খেলোয়াড় বিক্রি যাদের ব্যবসা

মানুন আর না-ই মানুন, দিন শেষে ফুটবল একটা ব্যবসা। আর ব্যবসা মানেই টাকা উপার্জনের কাণ্ডকারখানা। ট্রান্সফার মার্কেটে এই খেলোয়াড় বিক্রির কাজটিতে কিছু ইউরোপিয়ান ক্লাবকে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ বলা চলে।

অল্প টাকায় খেলোয়াড় কিনে বছর দু-তিনেকে তাঁদের গড়ে তুলে কয়েকগুণ দামে বিক্রি করে দেওয়া—এ-ই হচ্ছে তাদের ব্যবসায়িক কৌশল। প্রতিবছর বিক্রি চলে, প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উদীয়মান, প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে আনার কাজ চলে। বছর বছর তাই ক্লাবে নতুন মুখ আসে, পুরোনো মুখ যায়। এভাবে চাকা ঘোরে, ব্যবসা বাড়তে থাকে, স্ফিত হতে থাকে কোষাগার।

নেইমারের কথাই ধরা যাক। ২০১৩ সালে বার্সেলোনা তাঁকে সান্তোস থেকে কিনেছিল ৮৮ মিলিয়ন ইউরোয়, চার বছর পর পিএসজিতে যাওয়ার সময় দাম উঠে যায় ২২২ মিলিয়ন ইউরোতে। দ্বিতীয় দফার এই বিক্রিতেও একটা লভ্যাংশ গেছে পেলে–পুষে যে ক্লাব তাঁকে বড় করেছে, সেই সান্তোসের কাছে।

তবে সব খেলোয়াড়কে নিয়ে এত বড় অঙ্কের ব্যবসা হয় না। লাভ হয় মূলত স্বল্প ওজনদার ফুটবলার বিক্রি করে। এই খেলোয়াড় বিক্রির ব্যবসায় সবচেয়ে ভালো করা ক্লাবগুলোর বেশির ভাগই ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের বাইরের।

গত এক যুগে খেলোয়াড় বিক্রি করে সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করা ক্লাবগুলো নিয়ে এই তালিকা পাওয়া গেছে ট্রান্সফার মার্কেটের সৌজন্যে।

বেনফিকা

সর্বোচ্চ কেনা: দারউইন নুনিয়েজ (৩৪ মিলিয়ন ইউরোয় আলমেরিয়া থেকে)
সর্বোচ্চ বিক্রি: দারউইন নুনিয়েজ (৭৫ মিলিয়ন ইউরোয় লিভারপুলের কাছে)

একবিংশ শতাব্দীতে সব মিলিয়ে রেকর্ড ৩৭টি শিরোপা জয়ের কীর্তি আছে বেনফিকার। তবে পর্তুগিজ ক্লাবটির সবচেয়ে বড় সাফল্য সম্ভবত খেলোয়াড় বিক্রির ব্যবসা। এই একটি ক্লাবই গত দুই দশকে এক বিলিয়ন ইউরোর বেশি আয় করেছে ফুটবলার বিক্রি করে।

দুইভাবে খেলোয়াড় জোগাড় করে বেনফিকা। একটি হচ্ছে ক্লাবের একাডেমি থেকে। বেশ কয়েকজন ইউরোপের প্রথম সারির যুব কোচ আছেন এই একাডেমিতে, কিশোরদের গড়ে তুলতে যাঁরা বড় ভূমিকা রাখেন। এই একাডেমি থেকে উঠে আসা জোয়াও ফেলিক্সকে আতলেতিকো মাদ্রিদের কাছে ১২৬ মিলিয়ন আর রুবেন দিয়াজকে ম্যান সিটির কাছে ৬৮ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করেছে তারা।

