‘সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ৯০ মিনিট অনেক লম্বা সময়’—প্রয়াত ফরোয়ার্ড হুয়ানিতোর কথাটা তো চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিপক্ষগুলোর জন্য অমর ভীতিকর বাণীই হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথাটা নিজেদের মাঠে রিয়ালের ঘুরে দাঁড়ানোর সঞ্জীবনী বার্তাও দিয়ে আসছে।
বার্নাব্যুতে আজ অবশ্য রিয়ালের জন্য প্রত্যাবর্তনের ব্যাপার–স্যাপার ছিল না। মিরাকল বা অলৌকিকতা যা–ই বলুন, জন্ম দিতে হতো লিভারপুলকে। তাই এই ৯০ মিনিট নাতিদীর্ঘ হয়ে উঠল। মোহাম্মদ সালাহ, দারউইন নুনিয়েজ, ভার্জিল ফন ডাইকদের শারীরিক ভাষা দেখেও আন্দাজ করা যাচ্ছিল, ম্যাচটা দ্রুত শেষ হলেই যেন বাঁচেন তাঁরা। রেফারিও সময়মতো শেষ বাঁশি বাজিয়ে লিভারপুলকে যেন মুক্তি দিলেন!
তার আগে লিভারপুলের সর্বনাশ যা করার, করে ফেলেছেন করিম বেনজেমা। তাঁর একমাত্র গোলেই ইয়ুর্গেন ক্লপের দলকে আরেক দফা হারিয়ে দিল রিয়াল। বর্তমান চ্যাম্পিয়নরা উঠে গেল শেষ আটে।
গত বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালেও ১–০ ব্যবধানে লিভারপুলকে হারিয়েছিল রিয়াল। সেবার গোল করেছিলেন ভিনিসিয়ুস; এবার করালেন বেনজেমাকে দিয়ে।
নিজেদের ডেরা অ্যানফিল্ডে শেষ ষোলো পর্বের প্রথম লেগে দুই গোলে এগিয়ে গিয়েও রিয়ালের কাছে ৫–২ ব্যবধানে উড়ে গিয়েছিল লিভারপুল। অলরেডদের কপালে লাল বাতিও বলতে গেলে তখনই জ্বলে উঠেছিল। যদিও কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ ১% সম্ভাবনা নিয়েই অলৌকিকতার আশা করেছিলেন। বাস্তবে তার ছিঁটেফোঁটাও দেখা গেল না। দুই লেগ মিলিয়ে ৬–২ অগ্রগামিতায় প্রত্যাশিতভাবেই কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট কেটে ফেলল কার্লো আনচেলত্তির দল।
ক্লপের মতো তাঁর শিষ্যরাও অনেক প্রত্যাশার কথা শুনিয়ে এলেও রিয়ালের সামনে পড়লেই চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া লিভারপুলের জন্য সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ নিয়ে মুখোমুখি সর্বশেষ ৩ ম্যাচেই হার কিংবা ২০০৯ সালের পর স্প্যানিশ ক্লাবটির বিপক্ষে জিততে না পারা সেটাই জানান দিচ্ছে।
লিভারপুলের জন্য ম্যাচটা আরেকটি দুঃখগাথা হয়ে গেলেও রিয়ালের জন্য মাইলফলক ছোঁয়ার রাতে জয়ে রাঙানোর। চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের সফলতম দলটির এটি যে ৩০০তম ম্যাচ।
বেনজেমার জন্যও নিজের রেকর্ড আরও সমৃদ্ধ করার। লিভারপুলের বিপক্ষে এ নিয়ে ৭টি গোল করলেন ফরাসি ফরোয়ার্ড, যা তাদের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস লিগে কোনো খেলোয়াড়ের সর্বোচ্চ। আসরের নক আউট পর্বে সর্বশেষ আট ম্যাচেই ১৩ গোল হলো তাঁর। দুই দলের অনেক সুযোগ নষ্টের ভিড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা ‘আধা–ফিট’ বেনজেমার গোলটাকে হ্যাটট্রিকের সমান ভাবা যেতেই পারে।
ম্যাচে ৫৪ শতাংশ সময় বল দখলে রাখা রিয়াল গোলের জন্য ১৭টি শট নেয়, এর ৮টি ছিল লক্ষ্যে। মৌসুমের শুরু থেকেই উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যাওয়া লিভারপুলের ৯ শটের ৫টি ছিল লক্ষ্যে।
যদিও ম্যাচে বলার মতো প্রথম সুযোগ তৈরি করেছিল অলরেডরাই। এতে বড় দায় ছিল আন্তোনিও রুডিগারের। শুরুতে বলের ফ্লাইট মিস করেন রিয়ালের এই জার্মান ডিফেন্ডার। পরে বলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে এড়িয়ে সালাহ খুঁজে নেন নুনিয়েজকে। তবে থিবো কোর্তোয়া বরাবর শট নিয়ে হতাশ করেন উরুগুইয়ান স্ট্রাইকার। ১১ মিনিটে টনি ক্রুসের দূরপাল্লার শট ঠিকঠাক গ্লাভসবন্দী করেন আলিসন বেকার। লক্ষ্যে এটাই রিয়ালের প্রথম শট।
৯ মিনিট পর গোল প্রায় পেয়েই যাচ্ছিল রিয়াল। ডি বক্সের বাইরে থেকে এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গার বুলেট গতির শটে কোনোমতে হাত ছোঁয়াতে পারেন আলিসন। কাজ হয় তাতেই, বল লাগে ক্রসবারে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই রিয়ালের মুহুর্মুহু আক্রমণ ঠেকিয়ে লিভারপুলের ক্ষীণ আশাটুকু বাঁচিয়ে রাখেন আলিসনই। তবে প্রতি আক্রমণে সুযোগ নষ্ট করেন সালাহ। স্বাভাবিক খেলা খেলতে না পারায় একবার তো নাচোর সঙ্গে প্রায় লেগেই গিয়েছিল মিশরীয় তারকার। রেফারি এসে না থামালে হয়তো আরও বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।
লিভারপুলের রক্ষণে প্রবল চাপ তৈরি করা রিয়াল এগিয়ে যায় ৭৮ মিনিটে। মাঝমাঠ থেকে কামাভিঙ্গার বাড়ানো বল ফন ডাইকের চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি বেনজেমা। ছুটে গিয়ে বলে পা ছোঁয়াতে পারেননি ভিনিসিয়ুস। মনে হচ্ছিল নষ্ট হচ্ছে আরেকটি সুযোগ। কিন্তু ভারসাম্য হারিয়ে বক্সে পড়ে গেলেও ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার পাস বাড়ান বেনজেমাকে। ফরাসি ফরোয়ার্ড অনায়াসেই সারেন বাকিটা। ক্লপের সেই ১% সম্ভাবনাও সমাধিস্থ হয় সেখানে।