২০০৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই কোনো না কোনো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছেন
২০০৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই কোনো না কোনো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছেন

ডর্টমুন্ডে নেই ব্রাজিলিয়ান, তাহলে কি রিয়ালই চ্যাম্পিয়ন

বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি ফুটবলপ্রেমী প্রতিবছর যে বিশেষ ম্যাচটি দেখার অপেক্ষায় থাকেন, সেই ম্যাচ আসতে মাত্র দুই দিন বাকি। আগামী শনিবার রাতে লন্ডনের ঐতিহাসিক ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মুখোমুখি হবে রিয়াল মাদ্রিদ ও বরুসিয়া ডর্টমুন্ড।

রিয়ালের জন্য চ্যাম্পিয়নস লিগ জয় যেন নেশা। ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবলের শীর্ষ এই প্রতিযোগিতার অবিসংবাদিত রাজা তারা। স্প্যানিশ ক্লাবটি এবার ১৫তম বারের মতো ট্রফি উঁচিয়ে ধরার অপেক্ষায়। বিপরীতে ডর্টমুন্ড এখন পর্যন্ত একবারই চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছে; সেটিও সেই ১৯৯৭ সালে। এরপর জার্মান ক্লাবটি একবার ট্রফি-ছোঁয়া দূরত্ব থেকে ফিরে এসেছে; ২০১৩ সালে হয়েছিল রানার্সআপ।

এবারের মৌসুমেও বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের ফাইনালে ওঠা সবচেয়ে বড় চমক হয়ে এসেছে। ফুটবলের পরিসংখ্যানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘অপ্টা’ কোয়ার্টার ফাইনালের ড্রয়ের আগে ডর্টমুন্ডের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখিয়েছিল মাত্র ৫.৭৪%। সেই দলই সবাইকে চমকে দিয়ে শিরোপার লড়াইয়ে পৌঁছে গেছে। ম্যাটস হুমেলস-মার্কো রয়েস-নিকলাস ফুলক্রুগরা আর একবার জ্বলে উঠতে পারলেই ২৭ বছর পর ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পেয়ে যাবে ডর্টমুন্ড।

বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বর্তমান দলটিতে কোনো ব্রাজিলিয়ান নেই

কিন্তু ডর্টমুন্ড কি তা করে দেখাতে পারবে? শক্তি-সামর্থ্যের বিচারে রিয়াল নিরঙ্কুশভাবে এগিয়ে তো বটেই, ধারাবাহিক এক ইতিহাসও রিয়ালের পক্ষে। কী সেই ইতিহাস? দলে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার থাকা।

রিয়াল মাদ্রিদের বর্তমান দলটিতে আছেন তিনজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার—ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো ও এদের মিলিতাও। এই তিনজন ২০২২ সালে একসঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছেনও। তবে ডর্টমুন্ডের ৩২ সদস্যের বর্তমান স্কোয়াডে ১৩টি দেশের খেলোয়াড় থাকলেও নেই কোনো ব্রাজিলিয়ান।

ইতিহাস বলছে, ২০০৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত টানা ১৮ বছর যেসব ক্লাব চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছে, সেসব ক্লাবে অন্তত একজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার ছিলেন। দেড় যুগের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এবারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের ক্লাবের, মানে রিয়াল মাদ্রিদের!

শুধু কি তা–ই? এই শতকে শুধু একবারই কোনো দল ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার ছাড়া চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে। সাল মনে করিয়ে দিলে দলের নাম আর সেই ফাইনালের কথাও অনেকের মনে পড়ে যাবে।

২০০৫ সালে ইস্তাম্বুলের আতাতুর্ক অলিম্পিক স্টেডিয়ামে হওয়া মহাকাব্যিক ফাইনাল, যে ম্যাচে এসি মিলানের বিপক্ষে প্রথমার্ধে ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়েও অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে শিরোপা জিতে নেয় লিভারপুল। লিভারপুলের ওই প্রত্যাবর্তন ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুল’ নামে ফুটবল ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। কোচ রাফায়েল বেনিতেজের ফাইনালের সেই দলে ১২ দেশের ১৮ জন ফুটবলার থাকলেও কোনো ব্রাজিলিয়ান ছিলেন না।

