নিকলাস ফুলক্রুগটা আবার কে?
দুই সপ্তাহ আগে অনেক জার্মানেরই প্রশ্ন ছিল এটি। জাতীয় দলে দূরে থাক, বুন্দেসলিগাতেই যাঁকে নিয়মিত দেখা যায়নি। খেলেন না বড় কোনো ক্লাবেও। হান্সি ফ্লিকের বিশ্বকাপ দলে নাম দেখে তাই কৌতূহল ছিল অনেকেরই। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে শুধু জার্মানরা নন, ফুলক্রুগকে চেনেন এখন সারা বিশ্বের দর্শকেরাই।
কাতার বিশ্বকাপে ধুঁকতে থাকা জার্মানিকে ‘লাইফলাইন’ এনে দিয়েছেন যে ২৯ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডই। জাপানের কাছে হেরে খাদের কিনারে চলে যাওয়া জার্মানি ফুলক্রুগের গোলেই স্পেনের সঙ্গে ১-১ ড্র করে শেষ ষোলোর আশা বাঁচিয়ে রেখেছে।
অথচ গত বছরের অক্টোবরেও ফুটবলই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন ফুলক্রুগ। ভেরদার ব্রেমেন তখন জার্মান লিগের দ্বিতীয় স্তরে। শীর্ষ স্তরে ফেরার লড়াই করবে কি, উল্টো টানা হারে অবস্থান পয়েন্ট তালিকায় নেমে গেছে ১০ নম্বরে। ফুলক্রুগও নিজের ওপর হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। ১০ ম্যাচেও গোল নেই। ওই সময় স্পোর্টিং ডিরেক্টর ক্লেমেন্স ফ্রিটজের সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়ে খেলাই ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু রক্তে যাঁর ফুটবল, ফুটবল কি তাঁকে ছাড়ে!
পেশাদার ফুটবলে খেলেছেন বাবা, দাদা দুজনই। তাঁর বোন এখনো হ্যানোভার ৯৬-এ খেলেন। ভেরদার ব্রেমেনের হয়ে পেশাদার ক্যারিয়ারের শুরু ফুলক্রুগের। খেলেছেন জার্মানি অনূর্ধ্ব-১৯ আর অনূর্ধ্ব-২০ দলেও। কিন্তু চোট আর ফর্ম মিলিয়ে তাল ধরে রাখতে পারেননি। বারবার ক্লাব বদল করেছেন, হারিয়েছেন ক্যারিয়ারের গতিও।
ব্রেমেনের পর ন্যুরেমবার্গ, হ্যানোভার ঘুরে আবার ব্রেমেনে যোগ দেন ২০১৯ সালে। দুই বছর বুন্দেসলিগায় খেলার পর ২০২১-২২ মৌসুমে ক্লাবটি দ্বিতীয় স্তরে নেমে যায়। তারপর তো একপর্যায়ে খেলাই ছেড়ে দেওয়ার ভাবনা। তবে ক্যারিয়ারে নতুন ভোর আনার জন্য চ্যালেঞ্জ নেন ২৮ বছর বয়সে।
ভেতরের সেই তাড়নাই যেন বদলে দেয় তাঁকে। বুন্দেসলিগার দ্বিতীয় স্তরে ৩৩ ম্যাচে করেন ১৯ গোল। ব্রেমেনও উঠে আসে বুন্দেসলিগায়। এখানেই শুরু হয় ফুলক্রুগের দ্বিতীয় অধ্যায়। ব্রেমেনের হয়ে আগের দুই বুন্দেসলিগায় যেখানে ২৭ ম্যাচে ১০ গোল, এবার প্রথম ১৪ ম্যাচেই করেন ১০ গোল। জার্মান স্ট্রাইকারদের মধ্যে যা সর্বোচ্চ।
এমন দুরন্ত ছন্দের পরও অবশ্য জার্মানির বিশ্বকাপ দলে থাকবেন কি না, অনিশ্চয়তা ছিল। কখনো জাতীয় দলে খেলেননি। ২৯ বছর বয়সে বিশ্বকাপমঞ্চে প্রথম নামিয়ে দেওয়াও ঠিক হবে কি না, প্রশ্ন ছিল। প্রশ্ন ছিল হয়তো হ্যান্সি ফ্লিকের মনেও। তবে টিমো ভেরনারের চোট ফ্লিকের ভাবনা সহজ করে দেয়। প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পেয়ে যান ফুলক্রুগ।
বিশ্বকাপ খেলতে কাতারে যাওয়ার আগে ওমানে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল জার্মানি। সেই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে ইউসুফা মুকোকোর বদলি নামানো হয় ফুলক্রুগকে। অভিষেকের ৩৫ মিনিটেই গোল এনে দেন দলকে। ওমানের বিপক্ষে জার্মানি জেতে ১-০ ব্যবধানে।
পরে বিশ্বকাপে জার্মানির প্রথম ম্যাচ জাপানের বিপক্ষেও খেলেন বদলি হিসেবে। যেমনটা নামেন রোববার রাতে স্পেনের বিপক্ষেও। টমাস মুলারের বদলি নামার ১৩ মিনিটেই আবারও ত্রাতা ফুলক্রুগ। ১ গোলে পিছিয়ে থাকা জার্মানি ম্যাচে আনে সমতা। যে সমতা চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের দেয় বিশ্বকাপে টিকে থাকার প্রাণশক্তিও।
জার্মান জার্সিতে তিন ম্যাচে বদলি নেমেই দুটিতে দল উদ্ধার করা গোলের পর ফুলক্রুগকে শুরুর একাদশে নামানোর দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। যে দাবির পক্ষে আওয়াজ তোলাদের মধ্যে আছেন লোথার ম্যাথাউস, মাইকেল বালাকের মতো নাম।
২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী টনি ক্রুজ তো ফুলক্রুগের মধ্যে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলের মালিক মিরোস্লাভ ক্লোসা আর মারিও গোমেজের ছায়াও খুঁজে পাচ্ছেন, ‘আমাদের দলে সব সময়ই মিরো (ক্লোজা) আর গোমেজের মতো কেউ না কেউ ছিল। যে কিনা গোলের জন্য জায়গামতো অবস্থান নিতে পারে। আমার মনে হয়, ফুলক্রুগও ম্যাচ পরিস্থিতিতে দলকে সহায়তা করার মতো তেমনই একজন। হ্যান্সি ফ্লিক নিশ্চয় সেটা জানেন।’
জানেন তো নিশ্চয়ই। ফুলক্রুগকে গোটা বিশ্বই যখন জানে!