আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি ও ক্রোয়েশিয়া অধিনায়ক লুকা মদরিচ
আর্জেন্টিনা অধিনায়ক লিওনেল মেসি ও ক্রোয়েশিয়া অধিনায়ক লুকা মদরিচ

কাতার থেকে উৎপল শুভ্র

তিন মহাদেশের সেমিফাইনালে ‘সত্যিকারের বিশ্বকাপ’

স্বপ্ন সত্যি হলে বড় আনন্দ হয়। আর যে স্বপ্ন আপনি দেখেনইনি, সেটিই যদি সত্যি হয়ে যায়, তাহলে! তাহলে কেমন লাগে?

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া খুব সহজ। মরক্কোর যেকোনো ফুটবলারকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়! কাতারে কাতারে কাতার ছুটে আসা মরোক্কান সমর্থকদের কাউকেও। দ্বিতীয় দলের দেখা মিলছে দোহার প্রায় সবখানেই। সুক ওয়াকিফ নামে যে জায়গাটাকে এই বিশ্বকাপে সমর্থকদের মিলনমেলা বলা যায়, সেখানে এখন মরোক্কানদেরই সংখ্যাধিক্য। জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে তারা নাচছে, গাইছে।

সুক মানে বাজার। সুক ওয়াকিফ জায়গাটা কী, এতেই তা বুঝে ফেলার কথা। সারি সারি দোকান।হেন জিনিস নেই, যা পাওয়া যায় না। সাজানো-গোছানো সুন্দর দোকান যেমন আছে, তেমনি ঘিঞ্জি দোকানও। মাঝখানে ছোট্ট গলির মতো রাস্তা, দুই পাশে কাপড়ের দোকান। অনেকটা ঢাকার বঙ্গবাজারের মতো। দুই পাশে অবশ্য খোলা চত্বর। যেখানে কাল বিকেলেও মরোক্কানদের আনন্দোৎসব দেখলাম।

এই বিশ্বকাপে যে হোটেল আমার প্রায় ৩৩ দিনের ‘বাড়ি’, সেটিতেও প্রচুর মরোক্কান। তাদের চোখে বিশ্বকাপের বদলে যাওয়া রঙের সঙ্গেও পরিচয় হলো এই কদিনে। মরক্কোর প্রথম ম্যাচের দিন মরক্কো বিশ্বকাপে খেলছে, এতেই তাদের খুশি দেখেছি। বেলজিয়াম আর ক্রোয়েশিয়ার গ্রুপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার পর শুনেছি, আর কিছু পাওয়ার নেই। মরক্কোর বিশ্বকাপ ‌‘জেতা’ হয়ে গেছে।

মরক্কো অধিনায়ক রোমেইন সাইস

দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেনের পর কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালকে হারানোর পর সেই সমর্থকেরাই এখন বলছেন, ‘আমরা কেন বিশ্বকাপ জিততে পারব না?’ হোটেল লবিতে মরোক্কান সমর্থকদের জটলার মধ্যে বছর পঁচিশের তরুণ মনে করিয়ে দিলেন, ‘আপনি তো সাংবাদিক। নিশ্চয়ই জানেন, এই বিশ্বকাপে এখনো কোনো দল আমাদের গোল দিতে পারেনি।’ পাঁচ ম্যাচে একটিমাত্র যে গোল খেয়েছে মরক্কো, তা যে আত্মঘাতী—এটা জানি কি না, সেই পরীক্ষাও দিতে হলো।

শেষ পর্যন্ত কোন ছবিটা এই বিশ্বকাপের অমর ছবি হয়ে থাকে, কে জানে! একটা ছবি এসে তো আরেকটাকে ঢেকে দেয়। নেইমার-রোনালদোর কান্নাভেজা বিদায়, পেনাল্টি মিস করার পর হ্যারি কেইনের বিষাদমাখা মুখ এখনো হয়তো চোখে ভাসছে সবার। এসবের তো বহুমাত্রিক অর্থ আছে। নেইমার আবারও বিশ্বকাপ খেলবেন কি না, ঠিক নেই।

