বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের মানুষের বিপুল সমর্থনে মুগ্ধ আর্জেন্টিনার মানুষ। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বড় পর্দায় আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে হাজারো মানুষের ভিড় নজর কেড়েছে আর্জেন্টাইনদের। আগের বিশ্বকাপগুলোর সময়ই বাংলাদেশের মানুষের আর্জেন্টিনা দলের প্রতি ভালোবাসা খবর হয়েছে সে দেশের গণমাধ্যমে। ১০ হাজার মাইল দূরের একটি দেশের বিভিন্ন বাড়ির ছাদে আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকা উড়তে দেখেও আপ্লুত হয়েছেন তাঁরা। তবে এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার মানুষের কাছে বাংলাদেশ নিজেদের চিনিয়েছে ভিন্নভাবে। এবার মেসি–দি মারিয়াদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সমর্থন আর্জেন্টাইনদের এতটাই ছুঁয়ে গেছে যে তাঁরা বাংলাদেশের পতাকা নিয়েও উদ্যাপন করেছেন তাঁদের বিশ্বকাপ জয়। আর্জেন্টাইনরা বিভিন্নভাবে জানতে চাচ্ছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। এমনকি বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন বাংলাদেশের মানুষের উন্মাদনা দেখতে আর্জেন্টিনা থেকে এসেছিলেন সাংবাদিকও।
১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপে আর্জেন্টিনা একাদশের সঙ্গে খেলেছিল বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। আর্জেন্টিনার দলটি জিতেছিল ৫–২ গোলে। বাংলাদেশের পক্ষে গোল দুটি করেছিলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু।
আর্জেন্টাইনরা বাংলাদেশকে চিনেছে ক্রিকেট–পাগল দেশ হিসেবেই। বিশ্বকাপের মধ্যেই ভারত–বাংলাদেশ ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশকে তাঁরা সমর্থন জানিয়েছেন কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে। তবে বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, সেটি নিয়েও বিভিন্ন প্রতিবেদনে আলোচনা হয়েছে। ফিফার তালিকায় বাংলাদেশের ১৯২তম অবস্থান নিয়ে হতাশাও ঝরেছে আর্জেন্টাইন পত্র–পত্রিকায়। বিশ্বকাপ শেষ হয়েছে ১০ দিন। গোটা আর্জেন্টিনাজুড়ে চলছে বিশ্বকাপ জয়ের উৎসব। এর মধ্যেই আর্জেন্টাইন পত্রিকা ক্লারিন স্মরণ করেছে বাংলাদেশকে। পত্রিকাটি খুঁজে বের করেছে, আজ থেকে ৩৯ বছর আগে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার একটি ম্যাচের ইতিহাস।
হ্যাঁ, আর্জেন্টিনার সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় দল একটি ম্যাচ খেলেছিল। সেটি ১৯৮৩ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপ টুর্নামেন্টে। কুয়ালালামপুরের সেই ম্যাচে অবশ্য আর্জেন্টিনার সেই দলটি জাতীয় দল ছিল না। সেটি ছিল আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় স্তরের লিগ প্রিমিয়ারা ‘বি’র সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত দল। মারদেকা কাপে তারা ‘আর্জেন্টিনা একাদশ’ নাম নিয়ে খেলেছিল। কুয়ালালামপুরের সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার দলটি বাংলাদেশ জাতীয় দলকে হারিয়েছিল ৫–২ গোলে। বাংলাদেশের পক্ষে দুটি গোল করেছিলেন আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু ও শেখ মোহাম্মদ আসলাম।
ক্লারিন আর্জেন্টিনার সেই দলটির গল্প বলেছে। ১৯৮৩ সালের মারদেকা কাপের আগেই আর্জেন্টিনার বিখ্যাত ক্লাব বোকা জুনিয়রর্স ডিয়েগো ম্যারাডোনাসহ মালয়েশিয়া সফর করেছিল। ম্যারাডোনা তখন দুনিয়ার উদীয়মান তারকা। ১৯৮২ বিশ্বকাপ খেলেছেন, ব্রাজিলের বিপক্ষে ম্যাচে একের পর এক ফাউলে ত্যক্ত–বিরক্ত হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে লালকার্ডও দেখেছেন। ১৯৭৮ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা তার আগে আর্জেন্টিনাকে জিতিয়েছিলেন বিশ্ব যুব কাপ। কিন্তু সিজার লুইস মেনোত্তির বিশ্বকাপজয়ী দলে জায়গা হয়নি ম্যারাডোনার। বোকার সফরের পর মালয়েশিয়া ফুটবল ফেডারেশন চেয়েছিল মারদেকা কাপে আর্জেন্টিনা জাতীয় দলকে খেলাতে। সেটি অবশ্য সম্ভব হয়নি কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টের কারণে। কার্লোস বিলার্দোর অধীনে আর্জেন্টিনা জাতীয় দল তখন কোপা আমেরিকা টুর্নামেন্টে খেলছিল। মালয়েশিয়াতে জাতীয় দল না পাঠালেও ১৯৮৪ সালের শুরুতে ভারতের আরেক বিখ্যাত টুর্নামেন্ট নেহেরু কাপে খেলেছিল আর্জেন্টিনা জাতীয় দল।
ক্লারিন সেই ম্যাচের একটা ছোট্ট বর্ণনা দিয়েছে, ‘খেলাটি বৃষ্টিভেজা মাঠে হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বিপক্ষে আর্জেন্টিনা একাদশ খুব দ্রুতই ভেজা মাঠের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে।’
১৯৮৩ মারদেকা টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন মোহামেডানের রাইটব্যাক আবুল হোসেন। আর্জেন্টিনা একাদশ ছাড়াও সেবার বাংলাদেশের গ্রুপসঙ্গী ছিল দক্ষিণ কোরিয়া, আলজেরিয়া, মালয়েশিয়া ও নেপাল। আর্জেন্টিনার কাছে ৫–২ গোলে হারার পর নেপালকে ১–০ গোলে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। ১৯৮২ বিশ্বকাপের চমক আলজেরিয়ার সঙ্গে সেবারই প্রথম (এখনো পর্যন্ত শেষবার) মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। ম্যাচটি হেরেছিল ২–০ গোলে। মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ হেরেছিল যথাক্রমে ১–০ ও ৩–১ গোলে।
২০১৮ সালে আর্জেন্টিনা একাদশের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি নিয়ে প্রথম আলোতে স্মৃতিচারণা করেছিলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম, ম্যাচের অন্যতম গোলদাতা। তিনি বলেছিলেন, ‘দলটা ওদের লিগের খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত হয়েছিল, এটা মনে আছে। আর্জেন্টিনার সেই চিরাচরিত আকাশি-সাদা জার্সিতে মাঠে নেমেছিল তারা। আমাদের মাথায় ছিল এই আর্জেন্টিনাই ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ জিতেছে। আমরা খুব খারাপ খেলিনি। কিন্তু দলটা ছিল দুর্দান্ত।’
সে ম্যাচে আসলামের স্মরণীয় স্মৃতি নিজের গোলই, ‘মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে গিয়ে গোল করেছিলাম। এক গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পর আমার গোলেই বাংলাদেশ সমতা আনে। কিন্তু সমতার পর আর্জেন্টাইন দলটি যেন আরও তেড়েফুঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। পরে আরও চার গোল খাই। বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় গোলটি করেছিল চুন্নু। পেনাল্টি থেকে।’