বাফুফে স্ভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন
বাফুফে স্ভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন

সালাহউদ্দিন তাহলে আর কবে সরবেন

অনেকের মতেই কাজী সালাহউদ্দিন বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ফুটবল তারকা। কিন্তু সংগঠক ও ফুটবল প্রশাসক হিসেবে তাঁরাই হয়তো আবার তাঁকে পাস নম্বরও দিতে রাজি হবেন না।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি হিসেবে খেলোয়াড়ি জীবনের সেই অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি সালাহউদ্দিন। এই পদে ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত টানা ১৬ বছর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন তাঁর কাছে থাকা প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির মিল ঘটাতে।

ফুটবল ফেডারেশন থেকে সালাহউদ্দিনের পদত্যাগের দাবি উঠেছিল কয়েক বছর আগেই। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেটি এখন আরও জোরালো। কিন্তু সালাহউদ্দিন যেন সে দাবিকে পাত্তাই দিচ্ছেন না। উল্টো আগামী ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় বাফুফের নির্বাচনে ৫ম মেয়াদে সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘নির্বাচন করা আমার আধিকার। নির্বাচনে হেরে গেলে চলে যাব।’

নির্বাচন করার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু সালাহউদ্দিনের আর বাফুফে সভাপতি পদে নির্বাচন করার মতো অবস্থান আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন। কারণ, তাঁর সময়ে সাংগঠনিক ব্যর্থতার সঙ্গে বাফুফের ভাবমূর্তিতেও লেগেছে কালি।

আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে গত বছর এপ্রিলে বাফুফের বিরুদ্ধে ফিফা কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে। বাফুফের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম দুই বছর নিষিদ্ধ হয়েছেন। বাফুফের অর্থ কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগে সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদীকে ফিফা ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে যা নজিরবিহীন। সালাম অবশ্য রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই বাফুফের সহসভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।

১৬ বছর ধরে বাফুফে সভাপতির দায়িত্বে আছেন কাজী সালাহউদ্দিন

বাফুফেতে আর্থিক অনিয়মের অনেক অভিযোগ তুলেছিলেন প্রয়াত সাবেক তারকা ফুটবলার ও সাবেক সহসভাপতি প্রয়াত বাদল রায়। অভিযোগ যে ভিত্তিহীন ছিল না, ফিফার নেওয়া কড়া ব্যবস্থাতেই তা প্রমাণিত। এর দায় সভাপতি হিসেবে সালাহউদ্দিন এড়াতে পারেন না। বাফুফে প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়ে অস্বচ্ছতার নানা প্রশ্ন তুলে নির্বাহী কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ হোসেন মুন। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বাফুফেকে ২০ কোটি টাকার অনুদান দিয়েছিল।

কিন্তু প্রথমবার দেওয়া ১০ কোটি টাকা নিয়মিত নিয়মবহির্ভূতভাবে খরচ করে সমালোচনার মুখে পড়ে বাফুফে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক খরচাদির হিসাব বাফুফের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে বলে সাংবাদিকদের অনেকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সালাহউদ্দিন। কিন্তু তা কথার কথাই রয়ে গেছে।

দেশের কিংবদন্তি ফুটবলার হিসেবে সালাহউদ্দিনের কাছে প্রত্যাশা ছিল অনেক। ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে দেশকে ১৫০–এর ঘরে আনার আশা দেখিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কোথায় কী? ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ভুটানেরও (১৮২) নিচে। ২১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৪। একসময় বাংলাদেশের কাছে ৮ গোল খাওয়া মালদ্বীপও আছে ১৬৩তম অবস্থানে।

সালাহউদ্দিনের ১৬ বছরে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের র‍্যাঙ্কিং বেশির ভাগ সময়ই ছিল পড়তির দিকে

অথচ এই বাংলাদেশই ১৯৯৬ সালের ২৪ এপ্রিল ঘোষিত র‍্যাঙ্কিংয়ে ১৮১টি দেশের মধ্যে ১১০-এ অবস্থান করছিল। ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল সালাহউদ্দিন বাফুফে সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার ১৯ দিন আগে ঘোষিত র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ ছিল ১৮০-তে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে—এই চার মাস সেটি গিয়ে ঠেকে ১৯৭ নম্বরে।

