‘আমার একটি স্বপ্ন আছে, একদিন আমার চার সন্তান এমন একটি দেশে বাস করবে, যেখানে তাদেরকে গায়ের রং দিয়ে বিচার করা হবে না।’ আজ থেকে ৬০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে এই ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ (আমার একটি স্বপ্ন আছে) শীর্ষক ভাষণটি দিয়েছিলেন।
সেদিন আড়াই লাখ লোক তাঁর বিখ্যাত ভাষণটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলেন। কিন্তু লুথার কিংসহ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আরও বহু লোকের লড়াই যে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, সে প্রমাণ সম্প্রতি ফুটবল মাঠে ঘটে যাওয়া ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের ঘটনাই যেন দিয়ে গেল।
২০২৩ সালে এসেও ভিনিসিয়ুসকে আক্ষেপ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখতে হচ্ছে, ‘যে চ্যাম্পিয়নশিপ একদিন রোনালদিনহো, রোনালদো, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ও লিওনেল মেসিকে দিয়ে পরিচিত হতো, সেটি এখন পরিচিত হচ্ছে বর্ণবাদ দিয়ে।’
১৯৬৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পৃথিবীতে বহু কিছুই বদলে গেছে। প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষতা বদলে দিয়েছে পৃথিবীকে। মানুষ তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞায় জয় করেছেন মহাকাশকে। এই ছয় দশকে মানুষের বস্তুগত উন্নতি যেন আকাশ ছুঁয়েছে। শুধু যা বদলায়নি, তা হলো গায়ের রং দিয়ে মানুষকে বিচার করার মানসিকতা। বর্ণবাদের আক্রমণ এতটাই প্রকট যে একজন খেলোয়াড়কে দল ছেড়ে যাওয়ার কথাও ভাবতে হচ্ছে।
ভিনিসিয়ুসের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ খুব সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়। মৌসুমের শুরু থেকেই একের পর এক বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে ভিনিকে। তবে ভ্যালেন্সিয়ার মাঠে যা ঘটেছে তা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এ ঘটনার পর স্প্যানিশ ফুটবলের কর্তৃপক্ষের আচরণ হতাশার মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পাশাপাশি ভিনি মনে করছেন, তিনি নিজের ক্লাব থেকেও পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন না। এমনকি পুরো লড়াইটা এককভাবে লড়ার আশঙ্কাও ভর করেছে ভিনির মনে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন শক্তিশালী এক বার্তা দিয়ে, ‘আমি শক্ত আছি এবং বর্ণবাদীদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়ব। এমনকি সেটা যদি এখান থেকে অনেক দূরেও হয় তবু।’
ভিনির এই পোস্টের পর ফুটবলভিত্তিক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য অ্যাথলেটিকের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল ভিনির এক ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে। ভিনি রিয়াল ছাড়ার কথা বিবেচনা করছেন কি না জানতে চাইলে সেই সূত্র জানিয়েছে, ‘হ্যাঁ, যখন আপনার নিজের লড়াইটা নিজেকেই করতে হয়, তখন এটা করতে হয়।’ আরেক সূত্র বলেছে, ‘আজ পর্যন্ত সে বিবেচনা করেনি, কিন্তু আজ থেকে সে করছে।’
ভিনি যদি শেষ পর্যন্ত লাগাতার বর্ণবাদী আচরণে নিজেকে আক্রান্ত এবং নিঃসঙ্গ মনে করে ক্লাব ছেড়ে যান, তবে তা রিয়ালের পাশাপাশি স্প্যানিশ ফুটবলের জন্যও বড় ধরনের ধাক্কা হয়ে আসবে। স্প্যানিশ ফুটবল তাদের অন্যতম উজ্জ্বল তারকাটিকেও হারিয়ে ফেলবে। আর এ জন্য পুরোপুরি দায়ী থাকবে রিয়াল এবং লা লিগা কর্তৃপক্ষ।
ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণের ঘটনাকে রুখতে অনেক আগেই ব্যবস্থা নিতে পারত তারা। কিন্তু সেটা তো করেইনি বরং লা লিগা সভাপতির অবস্থান শুরু থেকেই ছিল বিতর্কিত। দুই বছর ধরে এই আক্রমণের সঙ্গে লড়াই করে আসছেন ভিনি। অথচ বার্নব্যুর ক্লাবটি থেকে লা লিগা পর্যন্ত সবার আচরণই ছিল হতাশাজনক। শুধু এটুকুই নয়, স্প্যানিশ মিডিয়ার কাছ থেকেও বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল ভিনিকে, যা এখন তাঁকে শেষ পর্যন্ত ক্লাব ছাড়ার দিকে চালিত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
রিয়াল কোচ কার্লো আনচেলত্তির বিশ্বাস অবশ্য ক্লাব ও ফুটবলকে ভালোবেসেই ভিনি স্পেনেই থাকবেন। ভিনি স্পেন ছাড়বেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আনচেলত্তি বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না। কারণ, সে ফুটবলকে ভালোবাসে এবং রিয়াল মাদ্রিদকে ভালোবাসে। ক্লাবের জন্য তার ভালোবাসা অনেক বেশি। সে এখানেই তার ক্যারিয়ার গড়তে চায়।’
এ ঘটনায় ভিনিসিয়ুস কষ্ট পেলেও, সবার ভালোবাসা পেয়ে ভিনি আপ্লুত বলেও মন্তব্য করেছেন আনচেলত্তি, ‘যা ঘটেছে তাতে সে আক্রান্ত। কখনো কখনো আমি দেখি মানুষ তার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। বলা হয়, সে উসকানি দেয়। তার আচরণ নিয়েও কথা বলা হয়... না।’ এরপর রিয়াল কোচ জানান, সেদিন টিম বাস স্টেডিয়ামে আসার পর থেকেই ভিনির উদ্দেশে আক্রমণ শুরু হয়। তাই ভিনির বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার যে অভিযোগ, তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন আনচেলত্তি।
রিয়াল বস আনচেলত্তির কথা অনুযায়ী ভিনি হয়তো রিয়ালকে ভালোবেসে স্পেনেই থেকে যাবেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত যা ঘটেছে তা বলছে ভিনির ভালোবাসা একপাক্ষিক। ফুটবলকে ভালোবেসে রিয়াল বা স্পেনের ফুটবলকে তিনি যা দিয়েছেন তার প্রতিদান তো পাননি, বরং যে যন্ত্রণা ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে তা ব্যাখ্যাতীত। ভিনি থাকলে আগামী দিনগুলোতে সেসব কি তারা পুষিয়ে দিতে পারবে?