ফ্রান্সের তারকা ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপ্পে
ফ্রান্সের তারকা ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপ্পে

তারা থেকে হবেন মহাতারা?

সারা রাত জ্বলেছে নিবিড়, ধূসর নীলাভ এক তারা, তারই কিছু রং নাও তুমি।

কবীর সুমনের গানটিতে কণ্ঠ মেলাতে পারেন তাঁর ভক্তরা। বিশ্বজোড়া ফুটবল রোমান্টিকদের বলতে পারেন—নীলাভ ওই তারা যেমন রং বিলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকজুড়ে, সেই রং গায়ে মেখে রঙিন আহ্লাদে ভাসছ তোমরা, তেমনি ফুটবলের বাঁকে বাঁকে আলো বিকিরণ করে যাওয়া আমাদের কিলিয়ান এমবাপ্পের আলোয়ও আনন্দস্নান করতে পারো! ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে তোমাদের স্বাগত।

এমবাপ্পে তো আসলে আগেই তারা। এবারের বিশ্বকাপে ফরাসি তারার ভক্তরা ফুটবল বিশ্বকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখছে তাঁর মহাতারা হওয়ার ক্ষণের সাক্ষী হতে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে এমবাপ্পের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতো। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব–১৯ ইউরোয় চোখধাঁধানো পারফরম্যান্স করে দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্স দলে ডাক পান ২০১৭ সালে, তারই পথ ধরে পরের বছর রাশিয়া বিশ্বকাপে।

মাত্র চার বছরই তো হলো, রাশিয়ায় জীবনের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নেমে কী করেছেন, তা এত দ্রুত কারও ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কাজান থেকে নিঝনি নভগোরোদ, সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সবুজ গালিচায় একের পর এক জাদু দেখিয়ে গেছেন। হ্যাঁ, আঠারোর বিশ্বকাপে উনিশের এমবাপ্পে তো জাদুকরই!

জাদুকর যেমন মঞ্চে তাঁর প্যান্ডোরার বাক্স থেকে একের পর এক জাদুর ঝলক বের করে আনেন, এমবাপ্পেও ২০১৮ বিশ্বকাপের একেকটা মঞ্চে সেভাবেই তাঁর অফুরন্ত প্রতিভার ভান্ডার থেকে বের করে এনেছেন একেকটি জাদুর ঝলক!

ফ্রান্সের জার্সিতে কিলিয়ান এমবাপ্পের গোল উৎসব

বিশ্বকাপে আবির্ভাবের ম্যাচে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেননি। তবে ফ্রান্সের দ্বিতীয় ম্যাচেই পেয়ে যান প্রথম বিশ্বকাপ গোল। কিন্তু এমবাপ্পের ছড়ানো এইটুকু রঙে রঙিন হয়নি বিশ্বজোড়া ফুটবলপিয়াসীদের মন। হয়তো তাই শেষ ষোলোতে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের আগে ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশমকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন—এমবাপ্পেকে কি তাহলে পুরো স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে না! প্রশ্নটির উত্তর দেশম দিয়েছিলেন এভাবে, ‘ও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারছে না!’

সাংবাদিকের প্রশ্ন আর দেশমের উত্তর—দুটিই হয়তো এমবাপ্পেকে তাতিয়ে দিয়েছিল ভীষণ। ফরাসিদের অমৃত এনে দিতে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে যেন নিজেকে মন্থন করলেন এমবাপ্পে। সেই মন্থন থেকে ফরাসিরা যেমন পেয়েছে অমৃত, আর্জেন্টিনা নীল হয়েছে কালকূট বিষে! তাঁর জোড়া গোলেই যে আর্জেন্টিনাকে ৪–৩ ব্যবধানে হারিয়ে শেষ আটে জায়গা করে নেয় ফ্রান্স। আর ওই জোড়া গোলেই পেলের পাশে। ব্রাজিলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপজয়ী ‘ফুটবল সম্রাট’ পেলের পর দ্বিতীয় টিনেজার হিসেবে বিশ্বকাপের এক ম্যাচে জোড়া গোল করেন ১৯ বছর বয়সী ফরাসি স্ট্রাইকার।

