অবিশ্বাস্য বললেও কম বলা হয়। অলিম্পিকের মতো আসরে এমন বিশৃঙ্খলা! সেটাও আবার ছেলেদের ফুটবল ইভেন্টের প্রথম ম্যাচে!
গতকাল আর্জেন্টিনা-মরক্কো ম্যাচে যোগ করা সময় দেওয়া হয়েছিল ১৫ মিনিট। কিন্তু ২-১ গোলে পিছিয়ে থাকা আর্জেন্টিনা সমতাসূচক গোল পেয়েছে যোগ করা সময়ের ১৬ মিনিটে। কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, যোগ করা সময়ের সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার পর আর্জেন্টিনা গোল পাওয়ায় মেজাজ ধরে রাখতে পারেননি মরক্কোর কিছু সমর্থক। মাঠে ঢুকে পড়েন তাঁরা। এতে স্থগিত হয় খেলা।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর ম্যাচটি পুনরায় শুরু হয় এবং ভিএআরের মাধ্যমে অফসাইডের জন্য আর্জেন্টিনার সমতাসূচক গোলটি বাতিল করা হয়। ম্যাচ পুনরায় শুরুর পর খেলা হয়েছে প্রায় ৩ মিনিট ১৫ সেকেন্ড। কিন্তু এ সময়ে আর্জেন্টিনা আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি। মাঠ ছাড়তে হয় ২-১ গোলের হার নিয়ে। এরপর বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। যেমন ধরুন, আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটি বাতিল করতে কেন প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগল? কেন যোগ করা সময় ১৫ মিনিট দেওয়া হলো?
উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক।
আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘ক্লারিন’–এর ক্রীড়া সম্পাদক ম্যাক্সিমিলিয়ানো উরিয়া এ নিয়ে মনে করিয়ে দিয়েছেন সর্বশেষ ফিফা বিশ্বকাপের ম্যাচগুলোয় দেওয়া যোগ করা সময়কে। কিছু ম্যাচে যোগ করা সময় ১০ মিনিটও দেওয়া হয়েছিল। যেমন কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা-নেদারল্যান্ডস ম্যাচ। ক্লারিন এ বিষয়ে কথা বলেছে রেফারিংয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে। তাঁরা জানিয়েছেন, খেলার সময় নির্ধারণে আইএফএবি এর সুপারিশের প্রয়োজন হয়। এটি ফুটবলের আইন ও বিধি প্রণয়নের আন্তর্জাতিক সংস্থা। সর্বশেষ বিশ্বকাপে ফিফা তাদের সুপারিশ অনুযায়ী খেলার সময় ঠিক করেছে। এবার আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিও সেই পথে হেঁটেছে।
ক্লারিন জানিয়েছে, ম্যাচে কী পরিমাণ খেলার সময় নষ্ট হলো, সেই হিসাব রাখে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি প্রযুক্তি (ভিএআর)। পঞ্চম রেফারিও ঘড়ি দেখে সময় নষ্ট হওয়ার হিসাব রাখেন। চোট, মাঠে দর্শক ঢুকে পড়া, অতিরিক্ত উদ্যাপনসহ নানা কারণে খেলার সময় নষ্ট হয়। এর পাশাপাশি খেলার কোনো মুহূর্ত ভিএআর প্রযুক্তিতে যাচাইয়ের সময় নষ্ট হওয়া সময়, এমনকি গোল কিক, থ্রো-ইন এবং ফ্রি কিকে নষ্ট হওয়া সময়ও আমলে নিতে পারেন রেফারি। এসব নষ্ট হওয়া মুহূর্ত হিসাব করেই ৯০ মিনিট শেষে যোগ করা সময়ে খেলার সময় ঠিক করা হয়।
আর্জেন্টিনা-মরক্কো ম্যাচেও খেলায় বিঘ্ন ঘটেছে। মাঠে দর্শক ঢুকেছে। আর্জেন্টিনার অলিম্পিক দলের কোচ হাভিয়ের মাচেরানো দাবি করেছেন, ম্যাচ চলাকালীন মাঠে ‘সাতবার’ মরক্কোর সমর্থকেরা ঢুকেছেন।
মরক্কোর গোলকিপার থেকে আউটফিল্ডের খেলোয়াড়েরাও সময় নষ্ট করেছেন। ফাউলের শিকার হওয়ার পর উঠে দাঁড়াতে বিলম্ব করেছেন। ফুটবলের তথ্য-পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট অপটা জানিয়েছে, ম্যাচটি সব মিলিয়ে ১১০ মিনিট ২৯ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে খেলা হয়েছে মাত্র ৫৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ড সময়। সর্বশেষ ইউরোয় গড়ে যা ছিল ৬০ মিনিট করে। আর্জেন্টিনা-মরক্কো ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধে খেলা হয়েছে মাত্র ২৬ মিনিট ৫ সেকেন্ড। এসব কারণেই যোগ করা সময় ১৫ মিনিট দেওয়া হয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ম্যাচ পুনরায় শুরুর পর বাকি ৩ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের খেলা ধরলে মোট যোগ করা সময় ১৮ মিনিট ১৫ সেকেন্ড।
ছিল। ইএসপিএন জানিয়েছে, নিকোলাস ওতামেন্দি শট নেওয়ার সময় মরক্কোর শেষ ডিফেন্ডারটির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর্জেন্টিনার সেন্টার-ব্যাক ব্রুনো আমিওনে। বল ক্রসবারে লেগে ফেরত আসার পর আমিওনে অফসাইড অবস্থায় বলটি খেলার চেষ্টা করেছেন। এ কারণে ভিএআর গোলটি বাতিল করেছে। সেমি অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তিতে দেখা গেছে, আমিওনের বাঁ পায়ের অর্ধেক অংশ অফসাইড ছিল।
যোগ করা সময়ের ১৬তম মিনিটে আর্জেন্টিনা সমতাসূচক গোলটি (পরে বাতিল হয়) পাওয়ার পর মরক্কোর কিছু সমর্থক মাঠে ঢুকে পড়ায় খেলা স্থগিত করা হয়। সুইডিশ রেফারি গ্লেন নাইবার্গ দুই দলের খেলোয়াড়দের মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে পাঠান। তখন বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী রাত ৯টা ৫ মিনিট। এরপর খেলা পুনরায় শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী রাত ১১টায়। অর্থাৎ ১ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট বা প্রায় দুই ঘণ্টা পর খেলা পুনরায় শুরু হয়।
তবে ইএসপিএন জানিয়েছে, বিরতির দেড় ঘণ্টার মাথায়ই খবর এসেছে আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোলটি অফসাইডের কারণে বাতিল করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে ফিফার সেমি অটোমেটেড অফসাইড প্রযুক্তি ব্যবহার করে রেফারি যেখানে ঘটনা ঘটার পরপরই রায় দিয়ে দিতে পারতেন, সেখানে কেন তিনি দেড় থেকে দুই ঘণ্টা সময় নিলেন?
