এ যেন নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজন প্রাইমের কোনো জমজমাট থ্রিলার সিরিজ। প্রতিবছর দলবদলের সময় যার নতুন একটা সিজন মুক্তি পায়। সেখানে নাটকীয়তা, রোমাঞ্চ—কিছুরই কমতি থাকে না। কিলিয়ান এমবাপ্পের দলবদল-আখ্যান এতই আলোচিত।
এবার সেই দলবদল-আখ্যানে যা হচ্ছে, সেটা প্রায় ‘সিজন ফিনালে’র উত্তেজনার কাছাকাছি।
সর্বশেষ রয়টার্স খবর দিয়েছে, প্রাক্-মৌসুম এশিয়ায় সফরের দল থেকে এমবাপ্পেকে বাদ দিয়েছে পিএসজি। তাঁর নামের পাশে ‘বিক্রি করা হবে’ ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই এমবাপ্পেকেই ধরে রাখতে গত মৌসুমে কিনা করেছে পিএসজি! তারপর বিশাল অঙ্কের প্রস্তাব দিয়ে তাঁকে দুই বছরের জন্য প্যারিসে থাকতে রাজি করিয়েছে ওরা, বানিয়েছে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাবান খেলোয়াড়দের একজন। এক বছরের মধ্যেই পরিস্থিতি একেবারে উল্টে গেছে। এখন পিএসজি চায়, যেভাবেই হোক এমবাপ্পেকে বিক্রি করে দিতে।
সম্পর্কটা কেন এমন বিষাক্ত হয়ে গেল, সেটা বোঝার জন্য আসলে পেছনের ঘটনা একটু ভালোভাবে জানা দরকার। ২০১৭ সালে মোনাকো থেকে ধারে পিএসজিতে যোগ দেন এমবাপ্পে। পরের বছর তাঁর সঙ্গে পাকাপাকি চুক্তি করে পিএসজি, ট্রান্সফার ফি ধরা হয় ১৮ কোটি ইউরো। দলবদলের ইতিহাসে নেইমারের পর এখনো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড় এমবাপ্পে। তখন থেকেই প্যারিস তাঁর ঘর, ঠিকানা। কিন্তু এমবাপ্পের স্বপ্নটা ছিল আরও বড়। একদিন তিনি রিয়াল মাদ্রিদে খেলবেন—এই স্বপ্ন নিয়েই বেড়ে উঠেছেন ফরাসি ফরোয়ার্ড।
রিয়াল মাদ্রিদও এমবাপ্পের প্রতি আগ্রহী ছিল বলতে গেলে শুরু থেকেই। তবে প্যারিস থেকে তাঁকে মাদ্রিদে নিয়ে যাওয়াটা যে মোটেই সহজ নয়, সেটা রিয়াল মাদ্রিদ বারবার টের পেয়েছে। তিন-চার বছর ধরে বলতে গেলে প্রতি দলবদলের মৌসুমেই রিয়াল এমবাপ্পেকে কেনার চেষ্টা করেছে, নানারকম প্রস্তাব পাঠিয়েছে এবং প্রতিবারই পিএসজি সেসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে বেশ নির্দয়ভাবে। গত বছর মে মাসে তো জোর গুঞ্জনই ছিল, এমবাপ্পে রিয়াল মাদ্রিদে চলে যাবেন।
কিন্তু পিএসজি সেটাও রুখে দেয় তাদের পেট্রোডলারের দাপটে। এমবাপ্পের সঙ্গে তারা ২০২৪ পর্যন্ত চুক্তি নবায়ন করে, যে চুক্তিতে ফরাসি ফরোয়ার্ডের মাসিক বেতর ধরা হয় প্রায় ৬ লাখ ইউরো। ২০২৪ পর্যন্ত মেয়াদ পূর্ণ করলে আনুগত্য বোনাস হিসেবে আরও ৩০ কোটি ইউরো পাবেন এমবাপ্পে, এমন শর্তও রাখা হয় চুক্তিতে। সঙ্গে তাঁর ইচ্ছেমতো খেলোয়াড় কেনা, কোচ নিয়োগে তাঁর মতামত নেওয়ার মতো শর্ত মেনে নেয় পিএসজি। ফলে এমবাপ্পে শুধু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বেতনের ফুটবলারই হননি, এক অর্থে হয়ে ওঠেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ফুটবলারও।
