ইরানে চলছে সরকারবিরোধী আন্দোলন। সেটার ছাপ পড়েছে কাতার বিশ্বকাপেও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ইরানি সমর্থকদের হাতে ছিল ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ লেখা প্ল্যাকার্ড
ইরানে চলছে সরকারবিরোধী আন্দোলন। সেটার ছাপ পড়েছে কাতার বিশ্বকাপেও। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ইরানি সমর্থকদের হাতে ছিল ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ লেখা প্ল্যাকার্ড

প্রতিবাদের আগুনে বিশ্বকাপে বিশ্বও কাঁপে

খেলার মধ্যে রাজনীতি না মেশানোর পরামর্শ দেন সবাই। পরামর্শ তো মুখের কথা, কিন্তু বাস্তবতা কি তা–ই? ওয়াশিংটন পোস্ট–এর ভাষায়, এ দুই বিষয় শুরু থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। বলা হয়, খেলার মঞ্চ যত বড়, সেখানে রাজনৈতিক প্রতিবাদের প্রভাবও তত গভীর হয়। 

বিশ্বকাপ ফুটবলের চেয়ে বড় প্রতিযোগিতা খুব কমই আছে। এক অলিম্পিকেরই তুলনা হতে পারে এর সঙ্গে। খেলার বাইরে বিশ্বকাপ ফুটবল কিন্তু প্রতিবাদের মঞ্চও। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে যেমন নিজেদের মহাদেশ থেকে কোয়ালিফাই করার পরও এশিয়ান কোয়ালিফায়ারদের সঙ্গে খেলতে হবে—ফিফার এ নিয়মের প্রতিবাদে আফ্রিকার কোনো দেশই সেবার বিশ্বকাপে অংশ নেয়নি। ১৯৩০ বিশ্বকাপে ইউরোপের দলগুলো সেভাবে অংশ না নেওয়ার প্রতিবাদে পরের বিশ্বকাপ বর্জন করেছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে। ১৯৩৮ বিশ্বকাপে বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট শাসনের প্রতিবাদে কালো জার্সি পরে মাঠে নেমেছিলেন ইতালির খেলোয়াড়েরাই। সামরিক কায়দায় খেলোয়াড়েরা স্যালুট দিতেন গ্যালারির দর্শকদের। কিংবা ২০০৬ বিশ্বকাপে ‘নুরেমবার্গ প্রতিবাদ’—ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বিশ্বকাপের আগে বলেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘হলোকাস্ট’ (ইহুদিদের ওপর অত্যাচার) বুজরুকি। এর প্রতিবাদে বিশ্বকাপে ইরানের প্রথম ম্যাচের আগে নুরেমবার্গের রাস্তায় প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিলেন জার্মানরা। 

কিন্তু জার্মানির খেলোয়াড়েরা পরশু কোনো প্রতিবাদ করেননি। কোনো কথাও বলেননি। জাপানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ফটোসেশনের সময় শুধু হাত দিয়ে সবাই মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। এটুকুই যথেষ্ট ছিল। সবাই বুঝে নেয় এটা বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ, আর এই প্রতিবাদ ফিফার বিরুদ্ধে। ইরান আবার ফিফার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। দেশে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদী মুখগুলো বন্ধ করতে সরকার হত্যার মেলা বসাতেও কুণ্ঠা করছে না। ইরানের খেলোয়াড়েরাও এর প্রতিবাদ জানাতে বেছে নেন বিশ্বকাপের মঞ্চকে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে জাতীয় সংগীতের সঙ্গে তাঁরা গলা মেলাননি। 

ম্যাচের আগে এভাবেই মুখ ঢেকে রেখেছিলেন জার্মানির খেলোয়াড়েরা

মেহেদি তারেমি-মাজিদ হোসেইনিরা দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতে গলা মেলাননি। কিন্তু ইরানের মানুষ আবার এটুকুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। তাঁদের কাছে এই প্রতিবাদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সেই বইটির নামের মতো—অতি অল্প হইল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে নিজেদের খেলোয়াড়দেরই দুয়োধ্বনি দিয়েছেন ইরানের সমর্থকেরা।

গত সেপ্টেম্বরে মাসা আমিনি নামের এক কুর্দি নারী হিজাববিধি না মানায় ইরানের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশি হেফাজতে তিনি মারা যান। প্রতিবাদে ফেটে পড়েন ইরানের সাধারণ মানুষ। সরকারের দমন-পীড়নে এ পর্যন্ত ৪ শতাধিক লোক নিহত হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় ১৬ হাজার। ইরানের সমর্থকদের প্রত্যাশা ছিল, জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরা এর প্রতিবাদে মুখ খুলবেন। মুখ বন্ধ রেখে প্রতিবাদটা তাঁদের ভালো লাগেনি।

আবার সমর্থকদের এ আচরণ ইরানের কোচ কার্লোস কুইরোজেরও ভালো লাগেনি। বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে খেলোয়াড়দের মনোযোগ যে আসল জায়গাতেই—ফুটবল! কুইরোজ তাই স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘তারা দলের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এখানে কেন এসেছে? বাড়ি ফিরে গেলেই পারে।’ 

সমর্থকেরা তো বাড়ি ফিরবেনই। কিন্তু খেলোয়াড়েরা? তাঁদের বাড়ি ফেরা নিয়ে তো ভয়ের কারণ আছেই। তেহরান সিটি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেহদি চামরান হুমকি দিয়েছেন, ‘জাতীয় সংগীতকে যাঁরা অপমান করেছেন, তাঁদের দেখে নেওয়া হবে।’

ফিফাও দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। ‘এলজিবিটি’ সম্প্রদায় নিয়ে কাতারের রক্ষণশীল অবস্থান তো সবারই জানা। বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া ইউরোপের নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, জার্মানির মতো দেশগুলো এর প্রতিবাদে ‘ওয়ান লাভ’ আর্মব্যান্ড পরে মাঠে নামতে চেয়েছিল। তাদের থামাতে ফিফা শাস্তির হুমকি দিয়ে বসে, সঙ্গে সব দলের অধিনায়কের জন্য একটি আর্মব্যান্ড নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। ফিফা মনে করে, বিশ্বকাপ যে দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সে দেশের আইন ও নিয়মনীতির প্রতি তারা অঙ্গীকারবদ্ধ। 

জার্মানি অধিনায়ক ম্যানুয়েল নয়্যারের আর্মব্যান্ড পরীক্ষা করে দেখছেন লাইনসম্যান। জাপানের বিপক্ষে পরশুর ম্যাচে

কিন্তু সব দেশে নিজেদের আগের অবস্থান থেকে সরে এলেও জার্মানি সরেনি। হ্যাঁ, তারা বিশেষ আর্মব্যান্ড পরেনি ঠিকই, কিন্তু হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের অভিনব প্রতিবাদ জানিয়েছে। 

এখন বলুন তো, খেলার মধ্যে রাজনীতি কিংবা রাজনীতির মধ্যে খেলা না মিশিয়ে পারা যায়!