দুই দলের মোট বিশ্বকাপ শিরোপার সংখ্যা ৯টি। কিন্তু দুই দলই এখন পথ হারিয়ে ধুঁকছে। বলা হচ্ছে ব্রাজিল ও জার্মানির কথা। বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর এখনো ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো ইঙ্গিত দিতে পারেনি সাবেক এই দুই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া ব্রাজিল তো এখনো কোচই নিয়োগ দিতে পারেনি। বিশ্বকাপের পর খেলা তিন ম্যাচের দুটিতেই হেরেছে তারা।
আর টানা দুই বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেওয়া জার্মানিও পাচ্ছে না ঘুরে দাঁড়ানোর পথ। সর্বশেষ ১১ ম্যাচের মাত্র ৩টিতে জিতেছে তারা। দলের অবস্থা ও হতশ্রী পারফরম্যান্স দুই দলের সমর্থকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দুঃসময় ভুলে ব্রাজিল-জার্মানির ঘুরে দাঁড়ানোর অপেক্ষা আর কত দীর্ঘায়িত হবে? আগামী বছর ব্রাজিলের সামনে কোপা আমেরিকা ও আর জার্মানির ইউরোর চ্যালেঞ্জ। এর আগে কি এই দুই দল পরাশক্তিরূপে ফিরতে পারবে?
এ যেন অচেনা ব্রাজিল
ফিরে দেখা যাক গত বছরের ৬ ডিসেম্বরের ব্রাজিল-দক্ষিণ কোরিয়া ম্যাচটি। সেদিন এশিয়ান দেশটিকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে ব্রাজিল। ম্যাচটিতে ৩৬ মিনিটের মধ্যেই ৪ গোল করে ব্রাজিল। যেখানে ছিল রিচার্লিসনের জাদুকরি এক গোলও। সেই ম্যাচের পর বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে যেন আরও বেশি অপ্রতিরোধ্য দেখাচ্ছিল।
কেউ কেউ তো আগাম চ্যাম্পিয়নের তকমাও দিয়েছিল সেলেসাওদের। কিন্তু ব্রাজিলের সেই দাপুটে ফুটবলের পুরোটাই যে মরীচিকা ছিল, তা স্পষ্ট হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচেই বাস্তব চিত্রটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এগিয়ে গিয়েও সেদিন টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নিতে হয় পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের। সেই হারটা ছিল মূলত ব্রাজিলের ফুটবলের দুর্দশার সূচনামুখ।
সেদিনের সেই হারের পর ব্রাজিল দলের কোচের পদ ছাড়েন তিতে। এমনকি ব্রাজিলে ফিরে হেনস্তার শিকারও হতে হয় বর্ষীয়ান এই কোচকে। ম্যাচ হারের পরপর কোচের পদ ছাড়লেও সেই শূন্য পদ এখনো পূরণ করতে পারেনি ব্রাজিল। আপাতত কাজ চালাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন কোচ র্যামন মেনেজেস। যাঁর অধীনে তিন ম্যাচ খেলে দুটিতেই হেরেছে ব্রাজিল। হলুদ-সবুজ জার্সির দলটি বিশ্বকাপের পর যাত্রা শুরু করে মরক্কোর বিপক্ষে ২-১ গোলের হার দিয়ে। এরপর গিনিকে ৪-১ গোলে হারালেও মঙ্গলবার রাতে তারা ফের হেরেছে সেনেগালের কাছে। এই ম্যাচে ব্রাজিলের হার ৪-২ গোলে।