আতলেতিকো মাদ্রিদের কাছে ফেলিক্সকে ১২৬ মিলিয়ন ইউরোয় বিক্রি করে বেনফিকা।

এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সম্ভাবনাময় এবং প্রতিভাবান খেলোয়াড় বাছাই করে আনার জন্য শক্তিশালী একটা নেটওয়ার্কও আছে বেনফিকার। যার মাধ্যমে তারা আর্জেন্টিনা থেকে আনহেল দি মারিয়া ও পাবলো আইমার, ব্রাজিল থেকে দাভিদ লুইজের মতো ফুটবলারদের খুব কম ফিতে তুলে নিয়ে এসেছিল।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আরও অনেক ক্লাবই তো আছে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে, বিশেষ করে শীর্ষ পাঁচ লিগের দেশে। সেখানকার চেয়ে পর্তুগিজ ক্লাবে কেন বেশি আসে দক্ষিণ আমেরিকানরা? মূলত পর্তুগালের জলবায়ু, সংস্কৃতি আর ফুটবল স্টাইলের বাড়তি কিছু সুবিধা আছে। দক্ষিণ আমেরিকানদের আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পর্তুগালে আসতে বেশি কিছু ভাবতে হয় না।

ব্রাজিলের তো ভাষাই পর্তুগিজ। আবার বিদেশি হিসেবে পর্তুগালে খেলার সুযোগ পাওয়াও সহজ। যে কারণে খেলার সুযোগ করে দিতে পারার সুবিধা নিয়ে কম টাকায় ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার তরুণদের দলে ভিড়িয়ে ফেলে বেনফিকা। ওই তরুণেরাও ধরে নেন, পর্তুগাল তাঁদের ক্যারিয়ারের জন্য ট্রানজিট পয়েন্ট।

ইউরোপের কিছু ছোট ছোট দেশ, যেমন সার্বিয়া, স্লোভেনিয়া ও সুইডেনের প্রতিভাবান ফুটবলারদের গড়ে তোলায়ও সুনাম আছে বেনফিকার। যেমন স্লোভেনিয়ান গোলরক্ষক ইয়ান ওবলাককে তারা চার মিলিয়ন ইউরোয় কিনেছিল এনকে অলিম্পিয়া থেকে, পরে আতলেতিকোয় বিক্রি করে দেয় ১৬ মিলিয়নে।

একাডেমির ভিক্টর লিন্ডেলফকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে বিক্রি করে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোয়। আর সর্বশেষ নুনিয়েজকে বিক্রি করে লাভ করে ৪১ মিলিয়ন ইউরো, যাঁকে আলমেরিয়া থেকে কেনা হয়েছিল মাত্র দুই বছর আগে।

পোর্তো
সর্বোচ্চ কেনা: দাভিদ কারমো-ব্রাগা, অলিভিয়ের তোরেস-আতলেতিকো, জিয়ান্নেলি ইমবুলা-মার্শেই (২০ মিলিয়নে)
সর্বোচ্চ বিক্রি: এদের মিলিতাও (৫০ মিলিয়ন ইউরোয় রিয়াল মাদ্রিদের কাছে)

২০০০-০১ মৌসুম থেকে এখন পর্যন্ত ১২টি শিরোপা জিতেছে পোর্তো, নিয়মিত খেলে চ্যাম্পিয়নস লিগেও। কিন্তু পর্তুগিজ এই ক্লাবেরও খেলোয়াড় কেনাবেচার ব্যবসায় দারুণ সাফল্য। এখন পর্যন্ত তারা ২০ মিলিয়নের বেশি দামে কোনো খেলোয়াড়ই কেনেনি, কিন্তু বিক্রি করেছে ৫০ মিলিয়ন ইউরোতেও।

নতুন মার্কেটে খেলোয়াড় বিক্রিতেও বেশ সাফল্যের উদাহরণ আছে তাদের। গত দুই দশকে পোর্তোর বড় ব্যবসার শুরু ২০০৪ সালে চেলসির কাছে রিকার্দো কারভালিও এবং পাওলো ফেরেইরাকে ৫০ মিলিয়ন ইউরোয় বিক্রির মাধ্যমে।

রিভারপ্লেট থেকে পোর্তোয় যোগ দিয়েছিলেন রাদামেল ফ্যালকাও

বেনফিকার মতো পোর্তোরও দক্ষিণ আমেরিকায় প্রতিভাবান ফুটবলার খোঁজায় শক্তিশালী একটা নেটওয়ার্ক আছে। যেমন রাদামেল ফ্যালকাওকে তারা সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন ইউরোয় কিনে এনেছিল রিভার প্লেট থেকে, পরে তাকে আতলেতিকোর কাছে বিক্রি করে সাড়ে ৩৪ মিলিয়ন ইউরো লাভে।

