পেপ গার্দিওলা এ বছর ম্যানচেস্টার সিটিকে ট্রেবল জিতিয়েছেন
পেপ গার্দিওলা এ বছর ম্যানচেস্টার সিটিকে ট্রেবল জিতিয়েছেন

‘অপ্রয়োজনীয়’ খেলোয়াড় বিক্রি করে সিটিকে ২৭৮৮ কোটি টাকা এনে দিয়েছেন গার্দিওলা

পেপ গার্দিওলা ম্যানচেস্টার সিটিতে এসে অঢেল অর্থ খরচ করতে পেরেছেন বলেই সাফল্যের চূড়ায় উঠেছেন। সিটিতে গার্দিওলার সব ট্রফির জন্যই খরচ করতে হয়েছে বিশাল অঙ্ক।

কথাগুলো সত্যি। কিন্তু এই সত্যির আড়ালেই আছে এখনকার ফুটবলের একটা বড় বাস্তবতাও। ভালো দল গড়তে হলে বিশ্বমানের খেলোয়াড় লাগবেই। আর উঁচু মাপের খেলোয়াড় কিনতে টাকা ঢালার বিকল্প নেই। তারপর সেই খেলোয়াড়দের ‘পালতে–পুষতেও’ দিতে হয় বড় অঙ্কের বেতন।

দলবদলবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘ফুটবল ট্রান্সফার্স’ বলছে, ২০১৬ সালে সিটির দায়িত্ব নেওয়ার পর সর্বশেষ মৌসুম পর্যন্ত দলবদলের বাজারে গার্দিওলা খেলোয়াড় কেনা বাবদ ১০৩ কোটি পাউন্ড (১৪ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা) খরচ করেছেন। তবে খেলোয়াড় বিক্রিও কম করেননি। এই সময়ে তিনি যত খেলোয়াড় বিক্রি করেছেন, সেটা বিয়োগ করলে মোট খরচ কমে আসে ৪৭ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডে (৬ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা)। মজার ব্যাপার হলো, শুধু ‘অপ্রয়োজনীয়’ খেলোয়াড় বিক্রি করেই ইংলিশ ক্লাবটিকে ২০ কোটি পাউন্ড (২ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা) এনে দিয়েছেন গার্দিওলা।

এই অপ্রয়োজনীয় বা অব্যবহৃত খেলোয়াড় আবার তিন ধরনের, যাঁদের গত ৭ বছরে অন্য ক্লাবের হাতে তুলে দিয়ে গার্দিওলা সিটিকে বিশাল লাভের মুখ দেখিয়েছেন— ১. গার্দিওলা কোচ হয়ে আসার আগে যাঁদের কেনা হয়েছিল, তাঁদের বিক্রি। ২. যাঁদের গার্দিওলা কিনেছিলেন, কিন্তু দরকার পড়েনি বলে বিক্রি। ৩. সিটির একাডেমি থেকে উঠে আসা ফুটবলার, যাঁদের গার্দিওলা মূল দলে জায়গা দেননি।

খেলোয়াড় বেচাকেনায় মুন্সিয়ানা দেখানো গার্দিওলার সাফল্যের অন্যতম কারণ

এই তিন ধরনের ফুটবলারের মধ্যে অনেক পরিচিত মুখও আছেন। জ্যাডন সাঞ্চো, দগলাস লুইজ, পাবলো মারি, জেরোনিমো রুল্লি, জ্যাসন ডেনায়ের, জেমস ট্রাফোর্ড, সেকো ফোফানা তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সিটির মূল দলে অভিষেক হওয়ার আগেই যাঁদের ক্লাব ছাড়তে হয়েছে। এ তালিকায় নতুন সংযোজন হতে যাচ্ছেন কার্লোস বোরগেস। সিটির একাডেমি থেকে উঠে আসা এই পর্তুগিজ উইঙ্গার এবারের দলবদলেই ওয়েস্ট হামে যোগ দিতে পারেন।

গার্দিওলা–যুগে সিটির মূল দলের হয়ে কোনো ম্যাচ না খেলেই ক্লাব ছেড়েছেন, এমন কজনকে নিয়ে এই আয়োজন—

জ্যাডন সাঞ্চো (১ কোটি পাউন্ড ➠ বরুসিয়া ডর্টমুন্ড)

গার্দিওলার সঙ্গে সাঞ্চোর এই মধুর সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি

গার্দিওলার সময়ে সিটির হয়ে কোনো ম্যাচ খেলতে না পারাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা ভাবা হয় জ্যাডন সাঞ্চো। তরুণ ইংলিশ উইঙ্গারকে নিয়ে গার্দিওলা প্রকাশ্যে হতাশা প্রকাশ করেন। ২০১৭ সালে তাঁকে ১০ কোটি পাউন্ডে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের কাছে বিক্রি করেন। ৪ বছর পর অবশ্য ম্যানচেস্টারেই ফেরেন সাঞ্চো। তবে সিটিতে নয়; তাদের নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ইউনাইটেডে।

দগলাস লুইজ (১ কোটি ২৫ লাখ পাউন্ড ➠ অ্যাস্টন ভিলা)

২০১৭ সালে ব্রাজিলের ক্লাব ভাস্কো দা গামা থেকে নিয়ে আসেন গার্দিওলা। তবে একটিবারের জন্যও মাঠে নামাননি। ওই বছরই তাঁকে ধারে পাঠান স্প্যানিশ ক্লাব জিরোনায়। ২০১৯ সালে ধারের মেয়াদ ফুরোলে বিক্রি করে দেন অ্যাস্টন ভিলার কাছে। পরবর্তী সময়ে ২ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে তাঁকে সিটির কাছে ফেরত পাঠাতে চেয়েছিল ভিলা। কিন্তু গার্দিওলা কখনোই আগ্রহ দেখাননি, রাজি হননি। গুঞ্জন আছে, এবারের দলবদলেই আর্সেনাল বা টটেনহামে যেতে পারেন ব্রাজিলের এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার।

পাবলো মারি (১ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড ➠ ফ্ল্যামঙ্গো)

১৩ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারে ১০ বার ক্লাব পাল্টাতে হয়েছে পাবলো মারিকে। বোঝাই যাচ্ছে, কোথাও থিতু হতে পারেননি। এই ১০ ক্লাবের মধ্য একটি ছিল ম্যানচেস্টার সিটি। এই স্প্যানিশ সেন্টার–ব্যাক একবার জানিয়েছিলেন, গার্দিওলার মতো অন্যতম সেরা কোচের সঙ্গে কথা বলতে চান বলেই সিটিতে আসতে চেয়েছিলেন। সিটিতে যোগ দেওয়ার পর বলেছিলেন, ‘(গার্দিওলার সঙ্গে) কথা বলে মনে হয়েছে, একদিন আমি তাঁর দলে খেলার সুযোগ পাব।’ কিন্তু সেই সুযোগ কখনো আসেনি। ২০১৯ সালে মারিকে ব্রাজিলের ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গোর কাছে বিক্রি করে দেন গার্দিওলা।

জেরোনিমো রুল্লি (৫৯ লাখ পাউন্ড ➠ রিয়াল সোসিয়েদাদ)

গার্দিওলার সিটিতে উপেক্ষিত রুল্লি আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন

আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন, ভিয়ারিয়ালের হয়ে জিতেছেন ইউরোপা লিগ। ইউরোপার ২০২০–২১ মৌসুমের সেরা একাদশেও নাম আছে। এখনো নেদারল্যান্ডসের সফলতম ক্লাব আয়াক্সের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক। অথচ এই জেরোনিমো রুল্লিকে শুরুতেই বাতিলের খাতায় তুলে দেন গার্দিওলা। মাত্র ৬ মাস ইংলিশ ক্লাবটিতে টিকতে পেরেছেন। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে ৪০ লাখ পাউন্ডে কিনে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ৫৯ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে তুলে দেওয়া হয় রিয়াল সোসিয়াদাদের হাতে। এখানে সিটির লাভ ১৯ লাখ পাউন্ড।

জ্যাসন ডেনায়ের (৮৯ লাখ পাউন্ড ➠ অলিম্পিক লিওঁ)

গার্দিওলা সিটির কোচ হয়ে আসার আগেই যে কজনকে কেনা হয়েছিল, তাঁদের একজন এই জ্যাসন ডেনায়ের। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির খেলোয়াড়। ২০১৬ সালে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে অভিষেকও হয়েছে। তবে সিটির হয়ে নয়, সান্ডারল্যান্ডের জার্সিতে। গার্দিওলা–পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে শুধু ধারেই খেলে বেড়াতে হয়েছে বেলজিয়ামের ডিফেন্ডারকে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ২০১৮ সালে ফরাসি ক্লাব অলিম্পিক লিওঁর কাছে বিক্রি করে দেন গার্দিওলা।