কিন্তু এত কিছু পেয়েও আসলে মন ভরেনি এমবাপ্পের। কারণ, হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছেন, পিএসজির যতই টাকা থাকুক, তারা এখনো ইউরোপের অভিজাত ক্লাব হয়ে উঠতে পারেনি। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলের সর্বোচ্চ যে শিরোপা, সেই চ্যাম্পিয়নস লিগও হয়তো সেখানে থেকে জেতা হবে না তাঁর। মেসি-নেইমার-রামোসদের মতো সতীর্থ পেয়েও যেহেতু জিততে পারেননি, আর কবে পারবেন, এই হতাশা চলে আসে তাঁর মধ্যে। এদিকে আবার সতীর্থদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত নানা ঝামেলা ও অহমের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। সব মিলিয়ে পিএসজিতে অসুখী হয়ে পড়েন এমবাপ্পে। আর এ রকম অসুখী হয়ে পড়লে বেতন যতই হোক, ক্লাবে মন টেকে নাকি!
পিএসজির সঙ্গে এমবাপ্পের চুক্তিটা ২০২৪ সাল পর্যন্ত হলেও সেখানে আরও দুটি শর্ত আছে। দুই পক্ষের সম্মতিতে সেটা আরও এক বছরের জন্য বাড়ানো যাবে। যদি এমবাপ্পে সেই চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে না চান, তা হলে এক বছর আগেই জানিয়ে দিতে হবে। তার মানে, ২০২৪ সালের ৩০ জুনের পর যদি এমবাপ্পে পিএসজিতে থাকতে না চান, তা হলে তাঁকে এই বছর জুনের মধ্যেই সেটা পিএসজিকে জানিয়ে দেওয়ার কথা।
এমবাপ্পে সেই নিয়ম মেনেছেন।
তিনি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তিন পাতার এক চিঠি লিখে পিএসজিকে জানিয়ে দিয়েছেন যে ২০২৪ সালের জুনের পর আর পিএসজিতে থাকবেন না। এমবাপ্পের এই চিঠির কথা অজানা থাকেনি ফুটবল বিশ্বে। এমনিতে রিয়াল মাদ্রিদ প্রতি মৌসুমেই এমবাপ্পের জন্য পিএসজির সঙ্গে দরদাম করলেও এবার এটা নিয়ে খুব একটা কথা বলছে না। কারণ, আগামী বছর জুনের পরই ‘ফ্রি এজেন্ট’ বা মুক্ত খেলোয়াড় হয়ে যাবেন এমবাপ্পে। তখন যাকে বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে, এখন তাঁকে এত টাকা দিয়ে কেনার দরকার কী! এক বছর অপেক্ষা করলেই তো হয়! আর এমবাপ্পেও তো রিয়ালে যাওয়ার জন্যই মরিয়া।
যার জন্য পিএসজি এত কিছু করেছে, তিনি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কিছুটা বিপদে পড়ে পিএসজি। কারণ, এমবাপ্পের মতো একজন খেলোয়াড়, যার জন্য এত দিন দলবদলের বাজারে ১৫ থেকে ১৮ কোটি দাম উঠেছে, তাঁকে আগামী মৌসুমে বিনা মূল্যে ছেড়ে দিতে হবে, এটা পিএসজি মেনে নিতে পারছে না। পিএসজি আশা করেছিল, এমবাপ্পের জন্য ওরা যা করেছে, তাতে খুশি হয়ে তিনি ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করবেন।
