ম্যারাডোনা যেসব দলে খেলেছেন, সে দলগুলো এ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে
ম্যারাডোনা যেসব দলে  খেলেছেন, সে দলগুলো এ মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে

ম্যারাডোনা যাদের ভালোবেসেছেন, এই মৌসুমটা তাদেরই

‘এই বিশ্বকাপ ডিয়েগোরও। স্বর্গ থেকে তিনি আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছেন।’

ইনস্টাগ্রামে কথাটা লিখেছিলেন লিওনেল মেসি। গত ডিসেম্বরে কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর। ম্যারাডোনা তখন অনন্তলোকের বাসিন্দা। সেখান থেকে এই পৃথিবী দেখা যায় কি না, তা জানার সুযোগ নেই, তবে মানুষের মন তো! হয়তো দেখা যায়—এই বিশ্বাসবোধই বেশি। আর মানুষই প্রিয়জনের ভালো-মন্দ মাঝেমধ্যে দূর থেকেও কীভাবে যেন টের পেয়ে যায়।

ম্যারাডোনার জন্য তা আরও সহজ। স্বর্গের ‘জানালা’ দিয়ে শুধু একটু নিচে উঁকি দিলেই হবে। সেখান থেকে নিশ্চয়ই বার্সেলোনা, নেপলস, সেভিয়া, বুয়েনস এইরেস দেখা যায়? এসব শহরে তাকিয়ে ম্যারাডোনার কি চোখ ভিজে এসেছে? মনটা কি একছুটে মিশে যেত সেসব শহরে মানুষের উৎসবের ভিড়ে?

শহরগুলোয় তাঁর অযুত স্মৃতির ডালি। লোকে সেসব ‘ডালি’ বুকে নিয়েই সাফল্যের উৎসব করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তাঁর পাঁড় ভক্তরা আবেগতাড়িত হয়ে বলাবলি করছেন, ম্যারাডোনা ওপর থেকে প্রার্থনা করেছিলেন আর প্রেরণা হয়ে খেলোয়াড়দের বুকের মাঝে আছেন বলেই এমন অভূতপূর্ব কিছু দেখা গেল!

আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসের রাস্তার পাশে একটি দেয়ালে মেসি–ম্যারাডোনার গ্রাফিতি

ভালোবাসার কোনো কিছুর প্রতি আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির মনের টানের যে তুলনা চলে না। বেঁচে থাকতেই বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। আর্জেন্টিনা জাতীয় দল, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি ও সেভিয়ার প্রতি তাঁর অপত্য ভালোবাসা ছিল সব সময়। সব দলে তাঁর অভিজ্ঞতাটা সব সময় মধুর না হলেও ফুটবলকে জীবন বানিয়ে নেওয়ায় এই ক্লাবগুলোকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসতে কিংবদন্তি কখনো কার্পণ্য করেননি।

আর তাই বিষয়টি যে ফ্যান্টাসি, তা বুঝেও লোকে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিয়েছে—২০২০ সালের ২৫ নভেম্বর কিংবদন্তির মৃত্যুর পর একের পর এক তাঁর দলগুলো চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। পাঁচটি দল তো চ্যাম্পিয়ন হলো এক মৌসুমে! বিজ্ঞান যতই যুক্তি দিক, এর সঙ্গে প্রয়াত ’৮৬ বিশ্বকাপ কিংবদন্তির কোনো রূপ যোগসূত্র নেই, ওসব প্রার্থনা-প্রেরণা স্রেফ আবেগতাড়িত কথা—তবু কি মন মানে! ফুটবল ভালোবাসলে কি মানানো যায়? যদি তা–ই হতো, তাহলে কাতারে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের পর লোকে রোজারিওতে ম্যারাডোনার নামে সৃষ্ট ধর্মের (ইগলাসিয়া ম্যারাডোনিয়ানা) উপাসনালয়ে গিয়ে অর্ঘ্য দিত না। খেলাধুলা যেহেতু যুক্তির সীমানা ডিঙিয়ে ব্যাখ্যাতীত সব বিষয় কিংবা অনুভূতিকে ধারণ করতে পারে, তাই এই শেষের পথে এই মৌসুমকে লোকে ‘ম্যারাডোনিয়ান ইয়ার’ বলছে।

