পিএসজির হয়ে জোড়া গোল করেছেন এমবাপ্পে
পিএসজির হয়ে জোড়া গোল করেছেন এমবাপ্পে

চ্যাম্পিয়নস লিগ: ঘুরে দাঁড়ানোর পাগলাটে এক রাত

বার্সেলোনা থেকে ডর্টমুন্ডের দূরত্ব প্রায় ১ হাজার ২২০ কিলোমিটার। বিমানযাত্রায় সময় লাগে ৬ ঘণ্টার মতো। তবে আলাদা এই দুই শহর গতকাল রাতে যেন এক বিন্দুতে এসে মিলেছিল। চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ আটের ম্যাচে এ দুই শহরেই লেখা হয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। দুটি ম্যাচের মধ্যে অবশ্য কিছু কাকতালীয় মিলও ছিল। দুই ম্যাচেই একটি করে দল ছিল স্পেনের। বার্সেলোনা খেলেছে স্বাগতিক হিসেবে আর ডর্টমুন্ডের মাঠে খেলেছে আতলেতিকো মাদ্রিদ। এমনকি স্পেনের দুটি দলই মাঠে নেমেছিল প্রথম লেগে পাওয়া জয়ে এগিয়ে থেকে।

এত সব মিলের ভিড়ে শেষটাও অবশ্য অমিল হলো না। তবে এই মিলটাই এখন হতাশায় ভাসাচ্ছে স্পেনের দুই দলকে। বার্সা ও আতলেতিকো যে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে ছিটকে গেছে। প্রথম লেগে এগিয়ে থাকার সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি কোনো দলই। ঘরের মাঠে বার্সা হেরেছে ৪-১ গোলে (দুই লেগ মিলিয়ে ৬-৪ গোলের হার)। ডর্টমুন্ডের কাছে আতলেতিকোর হার ৪-২ গোলে (দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৪ গোলের হার)।

শুরুতে ফিরে চোখ রাখা যাক বার্সা-পিএসজির ম্যাচটির দিকে। প্যারিসে প্রথম লেগে ৩-২ গোলে জয়ের পরও পিএসজিকে ফেবারিট হিসেবে এগিয়ে রাখার কথা বলেছিলেন বার্সা কোচ জাভি হার্নান্দেজ। অনেকে তাঁর কথাকে তখন নিছক কথার কথা হিসেবেই নিয়েছিলেন। এর পেছনে যুক্তিও ছিল। একে তো সাম্প্রতিক সময়ের দুর্দান্ত ছন্দ এবং তার ওপর পরিসংখ্যান ছিল বার্সার পক্ষে।

ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় এর আগে কেবল দুবার প্রতিপক্ষের মাঠে প্রথম লেগ জয়ের পর বিদায় নিয়েছিল বার্সা। ১৯৮০ সালে কোলনের মাঠে ১-০ গোলে জয়ের পর ঘরের মাঠে ৪-০ গোলে হেরেছিল বার্সা। এরপর ১৯৮৪ সালে মেটজের বিপক্ষে ৪-২ গোলের জয়ের পর নিজেদের মাঠে ৪-১ গোলে হেরেছিল কাতালান ক্লাবটি। চার দশক পর এসে আবারও সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখল বার্সা।

রাফিনিয়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছে কোচ জাভি

অথচ দুই লেগ মিলিয়ে ১৮০ মিনিটের ম্যাচে ১২০ মিনিট পর্যন্ত লাগাম ছিল বার্সার হাতেই। তখন পর্যন্ত ম্যাচে ৪-২ গোলে এগিয়েই ছিল তারা। কিন্তু পরের ৬০ মিনিটে ভোজবাজির মতো বদলে গেছে পুরো চিত্রনাট্য। রোনাল্দ আরাউহোর দেখা লাল কার্ডটিই মূলত বদলে দিয়েছে ম্যাচের গতিপথ। বার্সা কোচ জাভি হার্নান্দেজও বলেছেন, রেফারির সেই সিদ্ধান্তই তাদের জন্য ম্যাচটা শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু বড় মঞ্চে একজন খেলোয়াড়কে হারানোর পর বার্সার হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতাও নিয়েও কেউ চাইলে প্রশ্ন তুলতে পারে।

এমনকি আরাউহোর বিদায়ের পর জাভির কৌশল বদলে ফেলা নিয়েও কথা হচ্ছে। উরুগুয়েন ডিফেন্ডারকে হারানোর পর দুর্দান্ত ছন্দে থাকা লামিনে ইয়ামালকে তুলে নিয়ে ইনিগো মার্তিনেজকে নামান জাভি। ম্যাচে অবশ্য তখন পর্যন্ত দারুণ খেলছিলেন ইয়ামাল। রাফিনিয়ার করা প্রথম গোলটিও ছিল তাঁর বানিয়ে দেওয়া। উইংয়ে পিএসজিকে একাই নাচিয়ে ছাড়ছিলেন এ কিশোর। এমন গতিময় ও প্রাণবন্ত একজন খেলোয়াড়কে বদলে একজন ডিফেন্ডার নামানো মূলত অতি সতর্কতার খোলসে ঢুকে পড়ার কথাই বলে। লাল কার্ড সমস্যার পর কৌশলে গুবলেট পাকানোর পাশাপাশি স্নায়ুচাপেও ভুগতে দেখা যায় বার্সা খেলোয়াড়দের।

