দক্ষিণ এশিয়া জয় করার পর কাল কাঠমান্ডুতে ফুরফুরে মেজাজেই ঘুরে বেড়িয়েছেন সাবিনারা
দক্ষিণ এশিয়া জয় করার পর কাল কাঠমান্ডুতে ফুরফুরে মেজাজেই ঘুরে বেড়িয়েছেন সাবিনারা

সাফ চ্যাম্পিয়ন

যেভাবে শুরু স্বপ্নযাত্রার

শুরু থেকে অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়েই আজকের জায়গায় এসেছে বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল। মেয়েদের ফুটবলকে এ পর্যন্ত আনতে শুরু থেকে যাঁরা সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁরা বলেছেন তাঁদের প্রতিকূলতা জয় করার কথা—
কামরুন নাহার ডানা

স্পনসররাও তখন ভয় পেত

কামরুন নাহার ডানা

সাবেক খেলোয়াড় ও সংগঠক

২০০৩–০৮ সাল পর্যন্ত নারী ফুটবল নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কখনোই ভুলব না। শুরুতে মৌলবাদীদের নানা হুমকিতে স্পনসররাও আসতে চাইত না। আমি তখন বাফুফের মহিলা কমিটিতে ছিলাম। বাফুফের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক হেলাল ভাইয়ের সঙ্গে দেশের একটা নামী করপোরেট প্রতিষ্ঠানে গিয়েছিলাম স্পনসরশিপের ব্যাপারে। কিন্তু মেয়েদের ফুটবলের পাশে দাঁড়ালে মৌলবাদীদের রোষানলে পড়ার শঙ্কার কথা বলে সেই প্রতিষ্ঠান আমাদের না বলে দিয়েছিল। কষ্ট পেয়েছিলাম অনেক। বাফুফেও তখন ভয় পেয়ে যায়।

সেই ভয়কে জয় করে ২০০৪ সালে ঢাকায় বাফুফের উদ্যোগে মেয়েদের প্রথম টুর্নামেন্ট হয়েছে। ২০০৬ সালে মহিলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে মেয়েদের টুর্নামেন্ট করি। আমি তখন মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা। বাফুফে এবং মহিলা ক্রীড়া সংস্থার হয়ে কাজ করে দেখেছি মেয়েদের ফুটবল শুরুর সময়ের নানা প্রতিকূলতা। মৌলবাদীদের মিছিল-মিটিং আর নানা হুমকিকেও আমরা ভয় পাইনি। মেয়েদের দল আজ দক্ষিণ এশিয়ার সেরা, এটা ভাবতেই ভালো লাগছে।

মাহফুজা আক্তার

মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করেছি নিরন্তর

মাহফুজা আক্তার

বাফুফের মহিলা কমিটির প্রধান ও ফিফা কাউন্সিল সদস্য

২০০৮ সালে আমি বাফুফের মহিলা ফুটবল শাখার সঙ্গে যুক্ত হই। তখন মেয়েদের ফুটবল নিয়ে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ২০১১ সালের শেষ দিকে আমি নিজের মতো করে দায়িত্ব নিয়ে কাজে নামি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশালের আর্থিক সহায়তায় প্রতিভা খুঁজে এনেছিলাম আমরা। আজকের সানজিদা, কৃষ্ণারা সেই প্রতিভা অন্বেষণেরই ফল।

তিন মাস ক্যাম্প হয়েছে তখন প্ল্যানের খরচে। এরপর আর্থিক সংকট দেখা দেয়। ২০১২–১৫ সাল পর্যন্ত স্পনসর না থাকায় আমার ও বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের ব্যক্তিগত আর্থিক অনুদানে ক্যাম্প চলে। ওদের জন্য শিক্ষাও নিশ্চিত করি। এই মেয়েদের তিনজন এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেয়েদের তখন থেকেই আমি নিরন্তর উদ্বুদ্ধ করে চলেছি। ওদের বলেছিলাম, বড় হতে চাও না? চাইলে ফুটবলকে পেশা হিসেবে নাও। ওরা সেটা নিয়েছে বলেই আজ এই সাফল্য। ২০১৪ সালে আমার ক্যানসার ধরা পড়ে। ব্যাংককে কেমো নিয়ে পরদিন ডাক্তারের বাধা উপেক্ষা করে জাপান গিয়ে সেখানকার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে সহায়তা এনেছি। এভাবে অনেক কষ্ট করেই আমাদের এগোতে হয়েছে।

মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন

খেলতে দিতে চাননি অভিভাবকেরা

মোহাম্মদ মফিজ উদ্দিন

কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক সহকারী শিক্ষক

সাফজয়ী দলটিতে কলসিন্দুরের মেয়ে আছে আটজন। এদের নিয়েই শুরু করেছিলাম ২০১১ সালে। সেই সময়ের কথা বলতে গেলে শেষই হবে না।

তখন এই মেয়েরা হাফপ্যান্ট পরত। অভিভাবকেরা মেয়েদের খেলতে দিতে চাইতেন না। এলাকাবাসী অনেক কটু কথা বলত। কিন্তু এসব কোনো বাধাই হতে পারেনি।

প্রথমবার আমি অনুশীলনে নেমেছিলাম ২৫-৩০ জন মেয়ে নিয়ে। তবে অনুশীলন শেষে ওদের খাওয়াদাওয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

তহুরা খাতুন তখন মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ওর দাদা ছিলেন একজন হাজি, তার দুলাভাই একজন হাফেজ। তাঁরা তহুরাকে খেলতে দিতে চাইতেন না। অনেক কষ্ট করে রাজি করাতে হয়েছে তাঁদের।

সানজিদা, মারিয়া, মার্জিয়া, শিউলিরাও অনেক ছোট ছিল তখন। অনেকে এখন আর জাতীয় দলে নেই।

নাজমার কথা মনে পড়ছে, ওকে তো তখন খেলতে দেবে না, মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেবে পরিবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সেটা আটকাতে পেরেছিলাম।

খুরশিদা খুশি

একটা স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম

খুরশিদা খুশি

সাবেক অ্যাথলেট ও ফুটবলার

বাফুফে একাদশ নামে ২০০৩ সালে প্রথম অলিখিত বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল গঠন করা হয়েছিল। দলটির অধিনায়ক ও স্ট্রাইকার ছিলাম আমি। আমরা ভারতের একটা দলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলি মিরপুর স্টেডিয়ামে। ফুটবলে তখন ছেলেদের রমমরা অবস্থা। ভেবেছিলাম, মেয়েদের ফুটবলও তেমনই হবে। অ্যাথলেটিকস থেকে তাই কিছুদিনের জন্য ফুটবলে চলে আসি। খুলনায় আমার পাশের বাড়ির ছেলে আবাহনীর ডিফেন্ডার প্রদীপ পোদ্দার আমাকে ফুটবল খেলতে উদ্বদ্ধু করেন।

তখন একটা স্বপ্ন নিয়ে ফুটবলে আসি। স্বপ্ন ছিল অন্যদেরও। সেই দলে খেলেছে ক্রিকেটার আদরী; হ্যান্ডবলের ডালিয়া, রিতা; ভলিবলের হাসি; সাইক্লিংয়ের শিলাসহ অনেকে। কিন্তু এর কিছুদিন পর ঢাকায় মেয়েদের টুর্নামেন্ট শুরু হলে কমলাপুর স্টেডিয়ামে মৌলবাদীরা আমাদের ওপর আক্রমণ করে। আমরা ফুটবল থেকে আস্তে আস্তে সরে গিয়ে নিজ নিজ খেলায় ফিরে গেলাম। আজ মেয়েরা সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে। কিন্তু ২০ বছর আগে যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটা পূরণ হয়নি। আন্তর্জাতিক সাফল্য পেলেও মেয়েদের ফুটবলের ঘরোয়া কাঠামোটা আজও দুর্বল।