ফিরে দেখা বিশ্বকাপ

নায়ক রোমারিও, খলনায়ক বাজ্জিও

ফুটবল এমন এক খেলা, যেখানে গোল হওয়া না–হওয়ার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে জটিলতম সব ফরমেশন ও কৌশলের মজা পাওয়া যায়। যে যার জায়গা থেকে খেলাটাকে উপভোগ করতে পারার এই দুর্দান্ত সর্বজনীনতা খেলাটাকে দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ইভেন্টে পরিণত করেছে। আর নিঃসন্দেহে ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর হলো বিশ্বকাপ ফুটবল। চার বছর পরপর হওয়া এই টুর্নামেন্টের সময় গোটা পৃথিবীর নজর থাকে কে জিতল, কে হারল। খেলাটির সব রকম মানবীয় আবেগকে ধারণ করার যে ক্ষমতা, এ কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল শুধু হার-জিতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ইতিহাস তো মানুষেরই ইতিহাস। কাতারে আর কিছুদিন পরই শুরু হবে বিশ্বকাপের ২২তম আসর। তার আগে ফিরে তাকিয়ে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের গল্প শোনা যাক।

সে বছর টেলিভিশনে মানুষ দেখল ব্রাজিলের কিংবদন্তি আয়ারতন সেনার মৃত্যু। এক অনিরাপদ ট্র্যাকের বলি হন এই দুর্ধর্ষ ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভার।

কে জানে, সেনার অকালমৃত্যুতেই অনেক বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছিল কি না তাঁর দেশের ফুটবলাররা! পেলে, গারিঞ্চা, জর্জিনিওদের পর ২৪ বছর কাপটা জেতা হয়নি ব্রাজিলের। সেবার গেরো কাটল, ফুটবলের অপরিচিত অঞ্চল যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯৪ সালের সেই বিশ্বকাপে সাম্বার তালে মুগ্ধ করা ব্রাজিলও জয়ের জন্য খেলল সাবধানী ও ঘুমপাড়ানি ফুটবল। যে ইতালি আর ব্রাজিলের ফাইনাল ২৪ বছর আগে দর্শকের প্রতিটি স্নায়ু জাগিয়ে দিয়েছিল, সেটাই এবার হলো ঘুমপাড়ানিয়া। প্রথমবারের মতো গোলশূন্য এক বিরক্তিকর প্রদর্শনীর পর টাইব্রেকার নামের লটারিতে চতুর্থবারের মতো কাপটা জিতে নেয় ব্রাজিল।

অর্থনৈতিক দিকটা বিচার করলে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন বরাবরই লাভজনক। সে দেশে ফুটবল খেলা নিয়ে হেলদোল না থাকলেও দেশজুড়ে বড় বড় স্টেডিয়ামগুলোতে বড় আসর হলেই গাঁটের পয়সা খরচ করে সে দেশের লোকজন উৎসব করতে জড়ো হয়। ইউরোপের টেলিভিশনের দর্শকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য তপ্ত রোদে খেলা হলেও মাঠভর্তি দর্শক সে বিশ্বকাপেও হয়েছিল। আর যুক্তরাষ্ট্রে খেলা আয়োজনের পেছনে যার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার আইনজীবী এলান রোথেনবার্গ।

ফুটবল নিয়ে খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও বছর দশেক আগে (১৯৮৪ সালে) লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে তিনি ফুটবল ইভেন্টের কমিশনারের দায়িত্ব পালন করে আশাতীত সাফল্য লাভ করেন। ফিফার সহায়তায় ১৯৯০ সালে ইউএস সকার ফেডারেশনের সভাপতি ভেরনার ফিকারকে সরিয়ে সভাপতির আসন নেন। তাঁর উদ্যোগেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের আয়োজক হয়, বড় বড় মাঠে বিপুল দর্শক সমাগম ঘটায় এবং ২৫ লাখ দর্শকের রেকর্ড করে।

১৯৯৪ বিশ্বকাপের ব্রাজিল দল।

টুর্নামেন্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল ৫ কোটি ডলার মুনাফা করে। আরেকটা বড় অর্জন হয়, সে দেশে মেজর লিগ সকার চালুর মাধ্যমে ফুটবল নতুন করে প্রাণ পায়। বেতন নিতে অস্বীকৃতি জানালেও টুর্নামেন্ট শেষে রোথেনবার্গ ৭০ লাখ ডলার পুরস্কার হিসেবে গ্রহণ করেন। যদিও জানা যায় যে টুর্নামেন্টটা সফল করতে দিন-রাত খেটে মরা স্বেচ্ছাসেবকেরা নাকি ফুটো পয়সাও পাননি।