তবে ম্যাচ জেতা বা হারার চেয়েও বড় প্রশ্ন তৈরি হয়েছে ব্রাজিল যে ধরনের ফুটবল খেলছে বা যে কৌশলে নিজেদের ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার কথা ভাবছে, সেটা। যা ব্রাজিলের ফুটবলের জন্য সামনের দিনগুলোতে আরও বড় বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ব্রাজিলের ফুটবল এই মুহূর্তে যেসব সংকটে আছে, তার মধ্যে সবার ওপরে কোচ নিয়োগ নিয়ে চলমান নাটক। তিতের বিদায়ের পর ব্রাজিলের পরবর্তী কোচ হিসেবে শোনা গিয়েছিল লুইস এনরিকে, জোসে মরিনিও এবং কার্লো আনচেলত্তিসহ বেশ কিছু নাম। সে সময় দেশি কোচ বনাম বিদেশি কোচ নিয়ে বেশ বিতর্কও তৈরি হয়। তবে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ) বিদেশি কোচ নিয়োগের পথেই হাঁটা শুরু করে। এই মুহূর্তে ব্রাজিলের কোচ হওয়ার দৌড়ে টিকে আছেন শুধু আনচেলত্তি।
কিন্তু আনচেলত্তিকেও এখনো নিয়োগ দিতে পারেনি ব্রাজিল। ইতালিয়ান এই কোচ এখন রিয়াল মাদ্রিদে। ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ শেষ না করে তিনি কোথায় যাবেন না। এমন অবস্থায়ও ব্রাজিল তাঁকে পেতে মরিয়া। এ জন্য নাকি আরও এক বছর অপেক্ষা করতে রাজি আছে কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে ইতালিয়ান এই কোচ নাকি মৌখিক সম্মতিও দিয়েছেন। যার ফলে আনচেলত্তিকে কোচ হিসেবে পাওয়ার জন্য ব্রাজিলকে অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের জুলাই পর্যন্ত। অর্থাৎ আনচেলত্তি দায়িত্ব গ্রহণের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়ে যাবে কোপা আমেরিকা।
টুর্নামেন্টের মাঝামাঝি সময়ে নিশ্চয় কোচের দায়িত্ব নেবেন না আনচেলত্তি। তেমনটা হলে মেনেজেসকে দিয়েই কোপার শিরোপা জয়ের মিশনে নামতে হবে ব্রাজিলকে।
মেনেজেসকে দিয়ে ব্রাজিলের কোপা জয়ের লক্ষ্য পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর অন্তর্বর্তীকালীন কোচের হাতে দলকে লম্বা সময়ের জন্য ছেড়ে দেওয়া নিশ্চয় কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত নয়। তা ছাড়া বিশ্বকাপ প্রস্তুতির জন্য দুই বছর যথেষ্ট কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। আনচেলত্তি যখন দায়িত্ব নেবেন, তখন বিশ্বকাপ বাছাইয়ের বেশ কিছু ম্যাচও হয়ে যাবে। দলের পারফরম্যান্স ভালো বা খারাপ যেমনই হোক, উভয়ই রিয়াল মাদ্রিদ কোচের জন্য অস্বস্তির কারণ হতে পারে। বলা যায়, বেশ এলোমেলো সময়ে দায়িত্ব নিতে আসবেন আনচেলত্তি।
২০১৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের চিত্রটা অবশ্য ভিন্ন ছিল। ব্যর্থতার পরও তিতের ওপরই আস্থা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সিবিএফ। শুরু থেকেই পরবর্তী বিশ্বকাপের দল গড়ায় মনোযোগ দেন ব্রাজিলিয়ান এই কোচ। বিশ্বকাপের পর যে দলটিকে প্রথম তিনি খেলিয়েছেন সে দলের ১১ জনের ৯ জনই কাতার বিশ্বকাপে শুরু থেকে ছিলেন। অন্য দুজন ছিলেন ভিনিসিয়ুস ও রাফিনিয়া।
বিপরীতে ব্রাজিলের মতো তারকাবহুল দলকে সামলাতে মেনেজেস যে হিমশিম খাচ্ছেন, তা অনেকটাই স্পষ্ট। বিশ্বকাপের পর তিন প্রীতি ম্যাচে মোট ১১ জনকে অভিষেক করিয়েছেন মেনেজেস। এই দলে ১৮ বছর বয়সী ভিতর রকি যেমন আছেন, তেমনি ২৮ বছর বয়সী রনিও আছেন। সব মিলিয়ে অনেকটা পরিকল্পনাবিহীনই এগোচ্ছে ব্রাজিল। যেখানে মরক্কো ও সেনেগালের বিপক্ষে হারকে একটা বিপৎসংকেত হিসেবে দেখাই যায়। দ্রুত এ বিষয়গুলো সমাধান না করলে সামনে দলটির জন্য আরও বড় বিপদই অপেক্ষা করছে।
