একই মাঠ, ফাইনালে একই প্রতিপক্ষ, আবার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ
একই মাঠ, ফাইনালে একই প্রতিপক্ষ, আবার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ

কেমন যেন রূপকথা রূপকথা লাগে

বাংলাদেশের প্রথম গোলটা দেখেছি পরে। আগে শুনেছি। গোল আবার শোনে কীভাবে? সেটাই তো কথা। মনিকা চাকমা যখন বাংলাদেশকে এগিয়ে দিলেন, এর একটু আগেই দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে এসেছি।

বাংলাদেশ গোল করেছে, তা বুঝতে অবশ্য কোনো সমস্যা হয়নি রঙ্গশালার গর্জনশীল গ্যালারি হঠাৎই নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়ায়। স্টেডিয়ামের বাইরেও হাজার ডেসিবেলের শব্দ উধাও হয়ে গিয়ে ভুতুড়ে এক নিস্তব্ধতা। একটু পরই যা আবার গর্জে উঠল।

প্রথম আলোর লাইভ কমেন্ট্রিতে ঢুকে নিশ্চিত হলাম, যা ভেবেছিলাম, তা-ই হয়েছে। বাংলাদেশ গোল করেছিল, নেপাল তা শোধ করে দিয়েছে। ঋতুপর্ণা গোলেই মেরেছিলেন, না ক্রস করতে চেয়েছিলেন—মধুর এই তর্ক জাগিয়ে তোলা বাংলাদেশের জয়সূচক গোলটি অবশ্য সরাসরিই দেখেছি। সরাসরি মানে মাঠে বসে নয়। আপনাদের অনেকেই যেমন দেখেছেন, আমিও তেমনি তা দেখেছি টেলিভিশনে। সেটিও কোথায়, জানেন? মাঠ থেকে গাড়িতে মিনিট দশেকের দূরত্বের কাঠমান্ডুর হৃৎপিণ্ড থামেলের এক রেস্টুরেন্ট কাম বারে বসে।

রহস্য একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। এবার মনে হয় ঘটনাটা খুলে বলা উচিত। কাল মধ্যরাতে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে আজ দুপুরে কাঠমান্ডুতে এসে দেখি, সাফ নারী ফুটবল ফাইনালের টিকিটের চেয়ে দুর্লভ কিছু এই বিশ্বে নেই।

আজ দশরথ রঙ্গশালার গ্যালারিতে তিল ধারণেরও ঠাঁই ছিল না

কাঠমান্ডুর সবাই এই রাতে দশরথ রঙ্গশালার গ্যালারিতে থাকতে চায়। ত্রিভুবন বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন অফিসার থেকে শুরু করে হোটেলের তরুণী রিসেপশনিস্ট, প্রগলভ ট্যুর অপারেটর থেকে শুরু করে তোতলা ট্যাক্সি ড্রাইভার—সবাই বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই নিঃসংশয় মুখে বলে দিচ্ছেন, ‘ওহ্, বুঝেছি। নেপাল-বাংলাদেশ ফাইনাল দেখতে এসেছেন।’ সঙ্গে সেই ফাইনালের একটা টিকিট দেওয়ার কাতর অনুরোধ, যা শুনে আমি হাসছি।

প্রথম আলো থেকে এই টুর্নামেন্ট কাভার করতে আসা মাসুদ আলমের মতো বাফুফের মিডিয়া ম্যানেজারও যে কাঠমান্ডুতে নামার একটু পরই জানিয়েছেন, ফাইনালে টিকিট কেমন বাঘের দুধের রূপ নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত একটা টিকিট হাতে এল, সেটিও আবার ভিআইপি গ্যালারির টিকিট।

কিন্তু নামেই ভিআইপি! সেই টিকিটের কোনো মূল্য থাকলে তো! নেপাল পুলিশের সঙ্গে প্রায় ধাক্কাধাক্কি করে মাঠে ঢুকেছি বটে, কিন্তু ঢুকে লাভ কী! বসার জায়গা দূরে থাক, দাঁড়িয়ে যে খেলা দেখব, সেই উপায়ও নেই।

গায়ে গায়ে লেগে থাকা দর্শকে দশরথ রঙ্গশালার গ্যালারি আক্ষরিক অর্থেই জনসমুদ্র। স্টেডিয়ামে ঢোকার আগেই যা বাইরে দেখে এসেছি। গেটের ফাঁক দিয়ে মাঠে উঁকি দিচ্ছেন দর্শক, গ্রিল ধরে প্রায় ঝুলে থেকে অনেকে একটু সাক্ষী হয়ে থাকতে চাইছেন এই ফাইনালের। সেটিও পারছেন না একটু পরপরই লাঠিকে কার্যকর করে পুলিশ এসে তাঁদের সরিয়ে দেওয়ায়।