বিশ্বকাপ শুরু হলো

ব্রাজিল নিজেদের প্রথম খেলায় ২-০ গোলে জেতে। আগের টুর্নামেন্টে চমক দেখানো ক্যামেরুন গ্রুপ ‘বি’-এর অপর খেলায় ২-২ গোলে ড্র করে সুইডেনের সঙ্গে। ক্যামেরুনের ৩৯ বছর বয়স্ক গোলরক্ষক জোসেফ এন্তনিও বেল দারুণ কিছু সেভ করলেও দুটি বাজে গোল খান। স্কোয়াডে থাকলেও সেই ম্যাচে মাঠে নামেননি ৪২ বছরের রজার মিলা।

স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ম্যাচে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে এবং গ্রুপের প্রথম ম্যাচে বিস্ময়করভাবে ৯১ হাজার দর্শকের সামনে রোজ বোল স্টেডিয়ামে কলম্বিয়াকে হারায় রোমানিয়া। বাছাইপর্বে আর্জেন্টিনাকে ৫-০ গোলে হারিয়ে দেওয়া কলম্বিয়া বিশ্বকাপ জিতে যেতে পারে, এই মন্তব্য করেছিলেন খোদ পেলেসহ অনেক ফুটবল বোদ্ধা।

সেই চাপ তো ছিলই, মাদকের স্বর্গরাজ্য, এসকোবারের দেশ কলম্বিয়ায় ফুটবল নিয়ে বড় ধরনের বাজির লড়াই চলছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নানা রকম মাদক কারবারির চাপে খেলোয়াড়েরাও যে খুব ভীত ছিলেন স্বীকার করেন কোচ পাতো মাতুরানা। আর এর প্রভাবেই জন্ম হয় বিশ্বকাপ ইতিহাসকে ঘিরে সবচেয়ে বড় ‘ট্র্যাজেডি’র।

বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে দুঙ্গা ও তাঁর দল

সান্তোসের শট ঠেকিয়ে দেন গোলকিপার পালিউকা। আলবার্তিনির শটে ইতালি এগিয়ে যায়, রোমারিও সমতায় ফেরান ব্রাজিলকে। ইভানি আবার এগিয়ে নেন ইতালিকে, ব্রাঙ্কো সেই চাপ সামলে লক্ষ্যভেদ করেন। ইতালির স্ট্রাইকার ড্যানিয়েল মাসারোর পরের শটটি ঠেকান ব্রাজিলের গোলরক্ষক ক্লদিও তাফারেল। ব্রাজিলের হয়ে গোল রক্ষা করা সর্বদাই একটা হাসাহাসির বিষয়। তাফারেল নিজেও ক্যারিয়ারের শুরুতে নাকি স্ট্রাইকার ছিলেন! আর চার দশক আগের বারবোসার সঙ্গে ঘটা কাহিনি তো জানা ছিলই। এসব জেনেও এই পজিশনে খেলতে আসা তাফারেলই ব্রাজিলের জয়ের নায়ক হয়ে যান। শুধু তা-ই নয়, পরের দুই দশকে ব্রাজিলে বেশ কিছু ভালো গোলরক্ষক জন্ম দেওয়ার সঞ্জীবনী মুহূর্তও ছিল সেটি।

এরপর আর কী! সেই মহাকাব্যের চেনা গল্প। দুঙ্গা গোল দিয়ে ব্রাজিলকে প্রথমবারের মতো এগিয়ে দেন। পুরো টুর্নামেন্টে দারুণ খেলা, চোট আর শ্রান্তি নিয়ে ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় বাজ্জিও শট নিতে এগিয়ে আসেন। সব যুদ্ধ জিতে মহানায়ক শেষ যুদ্ধে পরিণত হন খলনায়কে। বাজ্জিওর শটটা উড়ে চলে যায় বহুদূর দিয়ে, ইতালির স্বপ্নও বেহাত হয়।

হয়তো ইলিয়াডের হেক্টরের মতো বাজ্জিও নিজেও মনে মনে আউড়েছিলেন, ‘আমি হেরে গেলাম, আমি বিধ্বস্ত হলাম, কিন্তু এই হার অপমানের না, এই ধ্বংস অগৌরবের না। আমার জয় না হোক, আমার কীর্তি লোকে মনে রাখবে চিরকাল।’