কবে ঘুম ভাঙবে ফ্লিকের জার্মানির
জার্মানির সমস্যা অবশ্য ব্রাজিলের মতো নয়। ২০১৮ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার ভূত ২০২২ সালেও তাড়াতে পারেনি চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। রাশিয়ার পর কাতারেও প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিতে হয় তাদের। এমনকি বিশ্বকাপে পাওয়া ধাক্কাও জার্মানির শীতনিদ্রা ভাঙতে পারেনি। ব্যর্থতার ধারাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে তারা। বিশ্বকাপের পর খেলা ৫ ম্যাচের মাত্র ১টিতে জিতেছে জার্মানি। সেটিও আবার পেরুর বিপক্ষে।
এই ম্যাচগুলোর ৩টিতেই হেরেছে তারা, ড্র করেছে একটি। ইউরোর এক বছর আগে দলের এমন পারফরম্যান্স বিপাকে রেখেছে কোচ হানসি ফ্লিককে। মঙ্গলবার রাতে কলম্বিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে হারের পর একরকম অসহায় আত্মসমর্পণই যেন করলেন ফ্লিক। বললেন, তাঁর কিছু বলার নেই। কোচের এমন ব্যাখ্যা অবশ্য সমর্থকদের মন ভরাতে পারছে না। এরই মধ্যে বেশ দুয়োও শুনতে হয়েছে দলটিকে।
জার্মান দলের সাফল্যের জন্য চিরায়ত যে ক্ষুধা, তা এই দলটিতে পুরোপুরি অনুপস্থিত। কিছু করে দেখানোর কোনো তাগিদই যেন খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সে নেই। তবে দ্রুত এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে হবে দলটিকে। ফ্লিক অবশ্য বলেছেন ঘুরে দাঁড়ানোর কথা। তিনি বলেছেন, ‘এই পর্বে আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো প্রয়োজন। সেপ্টেম্বরে আমাদের ভিন্ন পারফরম্যান্স করে দেখাতে হবে। আমরা ভিন্ন একটি দলকেই তখন দেখতে পাব। ফলও আসা শুরু করবে। আমরা নিশ্চিত যে আমাদের ভালো দল এবং ভালো খেলোয়াড় আছে।’
তবে সমর্থক এবং জার্মান সংবাদমাধ্যমগুলো কোচের ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে। এরই মধ্যে একাধিক জার্মান সংবাদমাধ্যম ফ্লিক আসলেই জার্মান ফুটবল দলের জন্য সঠিক ব্যক্তি কি না, তা জানতে চেয়ে পোলও চালু করেছে। এমনকি জার্মান ফুটবল ফেডারেশন নাকি ফ্লিককে বাদ দেওয়ার কথাও ভাবছে। তবে কোচকে সরানো আসলেই সমাধান কি না, তা নিয়েও ভাবার জায়গা আছে। জার্মান দল একধরনের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দলে ২০১৪ বিশ্বকাপ জেতা অনেকের প্রভাব গত কিছুদিন আগেও ছিল। কাতার বিশ্বকাপেও ম্যানুয়াল নয়্যার, টমাস মুলার ও মারিও গোৎসেদের মতো ফুটবলারদের দেখা গেছে।
বিশ্বকাপের পর সেই ধারা থেকে বের হওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। তবে ফ্লিকের দলে তরুণ মুখের অভাব আছে। কলম্বিয়ার বিপক্ষে হারা ম্যাচে শুধু জামাল মুসিয়ালা ও মালিক থাইওয়ার বয়স ছিল ২১ কিংবা এর চেয়ে কম। তা ছাড়া গত কয়েক ম্যাচে দলকে একাধিক ফরমেশনে খেলিয়েছেন ফ্লিক। সেসবও দলের খেলায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। সব মিলিয়ে ফ্লিকের হাতে সময় খুবই কম। দ্রুত দলকে গুছিয়ে নিয়ে জয়ের ধারায় ফিরতে হবে। নয়তো তাঁর নিজের এবং জার্মান দলের জন্য অপেক্ষা করছে সমূহ বিপদ।