আজ রাতে খেলোয়াড়দের সঙ্গে নিয়ে ওয়েম্বলির টানেল দিয়ে হেঁটে আসার সময় বিশেষ কিছু কি মনে পড়বে এদিন তেরজিচের? মানুষের মনের ভেতরটায় উঁকি দিয়ে দেখার কোনো যন্ত্র এখনো আবিষ্কার হয়নি। হলে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই দেখে নিতেন তেরজিচের মনের ভেতর কী চলছে! অবশ্য উঁকি না দিয়েও বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের এই কোচের মনের খবর অনুমান করে নেওয়া যায়। বড় একটা অংশজুড়ে নিশ্চয়ই কাজ করবে ফাইনালের নানা হিসাব–নিকাশ ও কৌশলগত দিকগুলো।
তবে এসবের মধ্যেও তাঁর হয়তো মনে পড়বে ১১ বছর পুরোনো একটি ঘটনা, কিছু টুকরা স্মৃতি। যার সমস্তটায় শুধুই বিষাদ। সেবার এই ওয়েম্বলিতেই প্রিয় ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের হারের সাক্ষী হয়েছিলেন তেরজিচ। অনেক আশা নিয়ে এসেও শেষটা হয়েছিল হতাশায়। ২০১২–১৩ সালের সেই ফাইনালে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে শিরোপা হাতছাড়া করেছিল ডর্টমুন্ড। সেদিন অবশ্য তেরজিচের ভূমিকা ছিল একেবারেই ভিন্ন। ডাগআউটে নয়, সেদিন তিনি এসেছিলেন গ্যালারিতে, ডর্টমুন্ডের একজন সমর্থক হিসেবে।
ডর্টমুন্ড থেকে ৪০ কিলোমিটার পূর্বে মেনদেনে তেরজিচের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা কিংবা মা কেউই অবশ্য জার্মান নন। বাবার বাড়ি বসনিয়ায় এবং মায়ের ক্রোয়েশিয়ায়। যুগোস্লাভিয়ার অভিবাসী হিসেবেই বড় হয়েছেন তিনি। শৈশব থেকেই ছিলেন ডর্টমুন্ডের একনিষ্ঠ ভক্ত। শুধু ভক্ত হয়েই অবশ্য থাকতে চাননি, চেয়েছিলেন ফুটবলের রঙিন দুনিয়ায় নিজেকে মেলে ধরতে। সে স্বপ্ন অবশ্য পূরণ হয়নি। দ্রুত পথ বদলে চলে আসেন কোচিংয়ের মঞ্চে।
অপেশাদার লিগে খেলার পাশাপাশি ২০১০ সালে ক্রীড়াবিজ্ঞানে ডিগ্রিও নিয়ে রাখেন তিনি। কোচ হিসেবে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে মেধাকে যতটা সম্ভব শাণিয়ে নিয়েছেন। ইয়ুর্গেন ক্লপ যখন ডর্টমুন্ডের ডাগআউটে, তখন তিনি ক্লাবটিতে স্কাউট হিসেবে কাজ করেন। পরে তুরস্কের ক্লাব বেসিকতাসে স্লাভেন বিলিচের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। বিলিচের সহকারী হিসেবে ছিলেন ওয়েস্ট হামেও।
ক্লাব বদলের এই ধারাতেও নিজের আত্মপরিচয় ভোলেননি তেরজিচ। তিনি ডর্টমুন্ডের ভক্ত, সে কথা কখনোই ভুলে যাননি। ফাইনালের আগেও যেন মনে করিয়ে দিতে চাইলেন সে কথা, ‘২০১৩ সালে আমার যাত্রাটা ছিল ভক্ত হিসেবে। ম্যাট হুমেলস, মার্কো রয়েস, নুরি সাহিন, সভেন বেনডাররা ছিলেন টিম বাসে, আর আমি ছিলাম ফ্যান বাসে। আমাদের সবার ব্যক্তিগত গল্প আছে। আমি নিজের গল্পটাকে সামনে রাখতে চাই না। এটা আসলে একটি যাত্রায় একসঙ্গে যাওয়ার মতো ব্যাপার।’
এর মধ্যে ২০১৭ সালে বিলিচের ছায়াসঙ্গী হিসেবে ফিরে আসেন ডর্টমুন্ডে। কে জানত, নিয়তি তাঁর জন্য উপহারের ডালা সাজিয়ে বসে আছে! যে ক্লাবের ভক্ত এবং সহায়ক হিসেবে এত দিন কাজ করেছেন ৩৯ বছর বয়সেই তিনি হলেন সেই ক্লাবটিরই কোচ। এটুকুতেই হতে পারত তেরজিচের স্বপ্নপূরণের গল্পের শেষ। কিন্তু গল্প যে তখনো বাকি। এখন ডর্টমুন্ডকে ইউরোপ–সেরা বানানোর উপলক্ষ তেরজিচের সামনে। জার্মান বুন্দেসলিগায় এ মৌসুমে যাত্রাটা ভালো না হলেও চ্যাম্পিয়নস লিগে ডর্টমুন্ড ছিল অনবদ্য। রক্ষণ সামলে আক্রমণে যাওয়ার কৌশলকে সামনে রেখেই সাফল্য পেয়েছেন তিনি।