বিশ্বকাপের ‘আইকন’ ছবিগুলোর একটি। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে পেনাল্টি মিস করলেন ইতালির সেরা তারকা রবার্তো বাজ্জিও

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে (২২ জুন) প্যাসাডিনার রোজ বোল স্টেডিয়ামে ৩৫ মিনিটে আত্মঘাতী গোল করে বসেন কলম্বিয়ার আন্দ্রেস এসকোবার। পরিচ্ছন্নভাবে খেলা এবং ভদ্রতার জন্য এই কলাম্বিয়ানের ডাকনাম ছিল ‘দ্য জেন্টলম্যান’। অথচ ওই আত্মঘাতী গোলের ১০ দিন পর দেশে ফিরে তিনি গুলিতে নিহত হন। হতবিহ্বল কলাম্বিয়ানরা আন্দ্রেসের জন্য শোকের মাতম করে। লাখ লাখ লোক শেষকৃত্যে শরিক হয়। ধরে নেওয়া হচ্ছিল, ফুটবল জুয়া এবং মাদক কারবারিদের স্বার্থে আঘাত লাগায় খুন হন এসকোবার। বেশ কিছু অপরাধী ধরাও পড়ে।

তবে পরে নানা ঘটনা বিশ্লেষণে মনে হয় এসকোবার আসলে নরক হয়ে ওঠা দেশটিতে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় গিয়ে মারা পড়েন। ফুটবলের সঙ্গে সম্ভবত এ ঘটনার তেমন সম্পর্ক ছিল না। সাংবাদিক জন স্পার্লিং তাঁর ‘ডেথ অ্যান্ড গ্লোরি, দ্য ডার্ক হিস্টোরি অব ওয়ার্ল্ড কাপ’-এ এসব ঘটনার বিশদ বিবরণ দেন। এসকোবারের আত্মঘাতী গোল যদি হয় অন্যতম ট্র্যাজেডি তবে সাইদ আল ওয়াইরানের গোলটি ছিল অন্যতম সেরা। বেলজিয়ামের বিপক্ষে ২৯ জুন ওয়াশিংটনে এই সৌদি স্ট্রাইকার পাঁচ মিনিটের মাথায় নিজেদের সীমানায় বল পান। আরবের সংস্কৃতিতে ভূতপ্রেত আর আরেকজনের আত্মা ‘আসর’ করার ঘটনা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সেদিন ওয়াইরানে ভর করেছিলেন ম্যারাডোনা! বলটা নিয়ে তিনি প্রথমে একজন, দুজন, তিনজন, চারজন থেকে শেষ পর্যন্ত পাঁচজনকে কাটিয়ে গোলকিপারকে পরাস্ত করেন। গতি, ড্রিবলিং আর নিখুঁত ফিনিশিংয়ের স্বপ্নের গোল। ওয়াইরান যেখানে ম্যারাডোনার সেরা স্মৃতি ফিরিয়ে আনেন, আর্জেন্টাইন ‘ঈশ্বর’-এর হয় পতন। ডোপ টেস্টে নিষিদ্ধ হয়ে বাদ পড়েন এর আগের দুবার আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তোলা ম্যারাডোনা। আর নতুন যুগের দুনিয়ায় এশিয়া আর আফ্রিকানরা নিজেদের প্রমাণ রাখতে থাকে।

বিশ্বকাপের ট্র্যাজিক হিরো আন্দ্রেস এসকোবার

স্পেনের সঙ্গে ড্র করার পর জার্মানির সঙ্গেও লড়াই চালায় দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু ৩-২ গোলে হেরে বাদ পড়ে। দ্বিতীয় রাউন্ডে নাইজেরিয়া মুখোমুখি কোনোমতে উত্তীর্ণ হয়ে আসা ইতালির। আগেরবার ক্যামেরুন যদি হয় আফ্রিকার ফুটবলের বিজ্ঞাপন, এবার সে জায়গাটা দখল করে ‘সুপার ইগল’রা। তবে ভালো খেলার পাশাপাশি মুখের লাগাম টানতে ব্যর্থ হন সে দেশের ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট স্যামসন এমেকা ওমেরুয়াহ।

তিনি ইতালিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আফ্রিকার চ্যাম্পিয়ন আর তোমরা কী? ইতালি মাফিয়া আর ফিয়াট গাড়ির জন্য বিশ্বখ্যাত, ফুটবলের জন্য না।’ ইতালির টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকেরা বোস্টনে নাইজেরিয়ানদের অনুশীলনের ছবি তুলতে গেলে তাঁদের চড়থাপ্পড় ও হুমকি দিয়ে বের করে দেওয়া হয়। ফক্সবোরোতে ইতালি দলটারও সেই অবস্থাই হতো যদি না, গতবারের মতো এবারও আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে ইউরোপিয়ানদের প্রতি রেফারির নেকনজর না থাকত।