বিস্ময়ের জন্ম দিয়ে ২০০৫ সালে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছিল লিভারপুল। লিভারপুলের ওই দলে কোনো ব্রাজিলিয়ান ছিলেন না

তবে অবিশ্বাসের ঘোর লাগিয়ে ফাইনালে হেরে যাওয়া মিলানের স্কোয়াডে ছিলেন ৪ ব্রাজিলিয়ান—কাকা, কাফু, দিদা ও সের্জিনিও; যাঁরা ২০০৭ সালের ফাইনালে বেনিতেজের লিভারপুলকে হারিয়েই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন।

এই শতাব্দীর প্রথম ৪ বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলগুলোতে ছিলেন কমপক্ষে দুজন করে ব্রাজিলিয়ান। ২০০৫ সালে লিভারপুল ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুলের’ জন্ম দেওয়ায় সেই ধারায় ছেদ পড়ে। এর ব্যাখ্যা তো একটু আগে করাই হলো। এর পর থেকে টানা ১৮ বছর ‘ব্রাজিলিয়ান-সৌভাগ্যের’ সুফল পেয়েছে ক্লাবগুলো। এ তালিকায় কিংবদন্তি রোনালদিনিও-কাকা-কাফু থেকে শুরু করে দানি আলভেজ-নেইমারদের মতো তারকা, এমনকি হালের ভিনিসিয়ুস, রদ্রিগো, আলিসন, এদেরসনরাও আছেন।

এই শতাব্দীর প্রথম ২৩ বছরে ব্রাজিলিয়ানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫ বার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতেছেন মার্সেলো ও কাসেমিরো; পাঁচবারই রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে। এই সময়ে একসঙ্গে তিন ব্রাজিলিয়ান দুবার শিরোপা জিতেছেন—মার্সেলো ও কাসেমিরোর সঙ্গে দানিলো।

হাতলের নকশা দেখতে অনেকটা বড় মাপের কানের মতো হওয়ায় কেউ কেউ চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফিকে ‘বিগ ইয়ার্স’ নামে ডাকেন। এই রুপালি ট্রফি সর্বোচ্চ পাঁচজন ব্রাজিলিয়ান একই মৌসুমে ছুঁয়ে দেখেছেন দুবার। বার্সেলোনার ২০০৬ শিরোপাজয়ী দলের রোনালদিনিও, এদমিলসন, জুলিয়ানো বেল্লেত্তি, থিয়াগো মোত্তা এবং সিলভিনিও। আর রিয়ালের ২০২২ শিরোপাজয়ী দলের মার্সেলো, কাসেমিরো, ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, রদ্রিগো এবং এদের মিলিতাও।

একজন করে ব্রাজিলিয়ান ছিলেন আলাদা ৬ বছর—অ্যান্ডারসন (২০০৮, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), সিলভিনিও (২০০৯, বার্সেলোনা), দাভিদ লুইজ (২০১২, চেলসি), ফিলিপে কুতিনিও (২০২০, বায়ার্ন মিউনিখ), থিয়াগো সিলভা (২০২১, চেলসি) ও এদেরসন (২০২৩, ম্যানচেস্টার সিটি)। এই ৬ জনের মধ্যে একটা জায়গায় ব্যতিক্রম কুতিনিও। একসময়ের এই তারকা ফুটবলার বার্সা থেকে বায়ার্নে ধারে খেলতে গিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন।

চ্যাম্পিয়নস লিগের সূচনা হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। তখন থেকে প্রতিবছরই হয়েছে মহাদেশীয় এই প্রতিযোগিতা। রিয়াল মাদ্রিদ-বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের মধ্যকার এবারের ফাইনালটি আসরের ইতিহাসে ৬৯তম। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ৫১ জন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন, যা ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

ব্রাজিলের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার ১৮ জন ফুটবলার এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। আগামী শনিবার রিয়াল-ডর্টমুন্ড যে দলই জিতুক, আর্জেন্টাইনদের সংখ্যা ১৮–তেই আটকে থাকবে। কারণ, এবারের দুই ফাইনালিস্ট দলে যে কোনো আর্জেন্টাইন নেই!