‘অধরে প্রাণের মলিন ছায়া,/ চোখের জলে মলিন চাঁদের আলো/ যাবার বেলা দুটি কথা ব’লে/ বনপথ দিয়ে সে চলে গেল।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিদায়’ কবিতার এই লাইনগুলোই যেন কাতারে মরুর বুকে ফিরে আসছে বারবার। একেকটি ম্যাচ তৈরি করছে বিষাদগ্রস্ত বিদায়ের মঞ্চ। সবকিছু শেষ করে দিয়েই চোখের জলে ভাসতে ভাসতে নিভে যাচ্ছে নক্ষত্রের আলো। এই নক্ষত্ররা আর কখনো জ্বলবেন না ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এ। আর কখনো বহু যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত সেসব পা রং ছড়াবে না বিশ্বকাপের সবুজ উদ্যানে। ফুটবলের এই বাটে আর পড়বে না কিংবদন্তিদের পায়ের চিহ্ন।
বিশ্বকাপ মানে এমনিতেই সন্ধ্যাবেলা খেলা ভাঙার, মেলা ভাঙার গান। দিন শেষে শুধু একটি দল ট্রফি উঁচিয়ে উৎসবের গান গাইতে গাইতে ফিরে যায় বাড়ি। এটা যে বহু আরাধ্যের এক ট্রফি! প্রত্যেক ফুটবলারের আজন্মলালিত স্বপ্ন। তবে বিজয়ীর উৎসবের উল্টো পিঠে হেরে যাওয়াদের ফেরার গল্পটাতে মিশে থাকে বিষাদ-কান্না।
তবু আগের চেয়ে এবারের বিদায়গুলো একটু কি ভিন্ন নয়! প্রায় দুই দশক ধরে যে নামগুলো ফুটবলের রঙ্গমঞ্চে আলো হয়ে ঝলঝল করছিলেন, ফুটবলপ্রেমীদের অপার আনন্দের কারণ হয়ে ছিলেন, তাঁরাই কান্নায় ভেসে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছেন পর্দার আড়ালে। আর কখনো যাঁদের ফেরা হবে না এই মঞ্চে।
যেকোনো মূল্যে বিশ্বকাপটা জিততে চেয়েছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। পর্তুগিজদের যে স্বপ্ন ইউসেবিও-লুইস ফিগোতে পূরণ হয়নি, সেই অধরা স্বপ্নকে ছুঁতে চেয়েছিলেন রোনালদো। কিন্তু আল থুমামা স্টেডিয়ামে শেষ বাঁশি বাজতেই সব শেষ হয়ে গেল।
যুদ্ধে হারা রাজার মতো টানেল ধরে চলে গেলেন কাঁদতে কাঁদতে। পরে নিজেই বলেছেন, ‘স্বপ্নটা শেষ হয়ে গেল।’ ক্যারিয়ারে অর্জন তো আর কম নয়, তবে কে জানে হয়তো এই ট্রফিটির বিনিময়ে বাকি সবকিছু ফিরিয়ে দিতেও তিনি রাজি হয়ে যেতেন। কিন্তু হলো না তো! বরং কিংবদন্তির কান্নায় ডিসেম্বরের শীতকালীন স্নিগ্ধ হাওয়াটা ভারীই হলো শুধু।
রোনালদোর অশ্রুসিক্ত বিদায়ের ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগে মঞ্চস্থ হয়েছিল আরেকটি কান্না-উপাখ্যান। ফেবারিট ব্রাজিলের বিদায়ে নেইমারের সঙ্গে কেঁদেছেন কোটি ব্রাজিল-ভক্ত। সেদিন নেইমারকে সান্ত্বনা দিতে আসতে হয়েছিল ক্রোয়াট তারকা ইভান পেরিসিচের ছেলেকেও।
বয়স আরেকটি বিশ্বকাপের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখলেও বিদায়ের ইঙ্গিত নেইমার নিজেই দিয়ে রেখেছেন। হয়তো ২০২৬ বিশ্বকাপে ৩৪ পেরোনো নেইমারের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না তিনি নিজেই।
এবার ২ ডিসেম্বর আল জানুব স্টেডিয়ামের ম্যাচটিতে ফিরে যাওয়া যাক। ঘানার বিপক্ষে খেলাটি তখনো শেষ হয়নি, অথচ ডাগআউটে বসে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন লুইস সুয়ারেজ। সেদিন তাঁর সঙ্গে কে কাঁদেনি!
গ্রুপ পর্বেই যে শেষ হয়ে গেল উরুগুয়ের এই মহাতারকার বিশ্বকাপ-স্বপ্ন। ২০১০ বিশ্বকাপে যে ঘানার বিপক্ষে হ্যান্ডবলে গোল বাঁচিয়ে আলোড়ন তুলেছিলেন, সেই ঘানার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই বৃত্তপূরণ করে বিদায় নিয়ে নিলেন সুয়ারেজ।
একইভাবে গ্রুপ পর্বেই শেষ হয়েছে বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের যাত্রাও। যে প্রজন্ম বেলজিয়ানদের স্বপ্ন দেখিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, শূন্য হাতে বিতর্কের কাদা মেখে বিদায় নিল তারা।
শেষ ষোলোতে বিশ্বকাপ-স্বপ্নকে কবর দিতে হয়েছে রবার্ট লেভানডফস্কিকেও। পোল্যান্ড হয়তো কখনো ফেবারিট ছিল না, তবু মনের কোণে অসম্ভব কিছু করার স্বপ্ন নিশ্চয় দেখেছেন লেভা, যা আর হয়তো কখনোই দেখবেন না।
বিদায়ের এ গল্পটি এখনো শেষ হয়নি। আজও নিভে যাবেন কোনো একটি নক্ষত্র—লিওনেল মেসি কিংবা লুকা মদরিচ। আর বিদায় মানেই বিশ্বকাপের গল্পটা এখানেই শেষ। এমনকি তাঁদের কেউ যদি শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জেতেনও, সেখানেও উৎসবের গানের সঙ্গে বাজবে বিদায়ের বিউগলও। আর যে এই মঞ্চে ফেরা হবে না।
শেষ মানে অবশ্য নতুন শুরুও। কবি উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন, ‘সূর্য ডোবা শেষ হল কেননা সূর্যের যাত্রা বহুদূর।’ আসলেই তাই নয় কি? নক্ষত্র যে মরেও মরে না। যারা আজ ডাগআউটে, সবুজ কার্পেটে কিংবা বোবা টানেল ধরে কাঁদতে কাঁদতে চলে যাচ্ছেন, তাঁরা চলে গিয়েও যাচ্ছেন না। তাঁরা রয়ে যাবেন ফুটবল রোমান্টিকদের ভালোবাসায়। শাশ্বত এক গান হয়ে।
ফুটবল নামক খেলাটির সঙ্গে জড়িয়ে তাঁরাও যে হয়ে গেলেন অবিনশ্বর।