র‍্যাঙ্কিংয়ে অবনতির সঙ্গে সালাহউদ্দিনের দীর্ঘ সময়ে সাফল্যহীন বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল। ২০০৫-এর পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে আর খেলা হয়নি। অথচ ২০০৩ সালে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপে।

এটা ঠিক যে অতীতের চেয়ে জাতীয় দল সুযোগ-সুবিধা বেশি পেয়েছে সালাহউদ্দিনের সময়ে। জাতীয় দলকে অনুশীলন ক্যাম্প করাতে কাতার, সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন। পাঁচ তারকা হোটেলে রেখেছেন। আয়োজন করেছেন অনেক আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ। তারপরও বাফুফে সভাপতি হিসেবে জাতীয় দলের ব্যর্থতার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই তাঁর।

জাতীয় দলের উন্নয়নে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেননি সালাহউদ্দিন। ছিল না কাজের ধারাবাহিকতা। বিদেশি কোচ এনেছেন আর বিদায় করেছেন। ২০২২ সালে সর্বশেষ কোচ হয়ে আসা হাভিয়ের কাবরেরা গত ১২ বছরে বাংলাদেশের ১২তম কোচ।

জাতীয় দলকে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা না থাকলেও হাভিয়ের কাবরেরাকে বাংলাদেশের প্রধান কোচ করে আনেন সালাহউদ্দিন

অথচ বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার আগে কাবরেরা জাতীয় দল দূরে থাক, কোনো ক্লাবেও কখনো প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেননি। একমাত্র টম সেইন্টফিট ছাড়া কোনো কোচেরই জাতীয় দলের কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না। জাতীয় দলের জন্য ভালো মানের কোচ আনার ক্ষেত্রে বাফুফে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে যথাযথ যোগাযোগের অভাবে। বাংলাদেশ জাতীয় দল যেন বিদেশি কোচদের অভিজ্ঞতা অর্জনের পরীক্ষাগার হয়ে দাঁড়িয়েছে!

অথচ জাতীয় দল নিয়ে ব্যস্ততায় অনেক কিছুই উপেক্ষিত থেকেছে। দেশের ফুটবল শক্ত ভিত্তি পায়নি। বাফুফের নিজস্ব একটা একাডেমি হয়নি আজও। ফিফার অর্থায়নে সিলেট বিকেএসপিতে একাডেমি করা হলেও বাফুফের পরিকল্পনাহীনতা আর অব্যবস্থাপনায় কিছুদিন পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। কমলাপুর স্টেডিয়ামে ৫০-৬০ জন ছেলে নিয়ে সম্প্রতি আবাসিক ক্যাম্প চালু করেছে বাফুফে। এটাকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাফুফের এলিট একাডেমি।’ অথচ একাডেমি শব্দটাই এর সঙ্গে যায় না।

এত বছর বাফুফেতে থেকেও সালাহউদ্দিন পারেননি ক্লাবগুলোকে দিয়ে একাডেমি করাতে। খেলোয়াড় তৈরিতে অনাগ্রহী ক্লাবগুলোকেও সঠিক পথে আনতে পারেননি। খেলোয়াড় আসে জেলা থেকে। সেই জেলা লিগগুলো চরমভাবে অনিয়মিত। ঢাকার পাশের জেলা নায়ায়ণগঞ্জে ছয় বছর ধরে ফুটবল লিগ হয় না। সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বাফুফে এর কোনো খোঁজও রাখেনি। বাফুফে যেন ঢাকা ফুটবল ফেডারেশন হয়েই রয়ে গেছে!

সারা দেশের ফুটবল জাগানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সালাহউদ্দিন ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাফুফের জেলা লিগ কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। কিন্তু গত দুই বছরে এই কমিটির কোনো সভা হয়েছে বলে জানা নেই।

জেলা লিগ আয়োজনে দু-তিনবার জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে অর্থ দিয়েছেন সালাহউদ্দিন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনগুলো সক্রিয় করতে পারেননি। লিগ না করলে শাস্তি দিতে পারতেন সংশ্লিষ্ট জেলাকে। অনেকের মতে, সেটা করেননি নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই। ফলে জেলার কর্মকর্তারা গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়েছেন। তাঁদের অনেকেই বাফুফের নির্বাচনের সময় ঢাকায় এসে ‘উপঢৌকন’ নিয়ে বাড়ি ফেরেন বলে গুঞ্জন আছে।