কে জানে, এরপর পেলেকে ছোঁয়ার নেশায় পেয়ে বসেছিল কি না! ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ফ্রান্সের ৪–২ গোলের জয়ে আবারও লক্ষ্যভেদ। এবার পেলের পাশে বসলেন দ্বিতীয় কিশোর ফুটবলার হিসেবে ফাইনালে গোল করার কীর্তিতে। সব মিলিয়ে বিশ্বমঞ্চে আবির্ভাবেই সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কার জয়। বয়সের বিবেচনায় এ কীর্তিতেও তিনি পেলের পর দ্বিতীয়!

এই বিশ্বকাপের শুরুটাও দারুণ হয়েছে এমবাপ্পের

এভাবেই ফুটবল–মহাকাশে জন্ম এমবাপ্পে নামের তারার। সেদিনের নবজাতক সেই তারা মরুর দেশ কাতারে পা রাখবেন মহাতারা হতে, আরেকবার পেলের পাশে বসতে। এমবাপ্পেকে কি পারবেন টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিততে? ১৯৫৮ সালের পর ১৯৬২ বিশ্বকাপ জিতে যে কীর্তি গড়েছিলেন পেলে।

এমবাপ্পে তারা থেকে মহাতারার তালিকায় নাম লেখাতে পারবেন কি না, তা বোঝার জন্য গত চার বছরে তাঁর ক্যারিয়ার–চক্রটা একটু ঘুরে আসা যায়। সেই চক্র প্রদক্ষিণের আগে ইংল্যান্ডের কবি উইলিয়ামস শেক্সপিয়ারের একটি কবিতা আওড়ে নিতে পারেন। যে কবিতায় কল্পিত স্বর্গীয় পাখি স্কাইলার্ক পৃথিবীতে জন্ম নিয়েও সুউচ্চ আকাশে উড়ে বেড়ায়। সেখানে উড়তে উড়তে যে গান গায়, যে কথা বলে; পৃথিবীর মানুষের জন্য সেটা নিখাদ বিনোদন, কখনো কখনো প্রেরণাও।

শেক্সপিয়ার কবিতার এক জায়গায় লিখেছেন—উঁচু থেকে আরও উঁচুতে...রক্তিমাভ আগুনের মেঘের মতো, গভীর নীলে ডানা মেলে, গান গেয়ে আরোহণ করো, গান গেয়ে আরও ঊর্ধ্বগামী হও। এমবাপ্পের এবারের যাত্রাও আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার। গত চার বছরকে যদি সে যাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করে নেওয়ার প্রস্তুতি ধরেন, এমবাপ্পের সেটা খুব ভালোই হয়েছে বলতে হবে। এই সময়ে ফ্রান্সের হয়ে সবচেয়ে বেশি ২০টি গোল করেছেন, পিএসজির জার্সি গায়েও এই চার বছরে দারুণ সফল—১৯০ ম্যাচে দলটির হয়ে করেছেন ১৬৭টি গোল। চলতি মৌসুমেও তো দারুণ ছন্দে।

কিলিয়ান এমবাপ্পে

বল নিয়ে এমবাপ্পের ভোঁ–দৌড় লাগানোর সময় তাঁর অবয়বের পেছনে রোনালদোর চেহারাটা ভেসে উঠতেই পারে অনেকের চোখের সামনে! আর তিনি যখন শরীরের ঝাঁকুনিতে প্রতিপক্ষ কোনো খেলোয়াড়কে বিভ্রান্ত করেন বা রক্ষণচেরা কোনো নিখুঁত পাস বাড়ান ধাবমান সতীর্থের দিকে, তখন হয়তো মেসির ছায়া দেখতে পান কেউ।

সব মিলিয়ে এমবাপ্পে তৈরি, মঞ্চও প্রস্তুত। এখন প্রয়োজন শুধু আলোর বিকিরণে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া। মহাতারার আলোতেই তো চোখ ঝলসায়! এখানে এসেও প্রশ্নটা আবার সামনে চলে আসছে—এমবাপ্পে পারবেন তো? প্রশ্নটি বারবার তোলার কারণ এই নয় যে এমবাপ্পে পারবেন না বলে সন্দেহ জাগছে মনে। আসলে এর আগে তারা থেকে মহাতারা হতে বিশ্বমঞ্চে এসেছিলেন অনেকেই। তীব্র আলোকচ্ছটায় ফুটবলপ্রেমীদের চোখ ঝলসে দেবেন কি, বড় বেরঙিন হয়ে ফিরে গেছেন পাংশু মুখ নিয়ে!

