পোল্যান্ড দলের কোচ সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎস
পোল্যান্ড দলের কোচ সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎস

কাতার থেকে উৎপল শুভ্র

তাহলে তো তিউনিসিয়া বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন!

সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎস খুব মজার মানুষ। মাত্র দুটি সংবাদ সম্মেলনের ভিত্তিতে কারও সম্পর্কে এমন মন্তব্য করে ফেলাটা হয়তো ঠিক নয়। একটা মানুষের চরিত্র বোঝার জন্য এটা যথেষ্ট নাকি!

মিখনিয়েভিৎসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বলেই মনে হচ্ছে। যে লোক বিশ্বকাপ ফুটবলে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে এসে এমন নির্ভার থাকতে পারেন, রসিকতা করতে পারেন; তাঁকে ‌‘মজার মানুষ’ বলায় খুব একটা ঝুঁকি আছে বলে মনে হয় না।
উচ্চতায় ৬ ফুট ২ ইঞ্চি, প্রস্থও খারাপ নয়—দুটি মিলিয়ে বিশালদেহী বলতে যা বোঝায়, তা-ই। কথা বলার ভঙ্গিটাও খুব মজার।

আচ্ছা, সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎসকে চিনেছেন তো? নাকি পরিচয়টা আবার দিয়ে নেব! ৫২ বছর বয়সী এই ভদ্রলোক পোল্যান্ড দলের কোচ। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে যাঁকে সামনাসামনি প্রথম দেখেছিলাম। দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচের আগে আজ আরেকবার। সেই সংবাদ সম্মেলনেই।

আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার লড়াই। একটু এদিক-ওদিক হলেই ছিটকে পড়ার ভয়। ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচটা তো সরাসরিই নকআউট। দুটিই অসম্ভব চাপের ম্যাচ। সংবাদ সম্মেলনের সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎসকে দেখে অবশ্য তা বোঝার কোনো উপায় থাকল না।

কথা বলেন গল্পের ঢঙে। উপমার ব্যবহারও থাকে। আর্জেন্টিনার সঙ্গে ম্যাচের আগের দিন যেমন মেসি সম্পর্কে বলতে গিয়ে টেনে এনেছিলেন আলবার্তো তোম্বাকে। তোম্বা ইতালির বিখ্যাত স্কিয়ার। মেসির সঙ্গে তাঁর মিলটা কোথায়? দারুণ কল্পনাশক্তি না থাকলে সেই মিলটা চোখে পড়া কঠিন। মিখনিয়েভিৎসের তা আছে বলেই বলতে পারলেন, ‌‘তোম্বা যেমন বরফের মধ্যে সবাইকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়, মেসিও ফুটবল মাঠে তেমন করে।‌’

ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচের আগের সংবাদ সম্মেলনেও একই রকম সপ্রতিভ। ফ্রান্স দলের কোনো দুর্বলতা চোখে পড়েছে কি না—এই প্রশ্নের জবাব অন্য কোনো কোচ হলে হয়তো এড়িয়ে যেতেন। বা বলতেন, পড়েছে, কিন্তু আপনাদের তা বলব না। মিখনিয়েভিৎস যেখানে বললেন, ‘না, আমার চোখে ওদের কোনো দুর্বলতাই চোখে পড়েনি।‌’ তিউনিসিয়ার বিপক্ষে যে ম্যাচে ফ্রান্স হেরে গেছে, সেই ম্যাচ কি দেখেছেন? মিখনিয়েভিৎস হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন,‌‘আমি দেখেছি। তবে ওই ম্যাচের ভিডিও আমি আমার দলকে দেখাব না।‌’ দেখাবেন না, কারণ ওই ম্যাচের দলটা ঠিক ফ্রান্সের ‌‌‘আসল’ দল নয়।

ফ্রান্সের বিপক্ষে নামার আগে অনুশীলনে রবার্ট লেভানডভস্কিরা

আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে রোমাঞ্চিত ছিলেন, ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়েও তা-ই। এখানে কারণটা অবশ্য আরও প্রত্যক্ষ, ‌‘ফ্রান্স বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তার মানে ওদের হারাতে পারলে আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাব।‌’

পরের প্রশ্নটাই করলেন এক তিউনিসিয়ার সাংবাদিক। তিউনিসিয়া তো ফ্রান্সকে হারিয়েছে। তাহলে তিউনিসিয়া কি নিজেদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বলতে পারে? মিখনিয়েভিৎস একটুও বিব্রত না হয়ে বললেন, ‌‘অভিনন্দন! অন্তত এক দিনের জন্য তোমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।‌’

পরের প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে একটা গল্পও শুনিয়ে দিলেন মিখনিয়েভিৎস। পোল্যান্ড যে গ্রুপ থেকে পরের রাউন্ডে উঠেছে, সেই গ্রুপ থেকেই বাদ পড়ে গেছে মেক্সিকো। পোল্যান্ডের চেয়ে মেক্সিকোই ভালো ফুটবল খেলেছে বলে বলছেন অনেকেই, পরিসংখ্যানও তা-ই বলে; এ নিয়ে কি কিছু বলবেন?

মিখনিয়েভিৎস একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি শুধু হাসব’। শুধু হাসিতেই অবশ্য উত্তরটা শেষ হলো না। মেক্সিকোর সঙ্গে পোল্যান্ডের ম্যাচটা গোলশূন্য ছিল, পোল্যান্ড পেনাল্টি পেয়েছিল—এসব মনে করিয়ে দেওয়ার পর বললেন, ‌‘থাক, অতীতে গিয়ে লাভ নেই। আমি বরং আপনাদের ছোট্ট একটা গল্প বলি। গল্পটা পরিসংখ্যানপ্রেমীদের জন্য। কোচদের একটা সেমিনারে একজন বিখ্যাত কোচ গল্পটা বলেছিলেন। এক প্রতিবেশী এসে তাঁর কাছে সাহায্য চাইলেন। তিনি গাড়ির চাবি হারিয়ে ফেলেছেন। গাড়িটা একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে পার্ক করা। চাবিটা কোথায় হারিয়েছে, তা কি মনে করতে পারেন? গাড়ির মালিক বললেন, ‌“হ্যাঁ, এখান থেকে ২০ ফুট দূরে‌।‌” তাহলে এখানে খুঁজছ কেন? “ওখানে অন্ধকার। আলো আছে বলে এখানে খুঁজছি।”‌’

এরপর গল্পের মর্মার্থটাও বুঝিয়ে বললেন মিখনিয়েভিৎস। ভুল জায়গায় কিছু খুঁজে লাভ নেই। ফুটবলে একটা পরিসংখ্যানই গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো ম্যাচ শেষের স্কোরবোর্ড আর পয়েন্ট টেবিল, বাকি সব অর্থহীন।

এটা বুঝতে অবশ্য সেসওয়াফ মিখনিয়েভিৎসের পোল্যান্ডকে দেখাই যথেষ্ট।