বাফুফের বর্তমান কমিটির বেশির ভাগ সদস্য আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ

ঢাকার নিচের দিকে লিগগুলোর প্রতিও নজর দেওয়া হয়নি। অনিয়মিত হয়ে পড়েছে এসব লিগ। তবে পেশাদার লিগটা নিয়মিত হয়েছে। এ জন্য এখন আর ফুটবলারদের আন্দোলন করতে হয় না, যেটি করতে হতো আগের সভাপতি বিএনএপির সাবেক সাংসদ এস এ সুলতানের আমলে। ঘরোয়া ফুটবলের সূচিতে একটা শৃঙ্খলা এসেছে। সালাহউদ্দিনের সময়ে দেশের নারী ফুটবল অনেক দূর এগিয়েছে। সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নারী জাতীয় দল।  

কিন্তু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ নিয়মিত হওয়া আর নারী ফুটবলের সাফল্যই সব নয়। দেশের সামগ্রিক ফুটবল–কাঠামো নড়বড়েই রয়ে গেছে। সংস্কারের নামে তিন বছর ধরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে খেলা বন্ধ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে সালাউদ্দিনের কাছে প্রত্যাশা ছিল, ফুটবলের জন্য নতুন একটা স্টেডিয়াম তিনি আনতে পারবেন। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ তিনি। জাতীয় বাজেটে সরকারের কাছে একবার ৪০০ কোটি টাকা চেয়েছিল বাফুফে। পরে তা নেমে আসে ২০০ কোটিতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পায়নি এক টাকাও। বাফুফের প্রতি কোথাও যেন একটা আস্থাহীনতা ছিল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়েরও।

নানা জটিলতায় আটকে আছে ফিফার অর্থায়নে কক্সবাজারে ফুটবল কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ। বাফুফে ভবনসংলগ্ন মাঠ, কমলাপুর স্টেডিয়ামের টার্ফ ব্যবহারের অনুপযোগী। নতুন টার্ফ দেবে ফিফা, কিন্তু কাজ চলছে ধীরে। ভুটানের মতো দেশ ফিফা থেকে বেশ কয়েকটি পূর্ণাঙ্গ টার্ফ নিতে পারলেও বাংলাদেশ আনতে পেরেছে মাত্র দুটি। সালাহউদ্দিনের সময়ে দৃশ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন বলতে বাফুফে ভবন চত্বরে ফুটবলারদের জন্য একটা জিম হয়েছে। সালাহউদ্দিন অবশ্য বলেন, ‘আমি কি ভিক্ষুক নাকি যে ভিক্ষা করব!’

সালাহউদ্দিনের পদত্যাগের দাবি তুলেছে ‘ফুটবল বাংলাদেশ আলট্রাস’

সালাহউদ্দিন পারতেন দেশের ফুটবলের চেহারাটা বদলে দিতে। ফিফা-এফসিসহ ফুটবল–বিশ্বের তাঁর পরিচিতি আছে। ১৫ বছর ধরে তিনি সাফেরও সভাপতি। কিন্তু বাফুফে সভাপতি হিসেবে পাওয়া তাঁর এই পরিচিতি বাংলাদেশের ফুটবলের কাজে আসেনি। সভাপতি হওয়ার পর শুরুর দিকে বড় বড় স্পনসর আনলেও পরে সেসব স্পনসর ফুটবলের সঙ্গে থাকেনি। অভিযোগ আছে, বাফুফের কর্মকাণ্ড তাদের কাছে অস্বচ্ছ মনে হয়েছে।

কাজী সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে অনেক কিছুই পেতে পারত বাংলাদেশের ফুটবল। কিন্তু সে প্রত্যাশা বাস্তব হয়ে ধরা দেয়নি। তবু যে তিনি চাইছেন আরও একবার বাফুফের সভাপতির চেয়ারে বসতে, সেটি কেবল বিস্ময়েরই জন্ম দেয়। এত ব্যর্থতার পরও যখন ক্ষমতার প্রতি তাঁর এই মোহ প্রশ্ন জাগায়—সালাহউদ্দিন তাহলে সরবেন কবে?