এ রকম আরও আছে ৭ মিলিয়নে সাও পাওলো থেকে আনা এদের মিলিতাও (এক বছরের মাথায় রিয়ালের কাছে ৪৩ মিলিয়ন লাভে বিক্রি), জুনিয়র এফসি থেকে ৭ মিলিয়নে আনা লুইস দিয়াজ (দুই বছর পর লিভারপুলের কাছে ৪০ মিলিয়ন লাভে বিক্রি)। নতুন মার্কেটেও ভালো বিক্রির রেকর্ড আছে পোর্তোর।

২০১০ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে হাল্ক ও ব্রুনো আলভেজকে বিক্রি করে ৬২ মিলিয়ন ইউরোয়, যা ওই সময় বেশ বড় অঙ্ক।
নিজেদের একাডেমিতে গড়ে তোলা ভিতিনিয়া (পিএসজি), ফাবিও ভিয়েরা (আর্সেনাল) ও ফাবিও সিলভাদের (উলভস) বিক্রি করেও পেয়েছে ১১৬ মিলিয়ন ইউরো।

আয়াক্স
সর্বোচ্চ কেনা: স্টিভেন বের্গভেইন, (৩১.৩ মিলিয়ন ইউরোয় টটেনহাম থেকে)
সর্বোচ্চ বিক্রি: আন্তনি (৯৫ মিলিয়নে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে)

ইউরোপীয় ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ একাডেমি হিসেবে দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল আয়াক্সের একাডেমি। পর্তুগিজ ক্লাবগুলোর তুলনায় এখন আয়াক্সের খেলোয়াড় সরবরাহের হার কমলেও এখনো তা একেবারে কম নয়। চলতি মৌসুমেই ২০৭ মিলিয়ন ইউরোয় বিক্রি করেছে পাঁচজনকে (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে লিসান্দ্রো মার্তিনেজ ও আন্তনিকে, ডর্টমুন্ডে সেবাস্তিয়েন আলারকে, বায়ার্নে রায়ান গ্রাভেনবার্খকে এবং লিওঁতে নিকোলাস তাগলিয়াফিকোকে)।

আয়াক্স থেকে বার্সেলোনায় যান ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং।

এ ছাড়া এই ক্লাবের একাডেমি খেলোয়াড়দের মধ্যে পরে ভালো দামে বিকিকিনি হয়েছে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং (৮৬ মিলিয়নে বার্সেলোনায়), ম্যাথিয়াস ডি লিখট (৮৫ মিলিয়নে জুভেন্টাসে), ডনি ফন ডি বিক (৩৯ মিলিয়নে ইউনাইটডে। অন্য ক্লাব থেকে কাউকে এনেও ভালো ব্যবসা করার রেকর্ড আছে।

উরুগুইয়ান তারকা লুইস সুয়ারেজকে সাড়ে ৭ মিলিয়ন ডলারে গ্রোনিংগেন থেকে কিনে চার বছর পর ১৫ মিলিয়ন লাভে বিক্রি করেছে লিভারপুলের কাছে। হাকিম জিয়েশকেএফসি টোয়েন্টে থেকে আনা হয়েছিল ১১ মিলিয়নে, পরে তাঁকে চেলসিতে বিক্রি করা হয় ৪৪ মিলিয়নে।

লিল
সর্বোচ্চ কেনা: জোনাথন ডেভিড (২৭ মিলিয়ন ইউরোয় গেন্ট থেকে)
সর্বোচ্চ বিক্রি: নিকোলাস পেপে (৮০ মিলিয়ন ইউরোয় আর্সেনালের কাছে)

ফরাসি লিগের এই ক্লাবকে বলা যায় প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলার জোগানদাতা। খেলোয়াড় বিক্রি করা ক্লাবগুলোর মধ্যে গত এক দশকে ইংলিশ লিগকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খেলোয়াড় দিয়েছে ২০২০-২১ মৌসুমে লিগ আঁ জেতা ক্লাবটি। যেমন নিউক্যাসলের কাছে ইয়োহান কাবায়ে ও ম্যাথু দিবুশি, অ্যাস্টন ভিলার কাছে ইদ্রিসা গেয়ে ও আনওয়ার এল গাজী।