ইতালির সেরা ডিফেন্ডার পাওলো মালদিনি ৮০ মিনিটের মাথায় গোলের দিকে এগোতে থাকা ‘লাস্ট ম্যান’ ইয়াকিনিকে ফাউল করলেও মেক্সিকোর রেফারি আর্তুরো ব্রিজিও তাঁকে অবধারিত লাল কার্ড দেখানো থেকে বিরত থাকেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ২৬ মিনিটের মাথায় আমুনিকের গোলে পিছিয়ে পড়া ইতালি ৮৮ মিনিটের সময় রবার্তো ব্যাজ্জিওর গোলে সমতা ফেরায়।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ, ডোপ টেস্ট দিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ম্যারাডোনাকে

অতিরিক্ত সময়ে ইতালি একটি পেনাল্টি পায় এবং ব্যাজ্জিও তা থেকে গোল করে আফ্রিকার দলটিকে বিদায় করেন। পাওলো আলতোতে, ৮৪ হাজার দর্শকের সামনে স্বাগতিক যুক্তরাষ্ট্রকে বিদায় করে ব্রাজিল। খেলার ৪৩ মিনিটে ব্রাজিলের লেফটব্যাক লিওনার্দো ট্যাব র‍্যামেসকে কনুই মারায় লাল কার্ড দেখেন।

এতে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল খেলোয়াড়টিকেও মাঠ ছাড়তে হয়। আর এ কারণেই কোচ বোরা মিলুটিনোভিচ ১০ জনের দলের বিপক্ষেও আক্রমণাত্মক খেলতে ব্যর্থ হন। যুগোস্লোভাকিয়ার এই জাদুকরি কোচ বিশ্বকাপের ইতিহাসে অবশ্য আলাদা জায়গা পাওয়ার দাবিদার। ব্রাজিলের কার্লোস আলবার্তো পেরেইরা বাদে তিনিই একমাত্র কোচ, যিনি পাঁচটি বিশ্বকাপে কোচের দায়িত্ব পালন করেন। তবে এক জায়গায় তিনি অদ্বিতীয়, তিনি পাঁচবার পাঁচটি ভিন্ন দলের কোচ ছিলেন।

এর চেয়েও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, তিনি এদের মধ্যে চারটি দলকেই দ্বিতীয় রাউন্ডে নেন। শুরুটা করেছিলেন ’৮৬তে স্বাগতিক মেক্সিকোকে দিয়ে। পরের বার কোস্টারিকার মতো দলকে কেবল উত্তীর্ণই করালেন না, তুলে দিলেন পরের রাউন্ডে। যুক্তরাষ্ট্রও তা-ই করল। এর পরের বার এই ধারা অব্যাহত রাখেন নাইজেরিয়াকে দিয়ে। আর ২০০২ সালে চীন তার ওপর আস্থা রাখার ফল পায়, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়।

অবশ্য ওই একবারই বোরার দল পরের রাউন্ডে যেতে ব্যর্থ হয়। খেলার মাঠেও কিছু তারকার ঝলকানিও দেখা যায়। রোমানিয়ার সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় ‘কার্পেথিয়ানের ম্যারাডোনা’খ্যাত গিওর্জি হ্যাজি আসল ম্যারাডোনার অনুপস্থিতে তাঁর দলকে হারিয়ে দেন ৩-২ গোলে, আর জার্মানি একই ব্যবধানে জেতে বেলজিয়ানদের বিপক্ষে। কিন্তু রোমানিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন একজন রিস্টো স্টইচকভ। নিউ জার্সির জায়ান্ট স্টেডিয়ামে সে যুগের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় বিকল করে দেন জার্মান মেশিন।

স্টইচকভ নামটা বুলগেরিয়ানদের সঙ্গে সঙ্গে বার্সেলোনার সমর্থকেরাও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। কাতালুনিয়াতে ক্রুইফ যখন ‘স্বপ্নের দল’ গঠন করেন, সেই দলে অন্যতম প্রধান খেলোয়াড় ছিলেন ব্যালন ডি’অর জেতা এই বুলগেরিয়ান। নিজে কেবল খেলতেন তাই নয়, অবাধ্য রোমারিওকে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন নিয়ম করে। ’৯৪ বিশ্বকাপের এই দুই তারকা বার্সেলোনার জন্য নতুন দিনের সূচনা করেন। আর ছিলেন ইতালির তারকা রবার্তো বাজ্জিও। তাঁর গোলে বিদায় নেয় স্পেন। হ্যাজি তাঁর জাদু অব্যাহত রাখলেও সুইডেনের সঙ্গে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয় রোমানিয়া।