জেমস ট্রাফোর্ড (১ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড ➠ বার্নলি)

ইংল্যান্ডকে অনূর্ধ্ব–২১ ইউরো জেতানোর পথে অনন্য কীর্তি গড়েছেন জেমস ট্রাফোর্ড

ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় গোলরক্ষক ভাবা হয় জেমস ট্রাফোর্ডকে। ২০ বছর বয়সী তরুণ কদিন আগেই অনূর্ধ্ব–২১ ইউরো জিতেছেন। ৬ ম্যাচের সব কটিতে তাঁর নামের পাশে ক্লিনশিট! টুর্নামেন্ট ইতিহাসের একমাত্র গোলরক্ষক হিসেবে কোনো গোল না খাওয়ার কীর্তিটা শুধু তাঁর। সিটির একাডেমি থেকে উঠে আসা ট্রাফোর্ডকে মূল দলে আনার পর দুই বছর ধারে খেলতে পাঠান গার্দিওলা। সম্প্রতি তাঁকে ১ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডে বেচে দেন বার্নলির কাছে। সম্ভাব্য বোনাসসহ তাঁর চুক্তিমূল্য দাঁড়াবে ১ কোটি ৯০ লাখ পাউন্ড। গার্দিওলা–যুগে সিটির হয়ে অভিষেক না হওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে ট্রাফোর্ডের দামই এখন সবচেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে ট্রাফোর্ডকে বার্নলির কাছে বিক্রি করে চাহিদার চেয়ে ৩ গুণ লাভ করতে যাচ্ছে সিটি। বার্নলির কোচ আবার গার্দিওলারই সাবেক শিষ্য ভিনসেন্ট কোম্পানি

সেকো ফোফানা (২৫ লাখ পাউন্ড ➠ উদিনেসে)

এখন তাঁর বড় পরিচয় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সতীর্থ। ৩ বছরের চুক্তিতে ফরাসি ক্লাব লাস ছেড়ে আল নাসরে নাম লিখিয়েছেন সেকো ফোফানা। অথচ লাস আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলবে! তবে সৌদির টাকার কাছে চ্যাম্পিয়নস লিগও হয়তো তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে উঠেছিল। একসময় ম্যানচেস্টার সিটিতেও ছিলেন আইভরি কোস্টের এই মিডফিল্ডার। তবে গার্দিওলার কোচ হয়ে আসার পরেই ধারে খেলতে পাঠান। ২০২০ সালে বিক্রি করে দেন ইতালিয়ান ক্লাব উদিনেসের কাছে।

এই কজন ছাড়া আরও যাঁদের অপ্রয়োজনীয় ভেবে বিক্রি করেছেন গার্দিওলা, তাঁরা হলেন এনেস উনাল, অ্যারন ময়, হুয়ান লারিওস, ইয়াঙ্গেল হেরেরা, স্যাম এডোজি, ডার্কো জিইয়াবি, গাভিন বাজুনু, পেদ্রো পেরো, কো ইতাকুরা, দিয়েগো রোসা, মারলোস মোরেনো, আন্তে পালাভেরসা, হার্ভে গ্রিফিথস, ইভান ইলিচ, জ্যাক হ্যারিসন, চার্লি ম্যাকনেইল, ফেলিক্স কোরোইয়া, থিয়েরি অ্যামব্রোস, উরিয়েল আন্তুনা, বেঞ্জামিন গারে, জেরেমি ফ্রিমপং, টেইলর রিচার্ডস, রাব্বি মাটোন্ডো, আনগুস গান, রডনি কোঙ্গোলো, ওলারেনওয়াজু কায়োদে, অলিভিয়ের নটচাম, রুবেন সোবরিনো ও ফ্লোরিয়ান লাজেউঁ।

তাঁদের বাইরে যাঁরা ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে অল্প সংখ্যক ম্যাচ খেলেছেন, তাঁদেরও বিক্রি করেছেন গার্দিওলা। এই তালিকায় আছেন লুকাস এনমেচা (ম্যাচ : ৩ বিক্রি : ১ কোটি ১০ লাখ পাউন্ড), রোমেও লাভিয়া (ম্যাচ : ২ বিক্রি : ১ কোটি ৫ লাখ পাউন্ড), শিয়া চার্লস (ম্যাচ : ১ বিক্রি : ১ কোটি ৫ লাখ পাউন্ড) ও রনি লোপেস (ম্যাচ : ৫ বিক্রি : ৯০ লাখ পাউন্ড)।