বিশেষ করে ২০০৬ বিশ্বকাপে রোনালদিনিওর কথাই ধরুন। ২০০২ সালে বিশ্বমঞ্চে আবির্ভাবের বছরই রাঙিয়েছেন বিশ্বকাপ। এরপর পিএসজি ও বার্সেলোনায় চারটি বছর কাটিয়েছেন স্বপ্নের মতো। এরপর ব্রাজিলিয়ান তারকা জার্মানিতে গিয়েছিলেন ইতিহাস হতে, হতে মহাতারকা। সব আয়োজনই সাজানো ছিল, বিশ্বকাপ তথা পুরো ফুটবল বিশ্বই অপেক্ষায় ছিল পেলে, ম্যারাডোনা, গারিঞ্চা, ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার...ফুটবলে অমরত্ব পাওয়া এই সব চরিত্রের তালিকায় রোনালদিনিওকে বরণ করে নিতে!

কিন্তু কী একটা বিবর্ণ বিশ্বকাপই না সেবার কেটেছে রোনালদিনিওর! জ্বলজ্বল করে জ্বলতে এসে জোনাকির আলোও ছড়াতে পারেননি। নীলাভ তারা নিজের মায়াবী আলোয় পৃথিবীকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে এসে বেদনার নীল বিষে নীলকণ্ঠ হয়ে ফিরেছেন! ব্রাজিলও সেবার শেষ আটে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়। মহাতারকা হতে না পারার ওই বিশ্বকাপের পর রোনালদিনিওর ক্যারিয়ারটাও যেন কিছুটা থমকে গিয়েছিল।

ফ্রান্স দলের সঙ্গেও সম্প্রতি স্পনসর ও ইমেজ স্বত্ব নিয়ে ঝামেলা হয়েছে এমবাপ্পের

রোনালদিনিওর মতো ফুটবল বিশ্ব অপেক্ষা করছে এমবাপ্পের অমরত্ব পাওয়া দেখতে! এখানে একটা ‘যদি’ অবশ্য আছে। সেই ‘যদি’ তাঁর মনের স্থিরতার বিষয়ে। মঞ্চে ওঠার আগে শিল্পীর মন যদি শান্ত না থাকে, তাহলে সেরা সুর তিনি পরিবেশন করবেন কীভাবে!

সাম্প্রতিক সময়ে এমবাপ্পের মন কিছুটা হলেও বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পিএসজির সঙ্গে সর্বশেষ করা চুক্তি আর্থিক দিক থেকে কত কী দিয়েছে তাঁকে! তিনি পিএসজিতে ‘একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী’ হয়েছেন বলে গুঞ্জন আছে। ওই চুক্তি এমবাপ্পেকে সর্বকালের সবচেয়ে দামি ফুটবলারও বানিয়েছে। এত কিছু দিলেও ওই চুক্তি কেড়ে নিয়েছে তাঁর মনের শান্তি। চুক্তিটি করার পর ওঠা গুঞ্জনের পথ ধরে নেইমারের সঙ্গে নাকি সম্পর্ক শীতল হয়েছে তাঁর। মাঠে যে এর প্রভাব কমবেশি পড়েনি, তা নয়। এ ছাড়া ফ্রান্স দলের সঙ্গেও সম্প্রতি স্পনসর ও ইমেজ স্বত্ব নিয়ে ঝামেলা হয়েছে এমবাপ্পের।

অমরত্ব পাওয়ার পথটা তো মোটেই সহজ হওয়ার কথা নয়! সে পথে বাধা থাকবে, ঝামেলা থাকবে—এসব পেরিয়েই তো বাজাতে হবে অমরত্বের মোহন–বাঁশি!