কেন বলছে, সেটাই তো প্রশ্ন? আচ্ছা ভেঙে বলা যাক। ২০২২-২৩ মৌসুমে এমন পাঁচটি ক্লাব বা দল শিরোপা জিতেছে, যেখানে ম্যারাডোনা খেলেছেন। বোকা জুনিয়র্সকে দিয়ে শুরু করা যাক। গত বছরের ২৪ অক্টোবর আর্জেন্টিনার শীর্ষ লিগ জিতে নেয় ম্যারাডোনার প্রাণের ক্লাব। প্রিমেরা লিগের শেষ দিনে ইন্দিপেন্দিয়েন্তের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে চ্যাম্পিয়ন হয় বোকা। বুয়েনস এইরেসের ক্লাবটিতে দুই মেয়াদে (১৯৮১-৮২ ও ১৯৯৫-৯৭) খেলে একবারই লিগ জিতেছিলেন ম্যারাডোনা।

অক্টোবর শেষে নভেম্বর পেরিয়ে ১৮ ডিসেম্বর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ম্যারাডোনা যে জার্সিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন, সেই আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতে নেয় লিওনেল মেসির নেতৃত্বে। এই জার্সিতে ম্যারাডোনার কীর্তি মনে করিয়ে দেওয়াটা বাতুলতার নামান্তর। ’৮৬ বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন, ’৯০ বিশ্বকাপের ফাইনালে তুলেছেন—১৯৭৭ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা দলের হয়ে ৯১ ম্যাচে তাঁর ৩৪ গোলের প্রতিটিই ভক্তদের কাছে যেন একেকটি ইতিহাস! বেঁচে থাকতে কিংবদন্তি মেসির হাতে বিশ্বকাপ দেখে যেতে চেয়েছিলেন। ভাগ্য তা হতে না দিলেও উত্তরসূরি যে তাঁকে ভুলে যাননি, সেই প্রমাণ তো ইনস্টাগ্রামে মেসির সেই পোস্ট।

কাতার বিশ্বকাপ জিতে আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটায় লিওনেল মেসির দল

ক্লাব ক্যারিয়ারে ম্যারাডোনা সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন সম্ভবত নাপোলিকে। নেপলস ছিল তাঁর দ্বিতীয় ঘর। সেখানকার মানুষও তাঁকে ভালোবাসা ফিরিয়ে দিয়েছে, এখনো দিচ্ছে। নেপলসের প্রায় প্রতিটি রাস্তায় ম্যারাডোনার ম্যূরাল চোখে পড়ে।

এমনকি তাঁর নামে সেখানে ধর্মও প্রচলিত। গত ৪ মে সেই ধর্মের উপসানলয় থেকে শুরু করে নেপলসের রাস্তা যেন ‘নীল সমুদ্র’ হয়ে উঠেছিল। ৩৩ বছর পর লিগ শিরোপা জয়ের সেই আনন্দে নিয়াপলিতানরা মেনে রেখেছে ম্যারাডোনাকেও। এবারের আগে যে কিংবদন্তির পায়ের জাদুতেই সর্বশেষ (১৯৮৯-৯০) চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল নাপোলি।

৩০ বছর পর কিংবদন্তি যখন মারা গেলেন, তারপর নাপোলির স্টেডিয়ামের নাম পাল্টে তাঁর নামে রাখা হয়। আর্জেন্টাইন কিংবদন্তির ছবি সম্ভবত নিয়াপলিতানদের ঘরে ঘরে। নাপোলির সেরা সময়ের মহানায়ককে কে ভুলবেন! উদিনেসের মাঠে লিগ জয় নিশ্চিত হওয়ার পর নাপোলির কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তিই বলেছিলেন, ‘সমর্থকেরা ম্যারাডোনাকে দেখেছে, আর সম্ভবত তিনি আমাদের রক্ষা করেছেন বলেই আজ এই ফল পেলাম।’

৩৩ বছর পর লিগ শিরোপা জিতেছে ম্যারাডোনার সাবেক ক্লাব নাপোলি

ভাগ্যও নাপোলি-ম্যারাডোনার পারস্পরিক টানকে অনূদিত করেছে বিস্ময়কর পরিসংখ্যানে। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে তাদের হয়ে সর্বোচ্চ গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা। পরের বছর নাপোলির প্রথম সিরি ‘আ’ জয়েও ক্লাবটির সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ম্যারাডোনা। আর নাপোলি এবার লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগের বছর বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা!