১৯৯৪ বিশ্বকাপে তিনি গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন বুলগেরিয়া ও বার্সেলোনার সাবেক তারকা রিস্টো স্টয়চকভ

সবাই আশা করছিল ব্রাজিল আর ডাচদের খেলাটা হবে টুর্নামেন্টের সেরা। কিন্তু গুলিত আর ফন বাস্তেনহীন নেদারল্যান্ডস রক্ষণাত্মক কৌশলে খেলেন। প্রথমার্ধ গোলশূন্য হলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকেই রোমারিও একটি আর বেবেতো একটি গোল দেন। তবে এরপরই যেন ডাচরা জেগে ওঠে। বার্গক্যাম্প ৬৪ মিনিটে গোল দেন আর এর ১২ মিনিট পর কৃষ্ণাঙ্গ স্ট্রাইকার এরন উইংগার সমতা ফেরান।

আগের বিশ্বকাপের দুর্ভাগা, তত দিনে ৩০ বছর পেরিয়ে যাওয়া ব্রাঙ্কো শেষতক নায়কে পরিণত হন। খেলার ৮১ মিনিটে ৩০ গজ দূর থেকে ফ্রি কিকে তিনি ব্রাজিলের জয় নিশ্চিত করেন। খেলার পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ব্রাজিলের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ খেলেছি, আমার মনে হয় আরেকটু সম্মান পাওয়া উচিত।’

সুইডেনের বিপক্ষে অবশ্য অন্য রকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় ‘সেলেসাও’রা। চরম রক্ষণাত্মক খেলে ইউরোপিয়ান দলটি ৮০ মিনিট পর্যন্ত দুর্গ আগলে রাখে, কিন্তু বেবেতোর ক্রসে ছোটখাটো গড়নের রোমারিও হেডে গোল দিয়ে দলকে ফাইনালে তোলেন ২৪ বছর পর। আর সেই ’৭০-এর ফাইনালের মতো ইতালিও চতুর্থ ট্রফির জন্য লড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছিল।

অবশ্য অনেকে ভাবছিলেন স্টইচকভ হয়তো ‘আজ্জুরি’দের আটকে দিতে পারেন। কিন্তু এদিন টুর্নামেন্টের সেরা ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখান ‘দ্য ডিভাইন পনিটেইল’। নিজে বুদ্ধের দর্শনে দীক্ষিত হলেও বাজ্জিও সেদিন তাণ্ডব চালালেন অসহায় প্রতিপক্ষের ওপর। চোখধাঁধানো দুটি গোল দেন ২১ আর ২৫ মিনিটে। তবে ইতালি আর গোল পায়নি বরং খেলার ধারার বিপরীতে পেনাল্টি থেকে ৪৪ মিনিটে গোল দেন স্টইচকভ। ইতালি শেষতক জেতে তবে একটা বড় সংশয় নিয়ে। রগে টান পেয়ে মাঠ ছাড়েন বাজ্জিও, আর একটা দাঁতও ভাঙেন। বাজ্জিও কি ফাইনাল খেলতে পারবেন? বাজ্জিও শেষতক নামলেন। নামলেন রোমারিও।

বেবেতোর সঙ্গে এর আগে ৩২টি ম্যাচ খেলেন রোমারিও। দুজন মিলে ব্রাজিলের হয়ে ৫৭ গোল দেওয়া জুটিকে নিয়ে আশা ছিল পেলে, গারিঞ্চা, জর্জিনিওদের খেলার পুনরাবৃত্তি। কিন্তু দুই দলের কোচই চেয়েছিলেন নিজেদের রক্ষণ আগলে পরে আক্রমণে উঠতে। টাইব্রেকার অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও সেদিন তা সবাইকে রক্ষা করল, তা না হলে সম্ভবত দিনের পর দিন খেললেও গোল পেত না কোনো দল! এমনই অবস্থা যে টাইব্রেকারের প্রথম শটে ইতালির বারেসি বল উড়িয়ে মারেন ক্রসবারের ওপর দিয়ে আর ব্রাজিলের মার্সিও