এ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা ১২ ম্যাচের ১০টিতেই প্রথমার্ধে কোনো গোল হজম করেনি ডর্টমুন্ড। রক্ষণে এই দৃঢ়তা আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাসকেও চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। সেমিফাইনালে পিএসজির বিপক্ষে রক্ষণাত্মক ফুটবলের মাস্টারক্লাসকে কাজে লাগিয়েই ফলকে নিজেদের পক্ষে নিয়েছিল ডর্টমুন্ড। দুই লেগে কিলিয়ান এমবাপ্পে–উসমান দেম্বেলের ডর্টমুন্ডের জাল খুঁজে পায়নি। রক্ষণে তৈরি হওয়া হলুদের মায়াজালে শেষ পর্যন্ত আটকে গেছে পিএসজির চ্যাম্পিয়নস লিগ স্বপ্ন। এখন একই ধরনের পারফরম্যান্সে আজ রাতে ওয়েম্বলিতে আরেকবার ফিরিয়ে আনার অপেক্ষা।
তেরজিচ দলকে বেশির ভাগ সময় ৪–২–৩–১ এবং ৪–৩–৩ ফরমেশনে খেলাতে পছন্দ করেন। তাঁর অধীনে ডর্টমুন্ড পজেশনভিত্তিক ফুটবলও ভালোভাবে রপ্ত করেছে। তেরজিচের অধীনে প্রথম মৌসুমে ডর্টমুন্ডের দখলে বল ছিল গড়ে ৫৮ শতাংশ। সেবার শেষ দিনের নাটকীয় বুন্দেসলিগার দ্বিতীয় স্থানে থেকে শেষ করে হলুদ–কালো দলটি। তেরজিচের সাধারণত ব্যাক ফোর রেখে দল সাজান। এরপর সামনে তেরজিচ একজন পিভট (ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার) ব্যবহার করেন এবং সঙ্গে থাকেন দুজন নম্বর এইটও। যাঁরা সাধারণত ফুলব্যাকদের সঙ্গে সমন্বয় করেন। প্রতিপক্ষের জন্য জায়গা সংকুচিত করতে এ সময় উইংয়ের খেলোয়াড়েরা ভেতরের দিকে চলে আসেন এবং পাস দেওয়ার সুযোগও অনেক বেড়ে যায়। তেরজিচ সাধারণত চেষ্টা করেন মাঝমাঠে খেলোয়াড় বাড়িয়ে আক্রমণে যাওয়ার সময় বলের দখল রাখার বিষয়টি সুনিশ্চিত রাখার।
রিয়ালের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে ফাইনালে অবশ্য কাজটা মোটেই সহজ হবে না। হয়তো কৌশলগতভাবে ক্রুসকে আটকানোর জন্য নিকলাস ফুলক্রুগ, জুড বেলিংহামকে থামানোর জন্য ইউলিয়ান ব্রান্ট কিংবা ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে থামাতে হুমেলসরা সক্রিয় থাকবেন। এর বাইরেও রিয়ালের পাসিং পয়েন্ট ব্লক করার মতো যথেষ্ট কার্যকর খেলোয়াড়ও তাদের আছে। কিন্তু ডর্টমুন্ডের জন্য এ ম্যাচে বড় মাথাব্যথা হতে পারে রিয়ালের বিভিন্ন খেলোয়াড়ের একক নৈপুণ্য।
ডর্টমুন্ড সাধারণত দলীয় ঐক্যকে নিজেদের কৌশলের কেন্দ্রে রেখে প্রতিপক্ষকে থামানোর চেষ্টা করে। সে ক্ষেত্রে একটি গোল পেয়ে গেলে পুরো ম্যাচটাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে তারা। কিন্তু রিয়ালে ব্যক্তিগতভাবে জাদু দেখানোর মতো একাধিক খেলোয়াড় আছেন, যাঁদের জাদুকরি ছোঁয়ায় মুহূর্তের মধ্যে বদলে যেতে পারে দৃশ্যপট। আজ রাতে তেরজিচকে স্বপ্নপূরণ করতে হলে রিয়ালের সেই জাদুটাকেই নিষ্ক্রিয় করতে হবে। সে সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে গোলটা যেন তারা আগে করতে পারে। সেটি করতে পারলে পিএসজির বিপক্ষে দেখানো ডিফেন্সিভ মাস্টারক্লাসকে আরেকবার ফিরিয়ে আনতে পারবেন হুমেলস–রায়েরসনরা।
তেরজিচ অবশ্য রিয়ালকে থামাতে যত কৌশলই গ্রহণ করুন, কাজটা যে মোটেই সহজ নয়, সেটা তাঁর ভালোই জানা। রিয়ালের দলীয় শক্তি তো আছেই, পাশাপাশি ম্যাচটি আবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল! এই ম্যাচ সামনে পেলে রিয়াল রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। বার্নাব্যুর এই দলকে থামাতে হলে তেরচিজকে আজ রাতে দানবীয় কিছুই করে দেখাতে হবে।