দুই ‘এলএম১০’–এর লড়াই আজ। ম্যাচ শেষে ফাইনালে ওঠার উচ্ছ্বাস নিয়ে মাঠ ছাড়বেন একজন
দুই ‘এলএম১০’–এর লড়াই আজ। ম্যাচ শেষে ফাইনালে ওঠার উচ্ছ্বাস নিয়ে মাঠ ছাড়বেন একজন

লড়াইয়ের নাম মেসি–মদরিচ

ট্রয় নগরীর ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে একিলিস চিৎকার করছিলেন, ‘হেক্টর! হেক্টর!’ ওদিকে নগরীতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ট্রয়ের রাজপুত্তুর হেক্টর। এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে কেউ একজন মরবে। হেক্টর পরিবারের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফটক খুলতে বললেন। ট্রয় সিনেমার পরের দৃশ্যটা সবার জানা।

তুমুল যুদ্ধের পর হেক্টরের লাশ ঘোড়ার সঙ্গে দড়িতে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন একিলিস। লুসাইল স্টেডিয়ামেও আজ রাতে অন্য দেহে, অন্য স্বরে হয়তো দেখা দেবেন ইলিয়ডের দুই বীর। ফুটবলের কল্পনাবিলাসী সমর্থক এমন ভাবতেই পারেন! লিওনেল মেসি ও লুকা মদরিচের মধ্যে কে হবেন হেক্টর আর কেই-বা একিলিস?

শেষ বাঁশি বাজার পর কেউ মরবে না। কেউ কারও লাশও নেবে না। তবু মৃত্যুর মতোই নিথর হয়ে উঠবে কোনো একজনের মুখ। বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল তো ট্রয়ের সেই যুদ্ধই! হারলেই ছাড়তে হবে এই রাজপাট, বিদায়! ফেরার সুযোগ নেই। অন্তত বয়স তা–ই বলছে—মেসির ৩৫, মদরিচের ৩৭।

আর দুই ধাপ পরই অমরত্বকে সামনে রেখে মরণকামড় দেওয়ার এটাই সময়। যিনি ‘মরবেন’, অর্থাৎ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হারবেন, ইতিহাস তাঁকেও মনে রাখবে। যেভাবে রেখেছে হেক্টরকে। আর একিলিস? মাঠে তাঁর চরিত্রাভিনেতার সঙ্গে ঘোড়া থাকবে না, বরং বুকে টেনে নেওয়ার উদাত্ত আহ্বানে তখন ‘হেক্টর’ হয়ে পড়া প্রতিপক্ষকে হয়তো বলবেন, বন্ধু, এটাই নিয়তি!

ব্রাজিলের বিপক্ষেও মদরিচ ছিলেন অপ্রতিরোধ্য

নিয়তি? মেসি ও মদরিচের সঙ্গে কথাটা বেশ মানানসই। ১ মার্চ ২০০৬। বাসেলে প্রীতি ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-২ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। সে ম্যাচে আর্জেন্টিনার জার্সিতে প্রথম গোল পান ১৮ বছর বয়সী মেসি। আবার সে ম্যাচেই ক্রোয়েশিয়ার জার্সিতে অভিষেক হয় ২০ বছর বয়সী মদরিচের। সেই নিয়তিই মাঝে দুজনকে আগেপিছে চলার পথ করে দিয়েছে।

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে হারে আর্জেন্টিনা, কিন্তু সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন মেসি। চার বছর পর রাশিয়া বিশ্বকাপের ফাইনালে হারল ক্রোয়েশিয়া, সেরা খেলোয়াড় হলেন মদরিচ। চার বছর পর আজ রাতে আবারও সেই মোক্ষধামের সন্ধানে দ্বিতীয় সুযোগ পাবেন তাঁদের মধ্যে যেকোনো একজন। কে সেই ভাগ্যবান? খেলার ধাঁচ আলাদা হলেও অর্জন ও অভিজ্ঞতায় কেউ কারও চেয়ে কম নন। একজন পূর্ব ইউরোপের চিরসবুজ মিডফিল্ডার।

মাঠের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তাঁকে দেখা যায় না। কী আক্রমণে, রক্ষণে, গোল বানানোয় কিংবা খেলা তৈরিতে—মদরিচ ক্রোয়েশিয়ার সব কাজের কাজি। ফরোয়ার্ড পেতকোভিচ তো বলেই রেখেছেন, মদরিচের কাছে পাস দেওয়া ‘ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়েও নিরাপদ’।

