আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ সৌদি আরবের বিপক্ষে জাল অক্ষত রাখতে পারেননি
আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ সৌদি আরবের বিপক্ষে জাল অক্ষত রাখতে পারেননি

অঘটন, হতবাক ও চমকের বিশ্বকাপ

ফুটবল নিয়ে যাঁরা লেখালেখি করেন, এবারের কাতার বিশ্বকাপ তাঁদের কাজটা সহজ করে দিয়েছে। বিশেষ করে ক্রীড়া সাংবাদিকদের জন্য। লেখালেখির ক্ষেত্রে কঠিন কাজ হচ্ছে একটি জুতসই শিরোনাম খুঁজে বের করা। একটা ভালো লেখা ভালো একটা শিরোনামের অভাবে চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার বহু ঘটনা আছে।

এবার একটু গুগলের কাছে যান। বিশ্বের ছোট–বড় সব গণমাধ্যমে এবারের খেলার শিরোনামগুলো খুঁজে বের করে দেখতে পারেন। দুটি কথা অবশ্যই পাবেন। একটি হচ্ছে ‘আপসেট’, অন্যটি ‘স্টানড’। অর্থাৎ একটি হচ্ছে অঘটন, আরেকটি হতবাক, হতভম্ব বা স্তব্ধ হওয়া।

অবশ্য আরও দুটি শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। যেমন ‘চমক’ অন্যটি ‘ম্যাজিক’। বিশেষ করে শেষ সময়ে পর্তুগালের বিপক্ষে তিন ডিফেন্ডারের পা গলিয়ে কোরিয়ার সন হিউং-মিনের দেওয়া পাসটাকে ‘ম্যাজিকাল পাস’ বলাই যায়। সেই পাস থেকেই গোল করেই তো দ্বিতীয় পর্বে উঠে গেল কোরিয়া।

হতভম্ব হওয়ার বিশ্বকাপ

মেসির আর্জেন্টিনা এসেছে বিশ্বকাপ জিততে। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে সৌদি আরবের কাছে হেরে গেলে ‘আপসেট’ বা অঘটনের শুরু হয় এই বিশ্বকাপে। খেলা শেষ হতেই দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্টের শিরোনাম ছিল, ‘বিগেস্ট ওয়ার্ল্ড কাপ আপসেট’। অন্যদেরও প্রায় একই ধরনের শিরোনাম। তারপরই খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায় আগের বিশ্বকাপগুলোর কী কী অঘটন ছিল।

তালিকাটা খুব বড় নয়, আবার ছোটও বলা যাবে না। সাধারণত একটা বিশ্বকাপে একটা অঘটন বা একটা চমকই যথেষ্ট। তবে এবারের বিশ্বকাপ সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন সব ঘটনা ঘটছে, যেগুলোকে আর শুধু আপসেট বা অঘটন বললেও হচ্ছে না। বরং ‘স্টানড’ বা হতভম্ব শব্দটাই মানানসই। মনে রাখতে হবে ম্যাচ কিন্তু এখনো অনেক বাকি।

সৌদির জয়ের পর এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় বড় ঘটনা ছিল জাপানের কাছে জার্মানির হেরে যাওয়া। ওই দিন বিবিসির শিরোনাম ছিল ‘জাপানের শেষ সময়ের গোলে হতভম্ব জার্মানি’।

ভালো খেলে একটা দল যখন জিতে যায়, তখন অঘটন কথাটা আর যায় না আসলে। ফলে ঘটতে থাকে একের পর এক হতভম্ব বা স্তব্ধ হওয়ার মতো ফলাফল।
বেলজিয়াম ছিল ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে দ্বিতীয় দল। দীর্ঘদিন ধরে এই দলকে বলা হচ্ছে তাদের ‘গোল্ডেন জেনারেশন’।

অক্সফোর্ডের গবেষক দল অনেক অঙ্ক করে দেখিয়ে দিয়েছিল এবার ফাইনাল খেলবে বেলজিয়াম। সেই বেলজিয়ামকে প্রথম ধাক্কাটা দেয় আফ্রিকার দেশ মরক্কো। ২-০ গোলে হেরে গেলে স্তব্ধ বা হতভম্ব করে দেওয়ার শিরোনামটি আবারও ফিরে আসে।

গ্রুপ পর্বের শেষ খেলাগুলোও ছিল আসলে চমকে ভরা। এ সময় গতবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স হেরে যায় তিউনিসিয়ার কাছে, জাপানের কাছে স্পেনের হার তো একই সঙ্গে দুটি দেশকে হতবাক করে দেয়—পরাজিত স্পেন ও জার্মানি। গোল পার্থক্যে স্পেন টিকে গেলেও বিদায় নিতে হয় চারবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে।

হতভম্ব হওয়া এখানেই শেষ নয়। শেষ মুহূর্তের গোলে পরাজিত হয় আরও দুই পরাশক্তি। পর্তুগাল হেরে যায় কোরিয়ার কাছে, ক্যামেরুনের কাছে ব্রাজিল। এতে অবশ্য তাদের বড় ক্ষতি হয়নি, দ্বিতীয় পর্ব ওদের আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তবে ব্রাজিলকেও শেষ পর্যন্ত ক্যালকুলেটর নিয়ে বসতে হয়েছে, গোল পার্থক্যেই ওরা হয়েছে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন।