বার্সেলোনায় দুই মৌসুম (১৯৮২-৮৪) খেলেছিলেন ম্যারাডোনা। লিগ জিততে না পারলেও কোপা দেল রে ও কোপা দে লা লিগা জিতেছেন। ম্যারাডোনার সেই বার্সা এবারের মৌসুমে লা লিগা জিতেছে চার মৌসুম পর। গত ১৫ মে এসপানিওলকে ৪-২ গোলে হারিয়ে লিগ জয় নিশ্চিত করে বার্সা। এই মৌসুমে ‘ম্যারাডোনিয়ান ইয়ার’ বা ম্যারাডোনার বছরের এই চক্র পূরণ করেছে সেভিয়া। গত মঙ্গলবার ইউরোপা লিগ ফাইনালে এএস রোমাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় স্প্যানিশ ক্লাবটি। ইউরোপকে ‘গুডবাই’ জানিয়ে আর্জেন্টিনায় ফিরে যাওয়ার আগে সেভিয়ায় (১৯৯২-৯৩) এক মৌসুম খেলে কিছু জিততে পারেননি ম্যারাডোনা।

ম্যারাডোনার উপাসনা করে নাপোলি সমর্থকেরা

কিন্তু তাতে কী? সেভিয়া সমর্থকেরা তো তাঁকে ভুলে যাননি। বুদাপেস্টের পুসকাস অ্যারেনায় ফাইনাল শেষে গ্যালারিতে সেভিয়া সমর্থকদের হাতে ম্যারাডোনার ছবি–সংবলিত ব্যানার দেখা গেছে। সন্তুর পোশাকে ম্যারাডোনার সেই ব্যানার উঁচিয়ে ধরেছিলেন ছয় সেভিয়া সমর্থক। সবার গায়েই সেই জার্সি—ম্যারাডোনা থাকতে সেই মৌসুমে সেভিয়া যে জার্সি পরে খেলেছে! সেভিয়ার আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড পাপু গোমেজের কথা শুনলে আরও চমকে যেতে হয়। পুসকাস অ্যারেনায় শেষ বাঁশি বাজার পর সেভিয়ার ১৯৯২-৯৩ মৌসুমের জার্সি পরে উদ্‌যাপন করেন পাপু গোমেজ। ম্যারাডোনার সেই জার্সি কেন পরেছেন, প্রশ্নের উত্তরটা শুনুন পাপুর মুখেই, ‘তিনি আমার আদর্শ। তাঁকে ভালোবেসেই তো এই ক্লাবে যোগ দিয়েছি।’

ভালোবাসা! মাত্র চারটি বর্ণের এই শব্দের কত ক্ষমতা যে মাঠে দলগুলোর সাফল্যের সঙ্গে প্রয়াত মানুষটির কোনো সংযোগ না থাকলেও লোকে মিলিয়ে নিচ্ছে, নিতে চায়। তা না হলে শুধু এই পাঁচটি দলেই লোকে সন্তুষ্ট হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টেনে আনা হয়েছে ২০২১ সালে আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয় ও সে বছরই বোকা জুনিয়র্সের ম্যারাডোনা কাপ জয়ও। দুটি দল যে সাফল্য পেয়েছে ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর! কিংবা কোনো কোনো ভক্ত এভাবেও মেলাচ্ছেন—বার্সা ইউরোপে ম্যারাডোনার প্রথম ক্লাব, নাপোলি দ্বিতীয় ও সেভিয়া তৃতীয়। সব কটি ক্লাবই এই মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন!

ইউরোপা লিগের ফাইনালে ম্যারাডোনার ছবি–সংবলিত ব্যানার নিয়ে এসেছিলেন সেভিয়া সমর্থকেরা

বাস্তববাদী সমর্থকেরা বলতে পারেন, এগুলো ম্যারাডোনার ভক্তদের মনের সান্ত্বনা। আচ্ছা, পাপু গোমেজ তো সেভিয়ারই খেলোয়াড়। মাঠে লড়াই করে ইউরোপা লিগ জিতেছেন, যেখানে ম্যারাডোনার তিল পরিমাণ অবদানও নেই। তবু কেন সেভিয়া চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ম্যারাডোনাকে স্মরণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাপু লিখেছিলেন, ‘ওপর থেকে এটা ধরে রাখো।’

‘ধরে রাখা’র অনুরোধটা ম্যারাডোনার প্রতি। কি? এই যে এক মৌসুমে তাঁর সাবেক পাঁচটি ক্লাব চ্যাম্পিয়ন হলো! কীভাবে রাখবেন? এই প্রশ্নের উত্তর হয় না, শুধু ভালোবাসা ছাড়া—যেটা যুক্তির সীমানা পেরিয়ে ওপাশের দুনিয়া, যেখানে লোকে বিশ্বাস করে, ম্যারাডোনা ওপরে জিদ ধরেছিলেন বলেই তাঁর দলগুলো চ্যাম্পিয়ন হলো এক মৌসুমে!

এটুকু কি সাবেক ক্লাবগুলোর প্রতি কিংবদন্তির ভালোবাসা নয়?