বলা যায়, পিএসজিকে ম্যাচে ফেরার সুযোগটা মূলত বার্সাই করে দিয়েছে। আর এ সুযোগ কাজে লাগাতে একটুও ভুল করেননি উসমান দেম্বেলে-কিলিয়ান এমবাপ্পেরা। অথচ বার্সার সামনে সুযোগ ছিল এক খেলোয়াড় কম নিয়েও নতুন ইতিহাস গড়ার। একদিকে দুই গোলের লিড এবং অন্যদিকে গ্যালারিতে সমর্থকদের সরব উপস্থিতি। পরিবেশ ও পরিস্থিতি দুটোই পক্ষে ছিল। কিন্তু অতি চিন্তা ও স্নায়ুচাপ সামলাতে না পেরে ম্যাচটা নিজেরাই একরকম তুলে দেয় পিএসজির পায়ে। পিএসজিও ঘুরে দাঁড়ানোর এই সুযোগ কাজে লাগাতে কোনো কার্পণ্য করেনি। নড়বড়ে বার্সাকে তাদের মাঠেই রীতিমতো গুঁড়িয়ে দিয়েছে প্যারিসের ক্লাবটি।

পিএসজির বিপক্ষে এই হারে এখন শূন্য হাতেই মৌসুম শেষ করে বিদায় নেওয়ার পথে জাভি। লা লিগায় কাগজে–কলমে এখনো সম্ভব বেঁচে থাকলেও রিয়াল মাদ্রিদকে শীর্ষ স্থান থেকে সরাতে অবিশ্বাস্য কিছুই করতে হবে। চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায়ের পর কাজটা যে আরও কঠিন হয়ে গেল।

বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের গোল উদ্‌যাপন

ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দফায় দফায় প্রত্যাবর্তন দেখা গেছে ডর্টমুন্ডেও। মেট্রিপলিতানোয় প্রথম লেগে শুরুতে ২ গোলে এগিয়ে গিয়ে পরে ২-১ গোলের জয় পায় আতলেতিকো। এ জয়ে অনেকে ‘অল স্পেন’ সেমিফাইনাল দেখার স্বপ্নও দেখেছেন। বার্সা-আতলেতিকোর সেই লড়াইও নিশ্চয় দারুণ কিছু হতো!

সে আশায় পানি ঢেলে দিয়ে সিগনাল ইদুনা পার্কে দৃশ্যপট বদলে দেয় ডর্টমুন্ড। পাগলাটে এ ম্যাচ বারবার দিক বদলেছে, যেখানে প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়ে দুই লেগ মিলিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেয় ডর্টমুন্ড। এরপর পাল্টা প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত দিয়ে ৬৪ মিনিটের মধ্যে ২-২ গোলে সমতায় (দুই লেগ মিলিয়ে ৪-৩ গোলে এগিয়েও যায় তারা) ফেরে আতলেতিকো। কিন্তু ৭১ থেকে ৭৪—এই ৩ মিনিটের মধ্যে ২ গোল করে ম্যাচ একরকম শেষ করে দেয় ডর্টমুন্ড।

গ্রিজমানের হতাশা

অথচ গত সপ্তাহে মাদ্রিদে প্রথম লেগের ৩২ মিনিট শেষ হওয়ার পর ডর্টমুন্ডকে সেমিফাইনালের তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলেছিলেন অনেকেই। সেই ৩২ মিনিট জার্মান ক্লাবটির জন্য রীতিমতো এক ‘হরর শো’ ছিল। খেলায় না ছিল কোনো পরিকল্পনা, না ছিল কোনো কৌশল। কিন্তু সেই দলটিই পরবর্তী সময়ে বদলে দিয়েছে পাশার দান।

২৯ এপ্রিল রাতে সেমিফাইনাল প্রথম লেগে ডর্টমুন্ডের মাঠে প্রথম আতিথ্য নেবে পিএসজি। আর ৬ মে রাতে প্যারিসে ফিরতি লেগে মুখোমুখি হবে শেষ আটে প্রত্যাবর্তনের গল্প লেখা এ দুই দল। কোয়ার্টারে ঘুরে দাঁড়িয়ে জয় পাওয়া এ দুই দলের কাছ থেকে এখন সেমিতেও রোমাঞ্চকর লড়াই দেখার প্রত্যাশা ফুটবল–রোমান্টিকদের।