পিএসজির ভেতরের লোকজন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেনও যে এমবাপ্পে নাকি তাঁদের কথা দিয়েছিলেন, তিনি বিনা মূল্যে ক্লাব ছেড়ে যাবেন না। তাঁকে বিক্রি করে যাতে ক্লাবের কিছুটা আয় হয়, সেই ব্যবস্থা করবেন। এখন এমবাপ্পের ক্লাব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে তাই পিএসজি বেশ ক্ষুব্ধ। তাঁরা তাই চাইছে এবারই এমবাপ্পেকে বিক্রি করে যতটা পারা যায় আয় করে নিতে।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। এমবাপ্পে না চাইলে এখন তাঁকে বিক্রি করা সম্ভব না। কোনো খেলোয়াড়কে বিক্রি করতে হলে আগে ওই খেলোয়াড়কে রাজি করাতে হয়। যদি তিনি রাজি না হন, তা হলে যে পর্যন্ত বর্তমান চুক্তির মেয়াদ আছে, সেটা পূরণ করতে হবে দুই পক্ষকেই। এমবাপ্পে এখন কেন বিক্রি হয়ে যেতে রাজি হবেন, যেখানে আগামী বছর পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ করলেই তিনি আনুগত্য বোনাস পাবেন ৩০ কোটি ইউরোর মতো, এই এক বছরে পাবেন মোটা অঙ্কের বেতনও।
বলা যায়, পিএসজি এখন এমবাপ্পের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছে। কিন্তু এমবাপ্পে যদি ক্লাবে শৃঙ্খলাজনিত কোনো নিয়ম না ভাঙেন, তাঁকে শাস্তি দেওয়ার কোনো উপায় নেই। উপায় নেই তাঁর বেতন বন্ধ রাখার কিংবা আনুগত্য বোনাস বাতিল করার। পিএসজির হাতে যেটুকু ক্ষমতা আছে, ওরা এখন সেটারই সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চাচ্ছে। আর সেটা হচ্ছে, এমবাপ্পেকে খেলতে না দেওয়া। প্রাক্-মৌসুম এশিয়া সফরের দল থেকে এমবাপ্পেকে বাদ দেওয়া আসলে সেটারই একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ। এটা আসলে এমবাপ্পের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি—হয় চুক্তি নবায়ন করো বা এই মৌসুমেই বিক্রি হয়ে যেতে রাজি হও। নইলে তোমাকে খেলানো হবে না, বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই হুমকি দিয়ে এমবাপ্পেকে কি টলানো যাবে? হ্যাঁ, ম্যাচ না খেললে এমবাপ্পের কিছুটা ক্ষতি তো হবেই। তিনি তো শুধু পিএসজির খেলোয়াড়ই নন, ফ্রান্স জাতীয় দলের অধিনায়কও। সামনের বছর ইউরো। যার বাছাইপর্ব এখন চলছে। ক্লাবের হয়ে খেলতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই জাতীয় দলের পারফরম্যান্সে সেটার প্রভাব পড়বে। ম্যাচ ফিটনেস সব সময় না থাকলে তিনি ফ্রান্সের হয়ে খেলার জন্য নিজেকে তৈরি করবেন কীভাবে!
কিন্তু গতকাল স্কাই স্পোর্টসের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আগামী মৌসুমে পিএসজি ছাড়তে এমবাপ্পে এতই মরিয়া যে সে জন্য যদি তাঁকে এই মৌসুম পুরোটা বেঞ্চেও বসে থাকতে হয়, তিনি রাজি। এই সিদ্ধান্তের কথা পিএসজিকে তিনি জানিয়েও দেবেন খুব শিগগির। মোট কথা, পিএসজির হুমকির জবাবে এমবাপ্পেও পাল্টা হুমকি দিতে যাচ্ছেন। যেহেতু কৌশলগত দিক থেকে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন ফরাসি ফরোয়ার্ড।
এখন শুধু দেখার অপেক্ষা, এই পাল্টাপাল্টি হুমকির মধ্যে কোন পক্ষ আগে নমনীয় হয় কিংবা শেষ পর্যন্ত জেতে কোন পক্ষ।