সমর্থকদের এই ভালোবাসা রেখে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের হয়তো যেতে ইচ্ছা করছিল না। এ কারণেই ম্যাচ শেষ হওয়ার অনেকক্ষণ পরও গ্যালারির সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান গাইতে গাইতে নেচে গেলেন লিওনেল মেসিরা। লুসাইলের গ্যালারি এদিন বলতে গেলে পুরোটাই নীল-সাদা। একটা গোলপোস্টের পেছনে ছোট্ট যে একটা অংশ কমলা হয়ে ছিল, তা ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উধাও।
এই বিশ্বকাপে মাঠের খেলায় কোন দল চ্যাম্পিয়ন হবে, কে জানে! তবে গ্যালারিতে আর্জেন্টিনা এরই মধ্যে চ্যাম্পিয়ন। ব্রাজিলের ম্যাচেও গ্যালারি হলুদ শর্ষেখেত হয়ে গেছে। তবে মাথার ওপর জার্সি দোলাতে দোলাতে আর্জেন্টাইনদের বিরামহীন নাচ আর গানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাধ্য কার! কী যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি এই সমর্থক দলের!
ম্যাচ শেষ হয়েছে দোহার সময় রাত একটার দিকে। এরপরও গ্যালারি ছাড়ার নাম নেই। রাত ১টা ৫০-এর দিকে ফিফার লোকজন গিয়ে বেরিয়ে যেতে না বললে হয়তো সারা রাতই এ উৎসব চলত। গ্যালারিতে থাকতে না দিলে কী হবে, স্টেডিয়াম চত্বরে থাকতে তো আর বাধা নেই। এই বিশ্বকাপের আটটি স্টেডিয়ামই বিশ্বকাপের জন্য নতুন বানানো। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়, লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে নতুন একটা উপশহরই বানিয়ে ফেলা হয়েছে। স্টেডিয়ামের বাইরে খোলামেলা বিশাল জায়গা। সেখানেই চলতে থাকল নীল-সাদা উৎসব। রাত তিনটার দিকে স্টেডিয়াম ছাড়ার সময়ও তা থামার কোনো লক্ষণ নেই।
আর্জেন্টিনার ম্যাচে গ্যালারিতে প্রচুর ব্যানার দেখে থাকবেন। মেসি-ম্যারাডোনার ছবি তো কমনই। এর বাইরে স্প্যানিশ ভাষায় নানা কিছু লেখা প্রচুর ব্যানার থাকে। বেশির ভাগই বুয়েনস এইরেসের কোনো না কোনো শহরতলির নাম। যে শহরতলি থেকে এসেছেন ওই সমর্থক দল। এর বাইরেও সেই ব্যানারে যে কত বৈচিত্র্য। পরশু লুসাইল স্টেডিয়ামের বাইরেই যেমন এমন একটা ব্যানারে চোখ আটকে গেল। কয়েকজন তরুণ সেই ব্যানার সামনে নিয়ে হেঁটে আসছেন। মেসি আর ম্যারাডোনা যথারীতি আছেন, কিন্তু ব্যানারে তৃতীয় যে ছবি, ওটা কার? ওয়াল্টার স্যামুয়েলের মতো দেখতে না?
হ্যাঁ, ওয়াল্টার স্যামুয়েলই। সাবেক আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার। কোচিং স্টাফের সদস্য হিসেবে আর্জেন্টিনার এই বিশ্বকাপ দলের সঙ্গেও আছেন। কিন্তু কী এমন হাতি-ঘোড়া ছিলেন যে মেসি-ম্যারাডোনার সঙ্গে তাঁর ছবি থাকবে! কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে ওই তরুণদের দল সগর্ব জানিয়ে দিল, ওয়াল্টার স্যামুয়েল তাঁদের শহরের ছেলে।
বিশ্বকাপে কোন দলের খেলা আছে, তা বুঝতে দোহার মেট্রোস্টেশন হলো সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। দলে দলে সমর্থকেরা প্রিয় দলের জার্সি পরে মেট্রোতে চড়ছেন। গত পরশু দুপুরের পর থেকেই মেট্রো হলুদ আর নীল-সাদা জার্সিতে ভরা। ব্রাজিলের সমর্থকেরা হাসতে হাসতে আর্জেন্টাইনদের খোঁচাচ্ছেন, ‘মেসি চাও?’ ‘মেসি চাও’ মানে ‘মেসি বিদায়’! তখন তো তাদের কল্পনাতেও নেই, কয়েক ঘণ্টা পরই আর্জেন্টাইনরা ‘ব্রাজিল চাও’ বলে এর জবাব দিতে পারবে!
২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের পর টানা পাঁচটি বিশ্বকাপে ইউরোপিয়ান প্রতিপক্ষের কাছে হেরে ব্রাজিলের বিদায়। কোয়ার্টার ফাইনাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রাজিলের জন্য কঠিনতম পরীক্ষা। ২০১৪ বিশ্বকাপ বাদ দিলে বাকি চারবারই তো কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায়। ২০১৪-তেও তো কোয়ার্টারেই লেখা হয়ে গিয়েছিল বিদায়ের পাণ্ডুলিপি। নেইমারকে হারিয়ে ছন্নছাড়া ব্রাজিলকে পেয়েই তো অমন প্রমত্ত রূপে দেখা দিতে পেরেছিল জার্মানি।
লুসাইলে ম্যাচ শুরুর আগেই ব্রাজিলের বিদায়ের খবর পেয়ে আরও উন্মাতাল আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা। নেদারল্যান্ডসের নাটকীয় প্রত্যাবর্তন অবশ্য তাদের মনে ভালোই ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। টাইব্রেকার এমন এক স্নায়ুক্ষয়ী আর নাটকীয় এক অধ্যায় যে ম্যাচের আগের সব তাতে অনেকটাই আড়াল হয়ে যায়।
এখানেই যেমন ওই রুক্ষ, মারদাঙ্গা ১২০ মিনিটকে ঝাপসা করে দিয়ে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। যেকোনো ব্যাপারে ঈশ্বরকে টেনে আনার একটা অভ্যাস আছে আর্জেন্টাইনদের। সেটির মূলে হয়তো ম্যারাডোনাই। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে বিখ্যাত সেই ‘ঈশ্বরের হাত’। স্প্যানিশ ভাষায় যেটিকে বলে ‘লা মানো দে দিওস’।
২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও নেদারল্যান্ডসকে হারাতে পেনাল্টি শুটআউট লেগেছিল আর্জেন্টিনার। যেখানে দুটি শট ঠেকিয়ে দেওয়ার পর আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক সের্হিও রোমেরোর হাত দুটি আর শুধু তাঁর থাকেনি। তা যে তখন ‘লা মানোস দে দিওস’। মানে ঈশ্বরের দুই হাত।
আট বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার আরেক গোলরক্ষকের টাইব্রেকার-বীরত্ব। এমিলিয়ানো মার্তিনেজের দুই হাতও আর্জেন্টাইনদের কাছে ‘লা মানোস দে দিওস’। ঈশ্বরের দুই হাত!