ফ্রান্সের জার্সিতে জিনেদিন জিদানের শেষ ম্যাচটা মনে আছে? ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনাল। ইতালির বিপক্ষে ম্যাচের ৭ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করেছিলেন জিদান। এরপর অতিরিক্ত সময়ে মেজাজ হারিয়ে মার্কো মাতেরাজ্জিকে ঢুস মেরে দেখলেন লাল কার্ড।
মাঠে ট্রফির পাশ দিয়ে জিদানের মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়া বিশ্বকাপের ইতিহাসেই সবচেয়ে বিষাদময় মুহূর্তগুলোর একটি। ব্রাজিলের জালে কাল গোল করে জিদানের সেই ম্যাচকেই মনে করিয়ে দিয়েছেন ক্যামেরুন স্ট্রাইকার ভিনসেন্ট আবুবকর।
না, ফাইনাল দূর অস্ত, কাল গ্রুপ পর্বে শেষ ম্যাচে ক্যামেরুনের কাছে হেরেছে ব্রাজিল। আর জিদান সে ফাইনালে গোল করলেও টাইব্রেকারে ইতালির কাছে হেরেছিল ফ্রান্স। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, জিদানের ১৬ বছর আগের সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ তুলে ভিনসেন্ট আবুবকরকে টেনে আনার কী কারণ?
মিলটা হলো, বিশ্বকাপে জিদানের পর আবুবকরই প্রথম খেলোয়াড়, যিনি একই ম্যাচে গোল করার সঙ্গে লাল কার্ডও দেখলেন। পার্থক্যটা হলো, জিদানের দল সেদিন হারলেও আবুবকরের দল জিতেছে। যদিও শেষ পর্যন্ত জিদানের মতো দুঃখই সঙ্গী হয়েছে আবুবকরের। ক্যামেরুন যে শেষ ষোলোয় উঠতে পারেনি।
তাতে কী! বিশ্বকাপে ব্রাজিল সব সময়ই আফ্রিকার দেশগুলোকে হারিয়ে এসেছে। লুসাইল স্টেডিয়ামে কাল আবুবকরের জয়সূচক গোলটি তাই আফ্রিকার দেশগুলোর পক্ষ থেকে ব্রাজিলকে দেওয়া একরকম বার্তাও। একে তো প্রতিপক্ষ ব্রাজিল, বিশ্বকাপে আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে ব্রাজিলের বিপক্ষে জয়, আর বিশ্বকাপে ২০ বছর পর ক্যামেরুনকেও প্রথম জয় এনে দেওয়া—৯২ মিনিটে হেডে গোল করে এসব আনন্দের আতিশয্যেই সম্ভবত জার্সি খুলে ফেলেছিলেন আবুবকর।
সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরের এই স্ট্রাইকার জানতেন, জার্সি খুললেই দেখতে হবে দ্বিতীয় হলুদ কার্ড। অর্থাৎ, লাল কার্ড দেখে ছাড়তে হবে মাঠ। কিন্তু দলের নামই যেখানে ‘অদম্য সিংহ’ সেখানে সেই দলেরই এই অদম্য স্ট্রাইকারও নিয়মের তোয়াক্কা করেননি। মনের অদম্য ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিয়েই জার্সি খুলে লাল কার্ড দেখেন।
তবে লাল কার্ড দেখার মুহূর্তটিও আবুবকর সম্ভবত কখনো ভুলতে পারবেন না। মরক্কোন বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের রেফারি ইসমাইল এলফাতাহ এগিয়ে এসে সবার আগে আবুবকরের সঙ্গে হাত মেলান। এরপর তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে পকেট থেকে প্রথমে হলুদ কার্ড তারপর লাল কার্ড বের করেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে মিষ্টি-মধুর লাল কার্ড কি না? আবু্বকরের হাসতে হাসতে মাঠ ছাড়া দেখে কিন্তু বুঝে নেওয়া যায়, এমন কিছু বলা হলে তাঁর অন্তত আপত্তি থাকবে না!
২০১০ সালে ক্যামেরুনের জার্সিতে অভিষিক্ত আবুবকর পোর্তো ও বেসিকতাসের হয়ে পর্তুগাল ও তুরস্কে লিগ জিতেছেন। ২০১৭ সালে দেশের হয়ে জিতেছেন আফ্রিকান কাপ অব নেশনস। বিশ্বকাপে সার্বিয়ার বিপক্ষে ক্যামেরুনের ৩-৩ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচটি নিশ্চয়ই মনে আছে? ৫৫ মিনিটে আবুবকর বদলি হিসেবে মাঠে নেমে গোল করানোর পাশাপাশি নিজেও গোল করেছিলেন। তখনই ইতিহাসে নাম লেখান—১৯৬৬ সালের পর বিশ্বকাপে এক ম্যাচে গোল করা ও গোল বানানো আফ্রিকার প্রথম খেলোয়াড়।
ফিনিশে ভালো দক্ষতা থাকায় ব্রাজিলের বিপক্ষে তাই আবুবকরকে আর বসিয়ে রাখেননি ক্যামেরুন কোচ রিগোবার্ট সং। ফলও পেলেন হাতেনাতে।
মজার বিষয়, গত সেপ্টেম্বরে এই আবুবকরই কিন্তু বলেছিলেন, ব্রাজিলকে ক্যামেরুন ভয় পায় না, ‘আমরা কঠিন গ্রুপে পড়েছি। তবে আমরা ব্রাজিলকে নিয়ে ভীত নই। অতীতে আমরা ব্রাজিলকে যেভাবে দেখেছি, এই দলটা তেমন নয়।’
কাল মাঠেই তা প্রমাণ করে দিল ক্যামেরুন। আর আবুবকরও নিজের ফিনিশিং দক্ষতা দেখিয়ে অতীতে তাঁর একটি বিতর্কিত মন্তব্য মনে করিয়ে দিলেন, ‘সালাহ এমন কোনো খেলোয়াড় নয় যে আমাকে প্রভাবিত করে। সে যা পারে, আমিও তা–ই পারি। আমার শুধু তার মতো বড় ক্লাবগুলোয় খেলার সুযোগ নেই।’
২০১৪ বিশ্বকাপেও খেলেছেন আবুবকর। তিন বছর পর কাপ অব নেশনস ফাইনালে তাঁর কাছ থেকেই জয়সূচক গোল পেয়েছিল ক্যামেরুন। এ বছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নেশনস কাপে ক্যামেরুন সেমিফাইনাল থেকে ছিটকে পড়লেও সর্বোচ্চ ৮ গোল করেছিলেন আবুবকর। ক্যামেরুনের হয়ে ৯১ ম্যাচে ৩৫ গোল করা ৩০ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের আক্ষেপটা কি ইউরোপের বড় কোনো ক্লাব পর্যন্ত পৌঁছাবে—‘আমার শুধু...বড় ক্লাবগুলোয় খেলার সুযোগ নেই।’