গ্যালারির গ্রিল ধরে প্রায় ঝুলে থেকে খেলা দেখার চেষ্টা নেপালের ফুটবলপ্রেমীদের

ফুটবলকে সরিয়ে দিয়ে ক্রিকেট নেপালের এক নম্বর খেলা হয়ে গেছে শুনেছিলাম। কাল রাতের দশরথ রঙ্গশালার রঙ্গ দেখার পর আর তা বিশ্বাস করতে মন চাইছে না। ফুটবল নিয়ে এমন উন্মাদনা অনেক দিন দেখিনি। যা দেখে বাংলাদেশের ফুটবলে আবাহনী-মোহামেডান নিয়ে উন্মাদনার সেই দিনগুলো মনে করে রীতিমতো নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত।

মাঠে তো ঢুকলাম, কিন্তু ঢুকে কোনো লাভ হলো না। তথাকথিত ভিআইপি গ্যালারির আসনগুলোর সামনে যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার সামনে সারি সারি মাথা। মাঠের অর্ধেকটা তো এমনিতেই আড়াল, বাকি অর্ধেকে চোখ রাখতেও রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করতে হচ্ছে। সারা জীবন প্রেসবক্সে আরাম করে বসে খেলা দেখার অভ্যাস, এটা আর কতক্ষণ নেওয়া যায়! নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একটা সময় তাই স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত।

বিশ্বাস করবেন কি না, সেই বেরিয়ে আসতেও রীতিমতো সংগ্রাম করতে হলো। কাউকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য গেট খোলা মানেই যে কারও ঢুকে যাওয়ার সুযোগ! নেপাল পুলিশ তাই গেটগুলো বলতে গেলে সিলগালা করে রেখেছে। অনেক অনুরোধ করে যা খোলানো গেল।

স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে থামেল চলে এসে টেলিভিশনে দেখলাম বাংলাদেশের অদম্য মেয়েদের জয়োৎসব। অদম্য শব্দটার এর চেয়ে ভালো ব্যবহার আর হয় না। এই দলের প্রত্যেক মেয়েরই তো চমকে দেওয়ার মতো গল্প আছে। যার কিছু চোখ ভিজিয়ে দেওয়ার মতোও।

মাঠের লড়াইয়ে নামার আগেই যাদের জিততে হয়েছে মাঠের বাইরের অনেক লড়াইয়েও। অনেক ত্যাগ, অনেক ঘাম, হয়তো অনেক রক্তের বিনিময়ে তাদের এই সাফল্য। টানা দুবার সাফের শিরোপা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের পরাশক্তি হয়ে ওঠা।

২০২২ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলকে ছাদখোলা বাসে করে বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এবারও তেমন কিছু হতে চলেছে

গতবার সাফ জয়ের পর বাংলাদেশ পরিণত হয়েছিল উৎসবের দেশে। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়ের পর খেলা নিয়ে এমন সর্বজনীন উৎসব বাংলাদেশ আর দেখেনি। এবারের সাফল্য তো এর চেয়েও বড়। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের চেয়ে তা ধরে রাখা কঠিন, এটা মনে রাখলেই তো এই কথার যথার্থতা প্রমাণিত হয়ে যায়।

এবার আরও কত অনুষঙ্গই না যোগ হয়েছে এর সঙ্গে! টুর্নামেন্টের মাঝপথে তুমুল বিতর্ক ছেয়ে ফেলেছে দলকে। বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাওয়া গোলাম রব্বানীর ছায়া পড়েছে দলে। একটা দলের জন্য চরমতম নো-নো সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের আভাস মিলেছে। কোচ পিটার বাটলার ড্রেসিংরুমের কাছে অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েছেন কি না, এমন প্রশ্নও জেগেছে। সেসব জয় করে এই সাফল্য বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসেই অনন্য একটা জায়গার দাবিদার।

টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার হাতে ঋতুপর্ণা চাকমা

কেমন আশ্চর্য দেখুন, কোচ সিনিয়রদের প্রতি বৈষম্য করছেন—এমন গুরুতর অভিযোগ প্রথম তোলা মনিকা চাকমাই করলেন ফাইনালের প্রথম গোলটা। গতবার সাফ জয়ের পর ছাদখোলা বাসে বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবনে যাওয়ার পথে ল্যাম্পপোস্টে মাথায় আঘাত পেয়ে হাসপাতালে যাওয়া ঋতুপর্ণার পা থেকে অবিস্মরণীয় ওই গোল—না, কেমন যেন রূপকথা রূপকথা লাগে!

বাংলাদেশের মেয়েদের এই অর্জন বর্ণনা করতে গিয়ে ভাষা খুঁজে না পাওয়ার মতো ক্লিশেও ব্যবহার করতে হচ্ছে। আবার এর মধ্যেও সাতটি সাফ ফাইনালের ছয়টিরই ফাইনালে ওঠা নেপালের আবারও শূন্য হাতে ফেরা কি একটু কষ্টও জাগায় না মনে!