আর্জেন্টিনা ফুটবল–পাগল দেশ। তিনবার বিশ্বকাপজয়ী দেশ। ফুটবলের ঐতিহ্যও দুই-এক দিনের নয়। ডিয়েগো ম্যারাডোনা-লিওনেল মেসি বলতে অজ্ঞান দেশটির মানুষেরা।
গত ডিসেম্বরে কাতারে বিশ্বকাপ জয়ের পর আর্জেন্টাইনদের এই ফুটবল–উন্মাদনা নতুন করে দেখেছে বিশ্ব। বুয়েনস এইরেসের রাস্তায় নেমেছিলেন লাখ লাখ মানুষ। নেচে–গেয়ে আনন্দ–উল্লাসে বিশ্বকাপজয় উদ্যাপন করেছেন। সেই উৎসবে হয়তো ছিলেন দুই–একজন নারী ফুটবলারও। তখন কি সেসব নারী ফুটবলারদের মনে হয়েছে, মেসিদের ঘিরে উৎসবের মধ্যে আর্জেন্টাইন ফুটবলে তাঁরা কিছুটা হলেও বঞ্চিত?
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আর্জেন্টিনায় নারীদের ফুটবল খেলা এখনো পুরোপুরি ইতিবাচক চোখে দেখা হয় না। দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশে বেশির ভাগই ক্যাথলিক ধর্মীয় বিশ্বাসের। সাম্প্রতিক বছরে আর্জেন্টাইন নারীদের সামাজিকভাবে এগিয়েও নেওয়া হয়েছে। ২০২০ সালে স্বেচ্ছায় গর্ভপাতের আইনগত অনুমোদন দিয়েছে আর্জেন্টিনা, ফুটবলেও এগিয়েছে। তবে সেই আগোনোটা প্রত্যাশার চেয়ে কম।
একটা প্রশ্ন করা যাক। আর্জেন্টিনায় মেসি–দি মারিয়াদের নিয়ে তো মাতামাতির শেষ নেই। যদি প্রশ্ন করা হয়, সেই একই দেশে মেয়েরা কি পেশাদার ফুটবলার হয়ে উঠতে পেরেছেন? উত্তরটা শুনলে চমকে যাবেন। আর্জেন্টিনায় মেয়েদের ফুটবলকে ‘আধা পেশাদার’ স্বীকৃতি দেওয়া হয় মাত্র চার বছর আগে ২০১৯ সালে। অর্থাৎ, পুরো পেশাদার অবকাঠামো এখনো হয়নি। ফুটবলকে ক্যারিয়ার বানানোর মতো অবস্থায় উন্নীত হয়নি আর্জেন্টিনার নারী ফুটবল।
মেয়েদের খেলাধুলাকেন্দ্রিক মিডিয়া আউটলেট ‘গার্লস উইথ বলস’ নারী ফুটবলার ও কোচদের সম–অধিকার নিয়ে বলেছে, ‘আমাদের অধিকারগুলোকে সম্মান করা হয় না। আমরা বিভিন্ন নির্যাতনেরও শিকার হই।’ আর্জেন্টিনায় নারী ফুটবলে টাকাপয়সার বিনিয়োগও কম। ‘গার্লস উইথ বলস’–এর ওয়েবসাইটে নারী ফুটবলারদের পক্ষে বলা হয়েছে, ‘পুরুষ ফুটবলাররা যে পোশাক (জার্সি) ফেলে দেয়, সেটা আমাদের পরতে হয়। অনুশীলনেও আমরা পর্যাপ্ত সরঞ্জাম পাই না।’
আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলোর নিচু স্তরে মেয়েদের জন্য দল নেই। তাতে তৃণমূল পর্যায় থেকে নারী ফুটবলার উঠে আসতে পারছেন না। স্কুলেও মেয়েদের ফুটবল খেলার ব্যবস্থা খুব কম। খুব কম স্কুলেই এই সুযোগ আছে। ‘গার্লস উইথ বলস’–এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘চোট পেলে আমাদের কোনো চিকিৎসা–সুবিধা নেই। এমনকি পেশাদার চুক্তিও নেই।’
অথচ অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে ২০ জুলাই থেকে শুরু হবে নারীদের বিশ্বকাপ ফুটবল। আর্জেন্টিনা নারী ফুটবল দল এখন বিশ্বকাপ নিয়ে ব্যস্ত। ১৯৯৩ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিল আর্জেন্টিনা নারী জাতীয় দল। কিন্তু ৩০ বছর পেরিয়ে আর্জেন্টিনা নারী জাতীয় দল যখন বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ঘরোয়া ফুটবলারদের অবস্থা তথৈবচ। বোকা জুনিয়র্সের সাবেক মিডফিল্ডার কামিলা গোমেজ সম্প্রতি একটি স্কুলের কনফারেন্সে বলেছেন, প্রতিদিন অনুশীলন করার মতো যথেষ্ট আয় নেই নারী ফুটবলারদের। চিলির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলা কামিলা বলেছিলেন, ‘আপনি যদি ভোর ৬টায় উঠে সারা দিন কাজের মধ্যে থাকেন, তাহলে পেশাদার (ফুটবলার) হতে পারবেন না।’
বোকা জুনিয়র্সের আরেক খেলোয়াড় হুলিয়া পাজ দুপে একই কনফারেন্সে বলেছিলেন, ‘আমরা কৃত্রিম ঘাসে খেলি।’ আসল ঘাসের মাঠ ছেলেদের জন্য জানিয়ে ডুপে আরও বলেছিলেন, ‘জার্সিও বেশ বড় বড় ও বেঢপ।’
দুপে বেশি দিন আর্জেন্টিনায় খেলতে পারেননি। ফুটবলকেও ধরে রাখতে পারেননি। দুপে এখন স্পেনে ফুটসাল খেলেন। আর আর্জেন্টিনায় খুব কম মানুষ তাঁদের নারী জাতীয় ফুটবল দলের ঐতিহ্য সমন্ধে জানেন।
আর্জেন্টিনায় মেয়েদের প্রথম ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে ১০০ বছর আগে। ১৯৭১ সালে মেক্সিকোয় আয়োজিত অনানুষ্ঠানিক বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে মেয়েদের দল। ১৫ বছর পর সেই মেক্সিকোতেই বিশ্বকাপ জিতেছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা।
মেক্সিকোয় গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪–১ গোলের সেই জয়ে একাই ৪ গোল করেছিলেন এলবা সেলভা। ৭৫ বছর বয়সী সেলভা এএফপিকে বলেছেন, ‘মেক্সিকোয় আমরা উৎসব করেছিলাম। কিন্তু দেশে ফেরার পর কারও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এমনকি কেউ আমাদের চিনতও না।’
ফিফা নারী বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে ১৯৯১ সাল থেকে। তার পর থেকে এ পর্যন্ত তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছে আর্জেন্টিনা নারী দল—২০০৩, ২০০৭ ও ২০১৯।
বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা নারী দল এখনো একটি ম্যাচও জিততে পারেনি। গ্রুপ পর্ব পাড়ি দিতে পারেনি কখনো, সে কথা না বললেও চলে। তবে ২০০৬ সালে ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকা জিতেছিল আর্জেন্টিনা নারী দল। দেশটির মেয়েদের ফুটবল ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় সাফল্য।