ম্যান সিটি ৪ (৫) : রিয়াল মাদ্রিদ ০ (১)
‘এই প্রতিযোগিতার জন্য বিশুদ্ধ ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেই।’ গত মাসে চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে এক পা দিয়ে ইনস্টাগ্রামে এই কথা লিখেছিলেন আর্লিং হলান্ড। ম্যানচেস্টার সিটি তারকার সেই ভালোবাসা এখন যেন পরিণতি পাওয়ার অপেক্ষায়।
ফিরতি লেগে রিয়াল মাদ্রিদকে ৪-০ (দুই লেগ মিলিয়ে ৫-১) গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করেছে সিটি। হলান্ডের ভালোবাসার চূড়ান্ত পরিণতি লাভে এখন প্রয়োজন একটি জয়। ফাইনালে ইন্টার মিলানকে হারাতে পারলে হলান্ডের ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়ার সঙ্গে সিটির প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বপ্নও পূরণ হবে। সিটিকে স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া মানুষটির নাম বের্নার্দো সিলভা। প্রথমার্ধে তিনি করেছেন জোড়া গোল। পরে একটি গোল করেন আকাঞ্জি এবং অন্যটি করেন হুলিয়ান আলভারেজ। এই জয়ে গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালে হারার প্রতিশোধও নিল সিটি।
ইতিহাদে ফিরতি লেগের এই ম্যাচে আগে যখন সিটির সম্ভাব্য নায়কদের কথা ভাবা হচ্ছিল, সেখানে হলান্ড-ডি ব্রুইনাদের আশপাশেও ছিল না সিলভার নাম। কিন্তু ফাইনাল খেলার তাড়না হয়তো এদিন আলাদাভাবে উজ্জ্বীবিত করেছিল সিলভাকে।
সিটিকে স্বপ্নের ফাইনালে নেওয়ার নায়কও হলেন সিলভাই। প্রথমার্ধে তাঁর করা দুই গোলই মূলত ভাগ্য গড়ে দিয়েছে। তবে এককভাবে কাউকে কৃতিত্ব দেওয়াটা বাকিদের জন্য একটু অন্যায়ই হবে। এই ম্যাচে সিটির গোটা দলটাই খেলেছে অনবদ্য। এদিন তারা যেন সেমিফাইনালের আগে ওয়েইন রুনির বলা সেই কথাটিকে সত্য প্রমাণ করার জন্য মাঠে নেমেছিল। ইংলিশ কিংবদন্তি রুনি বলেছিলেন, ‘সিটি শুধু রিয়ালকে হারাবেই না, রীতিমতো উড়িয়ে দেবে।’
অন্যদিকে রিয়াল তারকাদের এ ম্যাচে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। বেনজেমা, ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগোরা নিজেদের ছায়াতেই যেন ঢাকা ছিলেন। পাশাপাশি কোর্তোয়াকে বাদ দিলে রিয়ালের রক্ষণও ছিল ভঙ্গুর।
এই ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে সিটি বস পেপ গার্দিওলা সমর্থকদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না, খুব বেশি পরীক্ষা নীরিক্ষা করব না।’ গার্দিওলা নিজের কথা রেখেছেন। এই ম্যাচে ট্যাকটিক্যালি বড় কোনো চমক দেননি সিটি বস। উল্টো প্রথম লেগে হলান্ডকে পকেটে রাখা আন্তোনি রুডিগারকে বেঞ্চে রেখে চমক দিয়েছেন রেকর্ড ১৯১তম চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচে ডাগআউটে দাঁড়ানো (টপকেছেন স্যার আলেক্স ফার্গুসনের ১৯০ ম্যাচের রেকর্ডকে) রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তি।
রিয়াল কোচের এই সিদ্ধান্ত দলকে বেশ ভুগিয়েছে। প্রথম লেগের মতো এদিন আর নিষ্প্রভ থাকেননি হলান্ড। কোর্তোয়া বাধা হয়ে না দাঁড়ালে শুধু গোল নয়, হ্যাটট্রিকও পেয়ে যেতে পারতেন নরওয়েজীয় স্ট্রাইকার। আর গোল না পেলেও হলান্ডের আগ্রাসী ফুটবলের কারণে সিটির বাকি ফরোয়ার্ডরা বেশ ফাঁকা জায়গা পেয়েছে যা স্বাগতিকদের জন্য কাজটা সহজই করে দিয়েছে।
ইতিহাদে সিটি এদিন দারুণ এক রেকর্ডকে সঙ্গী করে মাঠে নেমেছিল। নিজেদের মাঠে শেষ ২৫টি ম্যাচের কোনোটিতেই হারেনি তারা (২৩ জয়, ২ ড্র)। এদিনও শুরু থেকে দাপট ছিল তাদের। নিচ থেকে বিল্ডআপে প্রথম মিনিট থেকেই আক্রমণে যায় সিটি। নিজেদের মাঝে ছোট ছোট পাসে শুরু থেকেই রিয়ালকে চাপে ফেলার চেষ্টা করে তারা। রদ্রি এবং জন স্টোনস ডাবল পিভট (ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার) হিসেবে খেলে পুরো ম্যাচকে সিটির নিয়ন্ত্রণে এনে দেন। বিশেষ করে রদ্রি ছিলেন পুরো ম্যাচে সিটির আক্রমণের অন্যতম সূত্রধর।
