বড় ম্যাচে কৌশলগত ভুল করার কারণে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে পেপ গার্দিওলাকে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার গায়েব করে দিয়ে খোয়াতে হয়েছিল শিরোপাও। তবে ভন্ডুল করে বসার সেই অপবাদ আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে যেন অনেকটাই দূর করে নিলেন ম্যানচেস্টার সিটি কোচ।
আর্সেনালের বিপক্ষে গতকাল রাতের জয়ে কৌশলগতভাবে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন গার্দিওলা। মূলত তাঁর অভ্রান্ত কৌশলই সিটির জয়ের ভিতটা গড়ে দেয়। খেলোয়াড়েরা কেবল মাঠে নেমে পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন করে ম্যান সিটিকে এনে দিয়েছে ৪–১ গোলের জয়।
এ মৌসুমে বারবার ফরমেশন বদল করে দলকে খেলিয়েছেন গার্দিওলা। গতকাল তাঁকে দেখা গেল কখনো ৪–৪–২ খেলাতে, আবার কখনো ৪–২–৩–১ কিংবা কখনো ৩–২–৪–১ ফরমেশনেও দলকে খেলিয়েছেন এই স্প্যানিশ কোচ। সিটির এমন কৌশলগত পরিবর্তন হয়তো কিছুটা অপ্রত্যাশিতই ছিল আর্সেনাল কোচ মিকেল আরতেতার কাছে। যদিও কিছু একটা যে ঘটতে পারে তা একরকম জানা ছিল আর্সেনাল কোচের। ম্যাচের আগে বলেছিলেন, ‘এটা ( সিটির কৌশলগত পরিবর্তন) ঘটতে পারে ম্যাচের এক মিনিটে, ২০ মিনিটে কিংবা ৬০ মিনিটে।’
আরতেতা হয়তো ভেবেছিলেন, জন স্টোনস ও কাইল ওয়াকার মিডফিল্ডে উঠে এসে ভূমিকা রাখবেন। কিন্তু মাঠের খেলায় তেমন কিছুই হলো না। রক্ষণ ও আক্রমণে কৌশলগত সূক্ষ্ম সব পরিবর্তন এনে আরতেতাকে রীতিমতো বিমূঢ় করে রাখেন গার্দিওলা। এদিন রদ্রি ও গুন্দোয়ানকে বরং দেখা গেল মাঝে এবং গভীরে গিয়ে খেলতে, যা সিটির জন্য অনেক বড় জায়গা তৈরি করে দেয়।
ইতিহাদে ম্যাচের শুরু থেকেই হাই প্রেসিংয়ে আর্সেনালকে কোণঠাসা করে রাখে সিটি। কোনো দিক থেকেই নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিল না অতিথিরা। প্রথমার্ধে ৪–৪–২–এ খেলে আর্সেনাল চেষ্টা করে পাল্টা জবাব দেওয়ার। কিন্তু পুরো ৪৫ মিনিটজুড়ে গানারদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান কেভিন ডি ব্রুইনা। ফাঁকা জায়গা বের করে আর্সেনালের রক্ষণকে থিতু হতে দিচ্ছিলেন না এই বেলজিয়ান মিডফিল্ডার।
এই পরিস্থিতিতে ডি ব্রুইনাকে আগ্রাসীভাবে মার্ক করার দরকার ছিল আর্সেনালের। কিন্তু সেটি করার অর্থ হচ্ছে একজন খেলোয়াড়কে দায়িত্ব দিয়ে তাঁকে মার্ক করানো কিংবা ব্যাক ফোর থেকে একজনকে বাইরে নিয়ে আসা। গার্দিওলার এই অদলবদল পরিস্থিতির সামনে রীতিমতো চোখে শর্ষে ফুল দেখা শুরু করেছিলেন আর্সেনাল খেলোয়াড়েরা। কীভাবে সামাল দেবে, তা ভাবতেই ভাবতেই জালে বল জড়ায় ২ বার। অবশ্য আর্সেনালের কপাল ভালো যে প্রথমার্ধে ২–০ ব্যবধানে পিছিয়ে ছিল তারা। গোলরক্ষক ত্রাতা না হলে এদিন অন্তত ৪–৫ গোল খেয়ে বিরতিতে যেতে হতো তাদের।
আর্সেনাল চেষ্টা করছিল রক্ষণে এবং রদ্রি–গুন্দোয়ানকে আটকাতে ম্যান টু ম্যান মার্কিংয়ে যাওয়ার। কিন্তু এটি করতে গেলেই ডি ব্রুইনার জন্য জায়গা তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। অন্য দিকে লাইন ভাঙার জন্য সিটি চেষ্টা করছিল খেলোয়াড় বাড়িয়ে চাপ তৈরি করতে। সিটির এই গতিকে কমাতে আরতেতার কোনো চেষ্টায় যেন কাজ করছিল না। বিল্ডআপেও গার্দিওলার কৌশলের সঙ্গে পেরে উঠছিল না আর্সেনাল।
