দোহার আল তুমামা স্টেডিয়ামের টানেল ধরে চোখ মুছতে মুছতে মাঠ ছেড়ে যাচ্ছেন একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। কান্না যাঁর বাঁধ ভেঙেছে আরও আগে। সেদিনের সেই কান্নার দায় পুরোটা তাঁর নিজের ছিলও না। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মরক্কোর বিপক্ষে সেই ম্যাচে চেষ্টা করেছিলেন রোনালদো, বেঞ্চ থেকে নেমে সেদিন দলকে জেতাতে পারেননি।
কিন্তু গতকাল রাতে ফ্রাঙ্কফুর্টে পর্তুগাল যদি শেষ পর্যন্ত স্লোভেনিয়ার কাছে হেরে বিদায় নিত, তার দায় পুরোটাই হয়তো দেওয়া হতো রোনালদোকে। ম্যাচের ১০৫ মিনিটে পেনাল্টিতে গোল করতে ব্যর্থ হওয়ার পর দলের হারের সম্ভাব্য কারণ হওয়াটা যেন মানতেই পারছিলেন না রোনালদো। কাঁদলেন শিশুর মতো। শত সান্ত্বনাও যেন সেই কান্না থামাতে পারছিল না।
রোনালদোর এমন কান্না যেন ফিরিয়ে এনেছিল ২০১৬ সালের লিওনেল মেসিকেও। কোপা আমেরিকায় ব্যর্থ হওয়ার পর যেদিন মেসিও অঝরে কেঁদেছিলেন। পার্থক্য শুধু মেসি কেঁদেছিলেন দলের হারের পর আর রোনালদো ম্যাচের মধ্যেই কাঁদলেন অঝোর ধারায়। ভক্তদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দেওয়া কান্না! ম্যাচের মধ্যে বিদায়ের আশঙ্কায় এভাবে কাঁদলেও শেষ পর্যন্ত অবশ্য দিয়াগো কস্তার জাদুকরি হাতের ছোঁয়ায় টাইব্রেকার জিতে (৩-০) কোয়ার্টার ফাইনালের তীরে নৌকা ভিড়িয়েছে রোনালদোর পর্তুগাল।
৪০ ছুঁই ছুঁই রোনালদোর অঝর কান্নার ভেতর যেন বারবার একটা শব্দই শোনা যাচ্ছিল—মানুষ! রোনালদোর কথা বললে সবার আগে মনেও পড়ে এই শব্দ। রোনালদোকে কখনোই ভিন গ্রহের কেউ মনে হয়নি কিংবা মনে হয়নি অতিমানব কোনো সত্তাও। রাশিয়ার দুই মহান লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কি ও লিও তলস্তয়ের মধ্যে তুলনামূলক এক লেখায় আরেক প্রখ্যাত বাঙালি লেখক বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘তলস্তয় যেন বিরাট, প্রাচীন ও রহস্যময় এক বিগ্রহ, যাঁর সামনে দাঁড়ালে ভক্তিতে ও ভয়ে আমাদের মাথা নুয়ে আসে আর দস্তয়েভস্কিকে দেখামাত্র আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠি—দ্যাখো, এই যে মানুষ।’
সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থেও লিওনেল মেসি ও রোনালদোর মধ্যে তুলনায় দ্বিতীয় জনই মনে হয় খানিকটা বেশি মানুষ। মেসিকে মেসি হয়ে ওঠার জন্য এর পেছনে কঠোর পরিশ্রম ও নিরলস সংগ্রামের বিষয়টি যেমন সত্য, একই রকমভাবে তার প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভাকেও অস্বীকারের সুযোগ নেই। কিন্তু রোনালদোর পুরোটাই যেন পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় দিয়ে গড়া।
পেলে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, শচীন টেন্ডুলকার কিংবা রজার ফেদেরারের মতো অকল্পনীয় সৃষ্টিশীলতা নিয়ে জন্মানো বিস্ময়কর কোনো প্রতিভা নন রোনালদো। তিনি হচ্ছেন সেই মানুষ, যিনি সীমিত প্রতিভাকেও অসীম করে তুলতে পেরেছিলেন। এ স্রেফ পরিশ্রম ও নিষ্ঠার ফল। এটা দিয়েই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মেসি নামের এক অসামান্য প্রতিভাকে বছরের পর চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গেছেন। একজন সাধারণ মানুষের অনন্যসাধারণ হয়ে ওঠার শ্রেষ্ঠতম উদাহরণও ‘সিআর সেভেন’।