মেসির প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ডিয়েগো ম্যারাডোনার পর তিনি আর্জেন্টাইন ফুটবলের মানসপুত্র। ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে আকাশি-সাদাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি নিয়ে ঘুরছেন। ২০১০ গেল, ২০১৪–তে ফাইনালেও ওঠা হলো; কিন্তু হলো না। ২০১৮–তেও এমবাপ্পে-মদরিচের মঞ্চে ব্যর্থ। এবার শেষ দানে মাঠে নামার আগে সতীর্থরাই বলে রেখেছেন, তাঁর জন্য, মেসির জন্য জীবন দিয়ে দেব! আকাশি-সাদার প্রতিশ্রুতি নয়, শুধু মেসির জন্য শিরোপাটা জিততে চাওয়া—হেক্টরের এমন জনপ্রিয়তাই ছিল তাঁর সৈন্যসামন্তদের মধ্যে।

ট্রয় যদি হয় হেক্টরের, গ্রিস যদি একিলিসের—আর্জেন্টিনাও মেসির, ক্রোয়েশিয়াও মদরিচের। দুজনই নাম্বার টেন—দলের প্রাণভোমরা। সবাই জানে, দুটি দলের প্রাণপাখিকে বিকল করতে পারলে প্রাণবায়ু নির্গত হতেও বেশি সময় লাগবে না। মেসিকে কখনো কখনো ভিনগ্রহের বলা হয়, মদরিচ এই মাটির পৃথিবীর সেরাদের একজন। মিলটা দেখুন, দুজনই দলে অপরিহার্য।

আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি বিশ্বকাপ নিজের করে নিচ্ছেন

অভিজ্ঞতাটা দেখুন একবার—বিশ্বকাপে ২৪ ম্যাচে ১০ গোল মেসির। দেশের হয়ে বিশ্বকাপে ম্যাচ খেলায় রেকর্ড গড়েছেন আগেই। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে পেছনে ফেলে গোলের রেকর্ডটি একার করে নেওয়ার হাতছানি সামনে। মদরিচ মেসির চেয়ে একটি বিশ্বকাপ কম খেলেছেন। চার বিশ্বকাপে ১৭ ম্যাচে ২ গোল। ক্রোয়েশিয়ার হয়ে বিশ্বকাপে তাঁর বেশি ম্যাচ আর কেউ খেলেননি।

ইতিহাসও ‘ক্রোয়েশিয়ান ক্রুইফ’–এর পক্ষে। ক্লাব ও জাতীয় দল মিলিয়ে এ পর্যন্ত ২৭ বার মেসির মুখোমুখি হয়ে ১২ বার জিতেছেন মদরিচ। ৫ ড্র ও ৯ হার। জাতীয় দলের হয়ে দুজনের মুখোমুখি লড়াইয়ে মদরিচ ২-০ ‘গোলে’ এগিয়ে। ২০০৬ সালে বাসেলের সেই ম্যাচের পর ২০১৮ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ক্রোয়েশিয়ার কাছে ৩-০ গোলে হেরেছিল আর্জেন্টিনা। মদরিচ গোলও করেছিলেন সে ম্যাচে।

অথচ সে স্মৃতি মনে করে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠা নয়, আজকের ম্যাচের আগে মদরিচ বললেন মেসির কথা, ‘মেসি অনেক বড় মাপের খেলোয়াড়। তাকে থামানো কঠিন হবে। তবে আমরাও প্রস্তুত। আশা করি, ফাইনালে উঠতে সেটুকু পর্যাপ্ত হবে।’

মদরিচের এ কথায় বিনয় নয়; বরং অনুচ্চারে একিলিসের সেই ‘হেক্টর! হেক্টর!’ ডাকের প্রতিধ্বনিই শোনা যায়। আজ রাতে সেই ‘হেক্টর’ যখন ময়দানে নামবেন, তখন লড়াইটা যতটা না আর্জেন্টিনা-ক্রোয়েশিয়ার থাকবে, তার চেয়েও বেশি ছাপ রাখবে ‘এলএম১০’ বনাম ‘এলএম১০’।