ইএসপিএনের জেনারেল এডিটর ডেল জনসন তাঁর প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, ক্রিস্টিয়ান মেদিনা আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় গোল এনে দেওয়ার পর মরক্কোর কিছু সমর্থক মাঠে ঢুকে পড়ায় খেলাটা যেহেতু আর চালানো যায়নি, তাই ভিএআরের সাহায্য নিয়ে তখন গোলটি বাতিল করলে দর্শকদের হাঙ্গামা আরও বাড়ত। আয়োজকেরা সম্ভবত ভেবেছিলেন, দর্শকেরা স্টেডিয়াম ছেড়ে যাওয়ার পর গোলটি বাতিলের ঘোষণা দেওয়াটা নিরাপদ। এরপর খেলাটা ‘ক্লোজ ডোর’ ম্যাচ হিসেবে পুনরায় শুরু করা যায়।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর ম্যাচের বাকি সময় খেলতে খেলোয়াড়েরা মাঠে ফেরার পর অফিশিয়ালি গোলটি বাতিল ঘোষণা করেন রেফারি নাইবার্গ। সেটাও নাটকীয়ভাবে। মাঠের পাশে রাখা মনিটরে গিয়ে গোলের মুহূর্তটি দেখার আনুষ্ঠানিকতা পালন করেছেন, যেটি ম্যাচ চলার সময়ে অফসাইডের ব্যাপারে তিনি করতেন না। গোল বাতিলের ইঙ্গিতও তিনি দেখিয়েছিলেন টিভি ক্যামেরার প্রতি, যদিও গ্যালারি তখন ফাঁকা।
যোগ করা সময় দেওয়া হয়েছিল ১৫ মিনিট। সেখানে আর্জেন্টিনা গোল করেছে ১৬তম মিনিটে। অর্থাৎ গোলের পরপরই কিংবা গোলটি বৈধ কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার পরপরই রেফারি খেলা শেষের বাঁশি বাজাতে পারতেন। কিন্তু সেটি হয়নি। কেন? সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ জানিয়েছে, ম্যাচটি ঠিক কী কারণে পুনরায় শুরু করা হয়েছে, তার নির্দিষ্ট কোনো কারণ জানা যায়নি। এই সিদ্ধান্ত কখন নেওয়া হয়েছে, সেটাও জানা যায়নি। তবে ইএসপিএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলা স্থগিত হওয়ায় দুই দলের খেলোয়াড়েরা ড্রেসিংরুমে ফেরার প্রায় এক ঘণ্টা পর আয়োজকেরা জানিয়েছেন, অফিশিয়ালি ম্যাচটি শেষ হয়নি। খেলা পুনরায় শুরু করতে দুই দলের খেলোয়াড়দের স্টেডিয়ামেই রাখা হয়।
এই ম্যাচে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে জানতে ফিফার দ্বারস্থ হয়েছিল ‘দ্য অ্যাথলেটিক’। কিন্তু যোগাযোগ করেও কোনো সদুত্তর বের করতে পারেনি সংবাদমাধ্যমটি।
তবে ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ এতটুকু জানিয়েছে, ম্যাচ আবার শুরুর পর রেফারি নাইবার্গ মাঠের পাশে ভিএআর মনিটর দেখে আনুষ্ঠানিকভাবে গোলটি বাতিল করেন। গোলটি হওয়ার আগে খেলার ‘বিল্ড আপ’–এর সময় অফসাইড হয়েছিলেন ব্রুনো আমিওনে। খেলোয়াড়েরা মাঠে ফেরার আগেই এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানতেন। ম্যাচ আবার শুরুর পর প্রায় ৩ মিনিট ১৫ সেকেন্ড খেলা হয়েছে। তবে তার প্রায় দুই ঘণ্টা আগে খেলোয়াড়েরা মাঠ ছাড়ার সময়ই অনেকেই ভেবেছিলেন ম্যাচটি শেষ হয়েছে।