রোনালদো এমন একজন, যিনি আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের বলেন, পরিশ্রম করো আমার মতো হতে পারবে৷ তবুও আমরা জানি আমরা পারব না। সবাই পারে না। রোনালদো তাই যেন মানুষের মধ্যেই এক ‘অনন্য মানুষ’। অসীম প্রতিভা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনির্নেয় সত্তা।
‘গড ইজ রাউন্ড’ বইয়ে মেক্সিকান লেখক হুয়ান ভিলোরো রোনালদো সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সফলতার জন্য রোনালদোর তৃষ্ণা তাকে দিয়ে শুরু, তাকে দিয়ে শেষ।’ মূলত এই তৃষ্ণাই রোনালদোকে রোনালদো করে তুলেছে। ৪০ পেরিয়েও তাই রোনালদো ক্লান্ত হন না।
স্লোভেনিয়া ম্যাচের কথাই ধরা যাক। এই প্রথম ইউরোতে গ্রুপ পর্বে কোনো গোল না পেয়ে শেষ ষোলোর লড়াইয়ে নেমেছিলেন রোনালদো। তাই শুরু থেকেই গোলের জন্য তাঁর মরিয়া ভাব ছিল স্পষ্ট। শুরুতে বক্সের ভেতর শট মিস করার পর কিংবা ফ্রি–কিক নেওয়ার আগে চিৎকার করে নিজের সেই হতাশার প্রকাশও ঘটান পাঁচটি ব্যালন ডি’অর জেতা তারকা। এরপর ম্যাচ যতই এগিয়েছে এবং একের পর এক গোলবঞ্চিত হয়েছেন, সেই হতাশা যেন আরও জমাট বেঁধেছে, যা শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরিত হয়েছে পেনাল্টি মিস হওয়ার পর। তাই এটি শুধুই রোনালদোর গোল না পাওয়ার হতাশ অনুভূতির প্রকাশ নয়। ইউরোজুড়ে গোলের জন্য যে আকুতি এবং নিজেকে প্রমাণের যে তাড়না, সেটাও এতে স্পষ্ট হয়ে সামনে এসেছে।
পাশাপাশি এটি মানবীয় সীমাবদ্ধতারও প্রকাশ যেন। রোনালদো যে সময়টাতে পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় দিয়ে দুনিয়া মাত করেছিলেন, তা এখন অতীত। বয়স যে এক নির্মম সত্য! রোনালদোর সব নিবেদনের মধ্যে সেই বয়সই যেন বাধার এক দেয়াল তুলে দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু যে রোনালদো একসময় নিজের সামর্থ্যের সীমাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন, তিনি এত সহজে হার মানবেন কেন! এমনকি ঘুরে দাঁড়িয়ে টাইব্রেকারে গোল করাও কি সে প্রমাণ দিচ্ছে না? ম্যাচের মাঝে ভেঙে পড়ার মানুষটিই তো টাইব্রেকারে দলের প্রথম শটটি নিতে এগিয়ে এলেন।
এই ইউরোতে রোনালদোর লড়াইটা শেষ পর্যন্ত নিজের সঙ্গে। নিজের ক্লান্ত হতে থাকা পেশিগুলোর বিরুদ্ধে, যার একমাত্র জবাব হচ্ছে গোল, যা তিনি গ্রুপ পর্বে পাননি, পাননি স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে গতকাল রাতেও। কিন্তু কে জানে, কাল রাতের কান্নাই হয়তো সব কিছু গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নতুন করে উজ্জীবিত করে তুলবে রোনালদোকে। সেই রোনালদো, যিনি এক দিন প্রকৃতির সব নিয়মকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হয়েছেন আজকের রোনালদো। হয়েছেন মানুষের মধ্যেও অনন্য মানুষ। সব লেনদেন শেষ হয়ে গেলে ঝরে পড়ার আগে ইউরোয় নিজের শেষ আসরে শত নক্ষত্রের আলোয় রোনালদো আরেকবার জ্বলে ওঠতে পারেন কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।