আগের বিকেলে বাংলাদেশের কাছে হেরেও আনন্দেই কাটছে সেশেলস জাতীয় দলের ফুটবলারদের সময়। আজ সকালে সিলেট উপশহরে টিম হোটেলে গিয়ে দেখা গেল, ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশটির ফুটবলারদের মন মোটেও খারাপ নয়। কেউ কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে নাচছেন। কেউ সময়টা নিজের মতো করে কাটাচ্ছেন। সময় সময় সেশেলস ফুটবলের উচ্চস্বর ভেসে আসছিল লবিতে।
তবে একজনকে একটু ব্যতিক্রমই মনে হলো মাইকেল মানসিয়ানেকে। কিছুটা চুপচাপ, হইচইয়ের মধ্যে নেই। ‘বাংলাদেশের কাছে হারটা ঠিক হলো না আমাদের। অন্তত ড্র করতে পারতাম। সেটা না হওয়ায় মন খারাপ লাগছে’, বলছিলেন মানসিয়ানে।
এই দলের ‘মহাতারকা’ তিনি। জার্মানির হামবুর্গে খেলেছেন। এখন তাঁর ঠিকানা ইংল্যান্ডের ডিভিশন ওয়ানের বার্টন আলবিয়ন এফসি। তবে এসব তথ্য তাঁকে ঠিকঠাক তুলে ধরছে না। মানসিয়ানের মূল পরিচয় চেলসির মতো দলে খেলেছেন! ১৯৯ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের দলে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা ফুটবলার। ভাবা যায়!
কিছুটা অবিশ্বাস্যই শোনায় মানসিয়ানের গল্পটা। হোটেল লবিতে বসে প্রথম আলোকে এই ডিফেন্ডার বলে চলেন, ‘সম্ভবত ২০০৯ সালে চেলসির মূল দলের জার্সিতে অভিষেক হয় আমার, সেটি ছিল এফএ কাপে ওয়াটফোর্ডের বিপক্ষে। ম্যাচটা ১-১। জন টেরি তখন চেলসিতে খেলেন। চেলসির সিনিয়র দলে পাঁচ-ছয়টি (আসলে চারটি) ম্যাচ খেলা হয়েছে আমার। চেলসির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগেও খেলেছি।’
ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৬, ১৭, ১৮, ১৯ ও ২১ দলে খেলেছেন। স্বপ্ন দেখেছেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার। স্বপ্ন পূরণের কাছেও চলে গিয়েছিলেন। জার্মানির বিপক্ষে একটি ম্যাচে ডাক পান মূল জাতীয় দলে। এরপর কী হলো, বললেন মানসিয়ানে, ‘সে ম্যাচে আমি... বেঞ্চে ছিলাম। ফলে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলা হয়নি আমার। এই আফসোসটা আমার সব সময় থেকেই যাবে।’ নিজের হতাশাটা লুকোননি মানসিয়ানে।
ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার সুযোগ হয়নি বলেই তাঁকে পেয়েছে সেশেলস। সেটাও অনেক দেরিতে, মাত্রই গত বছর। ক্যারিয়ারের শেষবেলায়। কাল বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলা ফিফা প্রীতি ম্যাচটি সেশেলসের হয়ে তাঁর চতুর্থ। জাতীয় দলে খেলেন সেন্টারব্যাক হিসেবে, পরেন ৪ নম্বর জার্সি। বাংলাদেশের আক্রমণ সামলেছেন ভালোই। বয়স ৩৫ হয়ে যাওয়ায় গতি একটু কমে গেছে, তবে নিজের মান বোঝাতে এখনো তৎপর মানসিয়ানে।
আর এতে বেশ খুশি সেলেশস জাতীয় দলের ম্যানেজার মাইকেল দেলপেক। তিনি বলছিলেন মানসিয়ানেকে পাওয়ার গল্পটা, ‘আমরা ২০১১ সাল থেকেই চাইছিলাম ওকে। কিন্তু ও সাড়া দিচ্ছিল না। বুঝতেই পারছেন ইংল্যান্ড ছেড়ে কে আসতে চায়! সে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলার আশায় ছিল। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি।’
তারপর? ম্যানেজার বলে যান, ‘গত বছর আমি তাকে ফোন করি এবং সে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে। এতে আমরা খুব খুশি। ওর মতো ফুটবলার দলে থাকা মানে অন্যদের জন্য অনুপ্রেরণা। ওকে দেখে অন্যরা শিখছে।’ ম্যানেজারের কাছেই জানা গেল, মানসিয়ানের বাবাও নাকি খেলেছেন সেশেলস জাতীয় ফুটবল দলে। তাঁর নামও মাইকেল মানসিয়ানে। অর্থাৎ সেশেলসে এখন যিনি খেলছেন, জুনিয়র মানসিয়ানে।
আসা যাক তাঁর সেশেলস শেকড়ের কথায়। মানসিয়ানের মা-বাবা সেশেলসের। ভালোই কাটছিল তাঁদের জীবন। সংসারে আসে দুই কন্যাসন্তান। কিন্তু সত্তর দশকের শেষ দিকে তখন সেশেলসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়ে ওঠে অস্থির। ১৯৭৭ সালে অভ্যুত্থান হয়ে যায় মাত্র ৪৫৫ বর্গ কিলোমিটারের ভারত মহাসাগরের দ্বীপটিতে। ক্ষমতায় আসে অনির্বাচিত সরকার। অনেক মানুষ দেশ ছাড়েন, যার মধ্যে আছেন মানসিয়ানের মা-বাবাও। তাঁরা ইংল্যান্ড গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চান এবং আশ্রয় মেলে। সেখানেই ১৯৮৮ সালে মানসিয়ানের জন্ম। এসব গল্প মানসিয়ানের পাশে বসে বলছিলেন সেশেলসের ম্যানেজার।
১৯৭৭ থেকে টানা একটা দল দেশটি শাসন করত। সেই দলটি বিদায় নিয়েছে সম্প্রতি। ৪৩ বছর পর দেশটিতে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার এসেছে। এখন পর্যটন-দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাকি ভালো। মানুষ খুশি। দুই সন্তান, স্ত্রী আর মা-বাবাকে নিয়ে মানসিয়ানে যেহেতু ইংল্যান্ডে থাকেন, সেলেশসের এসব রাজনৈতিক বিষয় মানসিয়ানের সেভাবে জানা নেই।
মানসিয়ানে বরং তাঁর নিজের গল্পে ঢোকেন। যে গল্পে মিশে আছে ইংল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে বেড়ে ওঠা, ফুটবলার হওয়ার রোমাঞ্চ। পেছন ফিরে বলেন, পশ্চিম লন্ডনের ফেলথহামে তাঁর জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা, ফুটবলের প্রেমে পড়া। সেই প্রেম দিনে দিনে গভীর হয়েছে। নিজেকে নিয়েছেন অনেক উঁচুতে। এখন তো তিনি একটা দেশের ফুটবলের মুখ, আশার প্রতীক।
কথা বলতে বলতে বারবার আমাকে ‘মিটিংয়ে যেতে হবে’ তাগিদ দেন। তবে শেষ প্রশ্নটা করার সুযোগ দিলেন। সুযোগ পেলে বাংলাদেশের কোনো ক্লাব দলে খেলবেন? উত্তরে বলেন, ‘খেলব না, এটা বলব না। জীবনে কখন কী ঘটে কেউ বলতে পারে না। সুতরাং আপনি কখনো আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকতে পারেন না।’ সাবেক চেলসি ডিফেন্ডার যেন নিয়তির ওপরই সঁপে দিলেন নিজেকে।