৭ মিনিটে কেভিন ডি ব্রুইনা-হলান্ডের বোঝাপড়ায় দারুণ এক সুযোগ তৈরি করেছিল সিটি। কিন্তু সেই আক্রমণে গোল আসেনি। গোল না পেলেও রিয়ালকে রীতিমতো কোণঠাসা করে আক্রমণের ঝড় বয়ে দেয় সিটি। ১৩ মিনিটে তেমনই এক আক্রমণে বাঁ প্রান্ত দিয়ে জ্যাক গ্রিলিশ দারুণভাবে বল বাড়ান হলান্ডের উদ্দেশে। কাছাকাছি জায়গা থেকে হলান্ডের হেডে কোর্তোয়া যেভাবে বলটি ঠেকালেন তা নিয়ে কেউ চাইলে বিশেষ গবেষণাও করতে পারেন।
বড় ম্যাচে কোর্তোয়াকে বরাবরই প্রতিপক্ষ শিবিরের জন্য চীনের প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে দেখা যায়। এদিনও ব্যতিক্রম হয়নি। ২১ মিনিটে ফের সব আলো নিজের দিকে টেনে নেন কোর্তোয়া। আবার হলান্ডের নিশ্চিত গোলের প্রচেষ্টা বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেকান এ বেলজিয়ান গোলরক্ষক। সিটি যখন রিয়ালের আক্রমণভাগকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একের পর এক আক্রমণ করে যাচ্ছিল, দেয়াল হয়ে একাই দাঁড়িয়ে ছিলেন কোর্তোয়া।
কিন্তু একা একা আর কতক্ষণ আর লড়া যায়! ২৩ মিনিটে শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে কোর্তোয়ার ইস্পাত দৃঢ় দেয়ালও। ডি ব্রুইনার পাস থেকে ডি-বক্সের ভেতর বল পেয়ে বুলেট গতির শটে কোর্তোয়া বাধা পার করেন বের্নার্দো সিলভা।
ম্যাচের প্রথম ২৫ মিনিট বিশ্লেষণ করলে পুরো দৃশ্যপটে শুধু সিটিকেই দেখা যাবে। ৮০ শতাংশ বলের দখল রেখে ৬টি শট নিয়ে ৩টিই লক্ষ্যে রাখে সিটি। বিপরীতে রিয়াল শট নেওয়া দূরে থাক, বলের স্পর্শই পেয়েছে কদাচিৎ। ৩২ মিনিটে প্রথমবারের মতো বল নিয়ে সিটি ডি-বক্সে বিপজ্জনকভাবে ঢুকে পড়েছিলেন ভিনিসিয়ুস। যদিও কাইল ওয়াকার ঠিকই রুখে দেন ভিনিকে।
সিটির পক্ষে প্রথম লেগেও আগে চাপ হজম করে ধীরে ধীরে খোলস ছাড়ে রিয়াল। এই ম্যাচেও ৩২ মিনিটের পর স্বরূপে ফেরার পর চেষ্টা করে রিয়াল। ৩৫ মিনিটে ডি-বক্সের অনেকটা বাইরে থেকে টনি ক্রুসের রকেট শট বারে লেগে ফিরে আসলে হতাশ হতে হয় রিয়ালকে। ক্রুস না পারলেও পরের মিনিটে ঠিকই পেরেছেন সিলভা। ইলকাই গুন্দোয়ানের শট মিলিতাওয়ের গায়ে লেগে ফিরে আসলে ফাঁকা জায়গায় বল পেয়ে যান সিলভা। হেডে বলকে দ্বিতীয়বারের মতো জালের ঠিকানা দেখাতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি এই পর্তুগিজ মিডফিল্ডারকে।
বিরতির আগে ব্যবধান আরও বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছিল সিটি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুই গোলেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। কোর্তোয়ার দুর্দান্ত সেইভগুলো না থাকলে অবশ্য প্রথমার্ধেই ম্যাচের ইতি টেনে দিতে পারত সিটিজেনরা।
বিরতির পর ফ্রি-কিক থেকে ডেভিড আলাবার শট আঙুলের স্পর্শে বাইরে পাঠান এদেরসন। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ম্যাচ অবশ্য প্রথমার্ধের মতো একপেশে ছিল না। সিটির আক্রমণের জবাব প্রতি-আক্রমণ দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল রিয়াল। বলের দখলেও সিটির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে খেলার চেষ্টা করছিল রিয়াল। বল নিয়ে একাধিকবার সিটির রক্ষণে হানাও দেয় তারা। কিন্তু স্বাগতিক রক্ষণ ভেঙে গোল পাওয়ার আসল কাজটি করতে পারছিল না তারা।
তবে ৭৩ মিনিটে হলান্ডের শট কোর্তোয়ার পায়ে না লেগে বারে না লাগলে প্রাপ্য গোলটি পেয়েও যেতে পারতেন এ স্ট্রাইকার। এ ম্যাচে অন্তত তিনবার হলান্ডকে নিশ্চিত গোল পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছেন কোর্তোয়া। হলান্ড না পারলেও তৃতীয় গোল পেতে সমস্যা হয়নি সিটির। ডি ব্রুইনার ফ্রি-কিকে নিজেদের তৃতীয় গোল করেন আকাঞ্জি। আকাঞ্জির হেড জালে জড়ায়।
এরপর শেষ দিকে সিটির হয়ে আরেকটি গোল করে ব্যবধান ৪-০ করেন বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন তারকা আলভারেজ। সে সঙ্গে সিটি পায় রিয়ালের বিপক্ষে নিজেদের ইতিহাসের স্মরণীয় জয়ও। এই জয় সিটিকে শুধু ফাইনালেই নিয়ে যায়নি, মৌসুমে ট্রেবল জয়ের আত্মবিশ্বাসের পালেও দারুণভাবে হাওয়া দেবে।