রোনালদো যে শেষটা খেলে ফেলেছেন, তা নিয়ে অবশ্য খুব একটা সংশয় নেই। বিশ্বকাপে দুজনেরই শেষ ছবি হয়ে থাকতে পারে ওই কান্নাভেজা মুখ। ব্রাজিলের পক্ষে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড ছুঁয়ে নেইমারের বিদায়। হ্যারি কেইনেরও ইংল্যান্ডের হয়ে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড ছোঁয়ার পর।

ফ্রান্স অধিনায়ক উগো লরিস

কেইন অবশ্য তা ছাড়িয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগও পেয়েছিলেন। তা কাজে লাগাতে না পারার তাৎপর্য শুধুই একটা ব্যক্তিগত অর্জন থেকে বঞ্চিত হওয়ার চেয়েও অনেক বড়।

দারুণ খেলেও ফ্রান্সের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে ইংল্যান্ডকে। ব্যতিক্রমই বলতে হবে, হ্যারি কেইনকে ইংল্যান্ডের কেউই সে জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন না। কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের পদত্যাগ দাবি করার বদলে তিনি যেন চুক্তি অনুযায়ী আগামী ইউরো পর্যন্ত থেকে যান, সেই অনুরোধ করছেন ইংল্যান্ডের সাবেকেরা।

নেইমার-রোনালদো আছেন, আছেন হ্যারি কেইন—একটা বিশ্বকাপ এমন কত ছবিই তো উপহার দেয়। সব ছাপিয়ে এখন কি মরক্কোই এই বিশ্বকাপের অমর ছবি? পর্তুগালকে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠে যাওয়ার পর মাঠে মাকে নিয়ে নাচছেন মরক্কোর মিডফিল্ডার সোফিয়ান বোফাল, ছেলেকে নিয়ে মরক্কোর গোলকিপার ইয়াসিন বুনু। আফ্রিকা থেকে এর আগে তিনটি দেশ কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে।

১৯৯০ সালে ক্যামেরুন, ২০০২ সালে সেনেগাল, ২০১০ সালে ঘানা। এই প্রথম সেমিফাইনালে আফ্রিকার কোনো প্রতিনিধি। মরক্কোর এই স্বপ্নযাত্রার মহিমা তো এখানেই শেষ নয়। আরবের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপে আরবের পতাকাও উড়ছে তাদের হাতেই। সেমিফাইনালে আবার প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। যে ফ্রান্স দীর্ঘদিন উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছিল মরক্কোকে। ফ্রান্স-মরক্কো সেমিফাইনালটা এখানেই শুধুই একটা ফুটবল ম্যাচের সীমা ছাড়িয়ে বৃহত্তর তাৎপর্য নিয়ে দেখা দিচ্ছে।

মরক্কোর শেষ চারে উঠে আসা যোগ করেছে বাড়তি রং। বিশ্বকাপকেও সত্যিকার বিশ্বকাপের রূপ দিয়েছে। চার বছর আগে রাশিয়া বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের চারটি দলই ছিল ইউরোপের। আর এখানে চার সেমিফাইনালিস্ট এসেছে ভিন্ন তিনটি মহাদেশ থেকে। ইউরোপ যেমন আছে, তেমনি আছে দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকা। আগামীকাল প্রথম সেমিফাইনালটিই যেমন ইউরোপ বনাম দক্ষিণ আমেরিকা। মেসির আর্জেন্টিনার মুখোমুখি মদরিচের ক্রোয়েশিয়া।

প্রতিটি বিশ্বকাপেই নতুন একটা বল বাজারে নিয়ে আসে অ্যাডিডাস। প্রথমবারের মতো এই বিশ্বকাপের অফিশিয়াল বল দুটি। এত দিন খেলা হয়েছে ‘আল রিহলা’ বলে। আল রিহলা অর্থ ‘দ্য জার্নি’। সেমিফাইনাল আর ফাইনাল খেলা হবে যে বলে, সেটির নাম ‘আল হিলম্’। অর্থ ‘দ্য ড্রিম’।

নতুন বলের নামটা মরোক্কানদের খুব পছন্দ হওয়ার কথা। তাদের জন্য এই বিশ্বকাপের নামও তো এটাই। দ্য ড্রিম!