এমন পরিস্থিতিতে আরতেতার হাতে জায়গা ধরে খেলোয়াড়দের দাঁড় করিয়ে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আরতেতার কোনো কৌশলই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। আত্মসমর্পণ ছাড়া তাঁর আর কোনো পথও খোলা ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধে অবশ্য সিটির প্রেসের সঙ্গে কিছুটা মানিয়ে নেয় আর্সেনাল। বিল্ডআপে সিটিও তখন বাড়তি কাউকে রাখা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ৩–০ গোালে পিছিয়ে গিয়ে ম্যাচ থেকেই ছিটকে পড়েছে আর্সেনাল।
ম্যাচে নিজেদের কৌশল নিয়ে ম্যাচ শেষে কেভিন ডি ব্রুইনা বলেছেন, ‘যখন তারা ম্যান টু ম্যান খেলা শুরু করে, আমাদের লম্বা পাসের কৌশলে যেতে হয়। কারণ, তখন আর ছোট পাস দেওয়ার সুযোগ ছিল না। আমাদের আরও গোল করা উচিত ছিল। ভাগ্য ভালো যে দ্বিতীয় গোলটি অফসাইড ছিল না। সেটিই ম্যাচ বদলে দিয়েছে। দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচটা ৫০–৫০ ছিল। তারা দারুণ একটি দল। তাদের বিপক্ষে খেলা কঠিন।’
এই ম্যাচে গার্দিওলার দলের আনসাং হিরো ছিলেন ম্যানুয়েল আকানজি। এ মৌসুমে দুর্দান্ত খেলা বুকায়ো সাকাকে যেখানে শীর্ষ সারির লেফটব্যাকরাও থামাতে পারেননি, সেখানে আকানজি তাঁকে চুপ করিয়ে রাখার কাজটি বেশ ভালোভাবেই করেছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে আকানজি কিন্তু লেফটব্যাক নন।
এর আগে তাঁকে কখনো এই পজিশনে খেলতেও দেখা যায়নি। গার্দিওলার এই মাস্টারস্ট্রোকও দারুণভাবে কাজে লেগে যায়। রদ্রি এবং গুন্দোয়ানের সঙ্গে তাঁর বোঝাপড়াটাও ছিল দেখার মতোই। তাঁকে সাহায্য করেছেন জ্যাক গ্রিলিশও। সাকার নিষ্প্রভ থাকার খেসারতও বেশ ভালোভাবে দিতে হয় আর্সেনালকে।
গোলের পর গোল করে রেকর্ড ভেঙে দিলেও হলান্ডকে নিয়ে সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে, খেলায় বৈচিত্র্য না থাকা কিংবা নিচে নেমে খেলতে না পারা। কিন্তু দলের প্রয়োজনে হলান্ড যে কী করতে পারেন, সেটি আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচেই প্রমাণ করলেন এই নরওয়েজীয় তারকা।
কাল অনেক সময় নিচে নেমে খেলতে দেখা গেছে তাঁকে। ডি ব্রুইনাকে প্রথম গোলে দেওয়া পাসটিও ছিল তাঁর দুর্দান্ত। প্লেমেকারের মতোই নিঁখুতভাবে বলটি সামনে বাড়ান হলান্ড। প্রিমিয়ার লিগে এর আগে হলান্ডকে ৮ গোলে অ্যাসিস্ট করেছেন ডি ব্রুইনা। আজ যেন তাঁরই কিছুটা পুষিয়ে দিলেন হলান্ড।
তবে কে অ্যাসিস্ট করছেন আর কে গোল করছেন তার চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে হলান্ড–ডি ব্রুইনার বোঝাপড়া। সম্ভবত পেপ যুগের সবচেয়ে কার্যকর জুটিও এটি। গোলের জন্য বাড়ানো বলটি ছাড়াও একাধিকবার হলান্ড–ডি ব্রুইন একে অপরের জন্য বল ছেড়েছেন। বিশেষ করে হলান্ডের বক্স ছেড়ে নিচে নেমে আসা ছিল দেখার মতো।
চিরায়ত প্লেমেকার ও স্কোরারের ভূমিকাও এখানে গৌণ করে দিয়েছেন তাঁরা। কাজটা এতটাই সাবলীল দেখাচ্ছিল যে মনে হচ্ছিল, চোখ বন্ধ করেও বলকে জায়গামতো পৌঁছে দিতে পারবেন তাঁরা। সিটির এই রূপটিই তাঁদের সবচেয়ে ভয়ংকর করে তুলেছে এ ম্যাচে।