আবার অন্যদের হতভম্ব করে দিয়ে নিজেদের হতবাক হওয়ার ঘটনাও এবার আছে। যেমন সৌদি আরব, তিউনিসিয়া ও ক্যামেরুন—তিনটি দলই গ্রুপ পর্ব পেরোতে পারেনি। অর্থাৎ তাদের ম্যাজিক বা জাদু এক ম্যাচেই শেষ।

বিপর্যয়ের বিশ্বকাপ

সন্দেহ নেই এবারের বিশ্বকাপ অন্তত তিনটি দেশের জন্য বিপর্যয় হয়েই থাকবে। যেমন ফুটবলের পরাশক্তি জার্মানি। পরপর দুবার বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নিল দেশটি। ২০১৪ সালে তারা সর্বশেষ বিশ্বকাপ জিতেছিল। এর পর থেকে তারা দুই বিশ্বকাপে মাত্র দুটি ম্যাচ জিতেছে। অথচ মিথ হচ্ছে, জার্মানি খেলেই জেতার জন্য।
বেলজিয়ামের জন্যও বিপর্যয় কথাটা বলা যায়। তারাও বিদায় নিয়েছে প্রথম পর্ব থেকেই। গত বিশ্বকাপে তারা সেমিফাইনাল খেলেছিল। দলটাও খুব বেশি বদলায়নি। তারপরও তারা এবার সামর্থ্যের ছিটেফোঁটা দেখাতে পারেনি।

ডেনমার্ককে নিয়েও এবার অনেক প্রত্যাশা ছিল। তাদের বলা হয়েছিল ‘ডাক হর্স’। কিন্তু একটুও এগোতে পারল না তারা। প্রথম পর্ব থেকেই বিদায়।

কোনো প্রত্যাশা ছিল না। কিন্তু তারা ধারণার চেয়েও খারাপ করেছে। এই তালিকায় থাকবে স্বাগতিক কাতার, গ্যারেথ বেলের ওয়েলস ও কানাডা। এর মধ্যে কানাডা বেলজিয়ামের সঙ্গে কিছুটা ভালো খেললেও পরে আর তা ধরে রাখতে পারেনি। আগামী বিশ্বকাপে তিন স্বাগতিক দেশের একটি এই কানাডা। বাকি দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো।

অঘটনের বিশ্বকাপ

এবার একটু অতীতে ঘুরে আসা যাক। বিশ্বকাপের প্রথম অঘটন ধরা হয় ১৯৫০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ১ গোলে ইংল্যান্ডের হেরে যাওয়াকে। সেবার ইংল্যান্ড আর পরের পর্বে যেতে পারেনি। পরের অঘটন ১৯৬৬ সালের। সেবার ইতালি হেরে যায় উত্তর কোরিয়ার কাছে। কোরিয়ার সেটাই ছিল প্রথম বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া। ১ গোলে হেরে সেবার ইতালি প্রথম পর্ব থেকেই বাদ পড়েছিল।

১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ ইতিহাসে স্থান করে আছে যতটা অঘটনের, তার চেয়ে বেশি লজ্জার। সেবার ফুটবলের মহাশক্তি জার্মানি পরাজিত হয় আলজেরিয়ার কাছে। লজ্জার ইতিহাস ঘটে গ্রুপ পর্বে শেষ ম্যাচে। আলজেরিয়াকে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় করার জন্য সেবার একধরনের পাতানো খেলা খেলেছিল জার্মানি ও অস্ট্রিয়া।

টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে জার্মানি

শুরুতেই জার্মানি ১ গোল দেওয়ার পর দুই দলের কেউই আর গোল দিতে আগ্রহী ছিল না। ফলে বাকি পুরোটা সময় ছিল সময় নষ্ট করার খেলা। এতে গোল পার্থক্যে বাদ পরে আলজেরিয়া। স্পেনের শহর গিজনে খেলাটি হয়েছিল বলে ইতিহাসে একে বলে হয় ‘গিজনের লজ্জা’। এর পর থেকে ফিফা গ্রুপ পর্বে শেষ খেলা একই সময়ে আয়োজন করে আসছে।

ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা ১৯৯০ সালে এসেছিল বিশ্বকাপ ধরে রাখতেই। কিন্তু প্রথম খেলাতেই অঘটন। ক্যামেরুনের কাছে হেরে যায় ১ গোলে। গোল দেওয়ার পরে রজার মিলার সেই কোমর দোলানো নাচ এখনো অনেকেরই মনে আছে। সেবার প্রথম খেলায় হেরেও ফাইনালে যায় আর্জেন্টিনা।

ফ্রান্স ছিল ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ ও ২০০০ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়ন। ২০০২–এর বিশ্বকাপে তারা গিয়েছিল শিরোপা ধরে রাখতে। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই হার, সেনেগালের কাছে। সেবার গ্রুপ পর্বে একটি গোলও দিতে না পারা ফ্রান্স দ্বিতীয় পর্বে যেতেই পারেনি।

চমকের অপেক্ষায়

এবারের বিশ্বকাপ অঘটন ঘটিয়েছে। হতভম্ব করেছে অনেককে। বিপর্যয়ে পড়েছে অনেক দেশ। কিন্তু চমক হয়তো এখনো আরও বাকি। এশিয়ার জাপান বা কোরিয়া, আফ্রিকার মরক্কো বা সেনেগালের মতো দেশ দ্বিতীয় পর্বে না থেমে আরও এগিয়ে যেতে পারলে সেটি আর অঘটন হবে না, বরং তাকে চমক বলা যাবে।

কাতার বিশ্বকাপকে আর বিশ্বাস সেই। সুতরাং সামনে আরও কী চমক আছে, তার অপেক্ষায় থাকাটাই বরং ভালো।