুলবে। ফুটবলের সঙ্গে চিরন্তন হয়ে যাওয়া হলুদ রংকে ফিরিয়ে দেবে তার আপন মর্যাদা। ব্রাজিলিয়ানদের ঐক্যবদ্ধভাবে এটি করতেই হবে। কারণ, ফুটবল ছাড়া তাদের পাওয়ার কিংবা হারানোর যে আর কিছুই নেই!