টাকার অঙ্কে এখন পর্যন্ত লিলের সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি করা খেলোয়াড় হচ্ছে নিকোলাস পেপে। তবে লাভের দিক থেকে বড় ব্যবসা হয়েছে মূলত নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ভিক্টর ওসিমেনকে দিয়ে। শারলোয়া থেকে ২২.৪ মিলিয়ন ইউরোয় কিনে আনা এই নাইজেরিয়ানকে নাপোলির কাছে ৭৫ মিলিয়ন ইউরোয় বিক্রি করে লিল।

দুটি ট্রান্সফারই ২০১৯ সালে। তবে ওশিমেনের জন্য পুরো টাকা একসঙ্গে পেলেও পেপের টাকা পাবে তারা পাঁচ বছরের কিস্তিতে। এক মৌসুম আগে লিগ শিরোপা জেতার পর বাইরে খেলোয়াড় বিক্রি আরও গতি পেয়েছে। চলতি গ্রীষ্মে এরই মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ইউরো অ্যাকাউন্টে ঢুকিয়ে ফেলেছে ক্লাবটি।

রেনাতো সানচেস

যা এসেছে নিউক্যাসলের কাছে সভেন বটমান (৩৭ মিলিয়নে), এভারটনের কাছে আমাদু ওনানা (৩৬ মিলিয়নে), পিএসজির কাছে রেনাতো সানচেজ (১৫ মিলিয়নে) এবং রোমার কাছে জেকি সেলিককে (৭ মিলিয়নে) বিক্রি করে। ফুটবলারদের পাশাপাশি সফল মৌসুমের প্রধান সারথি কোচ ক্রিস্তফ গালতিয়ের ও স্পোর্টিং ডিরেক্টর লুইস কাম্পোসও ট্রান্সফার হয়েছেন এবার পিএসজিতে।

সালজবুর্গ
সর্বোচ্চ কেনা: লুকাস গুরনা-ডুয়াথ, (১৩ মিলিয়ন ইউরোতে সেঁত-এতিয়েন থেকে)
সর্বোচ্চ বিক্রি: ব্রেন্ডন অ্যারনসন, (৩২.৯ মিলিয়ন ইউরোতে লিডসের কাছে)

শারীরিকভাবে শক্তিশালী, খেলার ধরন আক্রমণাত্মক, গতি ভালো, দম বড়—নির্দিষ্ট এই মানদণ্ডগুলো ধরে উদীয়মান ফুটবলারদের দলভুক্ত করে সালজবুর্গ। যার প্রমাণ অস্ট্রিয়ান এই ক্লাব দিয়েছে অ্যারনসন (লিডসের কাছে ৩২.৯ মিলিয়নে), আর্লিং হলান্ড (ডর্টমুন্ডের কাছে ২০ মিলিয়নে), করিম আদেয়েমি (ডর্টমুন্ডের কাছে ৩০ মিলিয়নে), প্যাটসন ডাকা (লেস্টার সিটির কাছে ৩০ মিলিয়নে), সাদিও মানে (সাউদাম্পটনের কাছে ২৩ মিলিয়নে) ও এনক মেপুকে (ব্রাইটনের কাছে ২৩ মিলিয়নে) বিক্রি করে।

সালজবুর্গ থেকে ডর্টমুন্ড ঘুরে হলান্ড এখন ম্যানচেস্টার সিটিতে

কেবল বাইরের ক্লাবকেই নয়, সালজবুর্গ খেলোয়াড় সরবরাহ করে রেড বুল অধিভুক্ত লাইপজিগকেও। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মূল প্রতিষ্ঠান একই হওয়ায় লাভের পরিমাণ তেমন থাকে না। ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সালজবুর্গের ২০ জনের বেশি খেলোয়াড়কে লাইপজিগে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যার মধ্যে আছেন নাবি কেইতা (৩০ মিলিয়ন), দমিনিক সোবোসলাই (২২ মিলিয়ন), আমাদু হাইদারা (১৯ মিলিয়ন), দায়ত উপামেকানো (১৮.৫ মিলিয়ন), বেঞ্জামিন সিসকো (২৪ মিলিয়ন)।