ইন্দোনেশিয়ার কানজুরুহান ফুটবল স্টেডিয়ামে গত রাতে দর্শক হাঙ্গামায় পদদলিত হয়ে মারা গেছেন অন্তত ১২৫ জন। ফুটবলে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। আরেমা এফসি ও পেরসেবায়া সুরাবায়ার মধ্যকার খেলার পরই ঘটে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। খেলায় আরেমাকে ৩-২ গোলে হারায় পেরসেবায়া। দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে পেরসেবায়ার কাছে এই প্রথম কোনো ম্যাচে হারল আরেমা। ম্যাচের পর মাঠে নেমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দুই দলের সমর্থকেরা। তাদের থামাতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে তৈরি হয় আতঙ্ক। হুড়োহুড়ি করে মাঠ ছাড়তে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা যান দর্শকেরা।তবে ফুটবল মাঠে এমন দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়। এর আগেও অনেকবার ফুটবল ম্যাচকে ঘিরে এমন তাজা প্রাণ ঝরে যেতে দেখেছে ফুটবল বিশ্ব। তারই কিছু এখানে তুলে ধরা হলো।
মৃত্যু: ৩২০
১৯৬৪ সালের মে মাসে পেরুর স্তাদিও নাসিওনালে ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়গুলোর একটি ঘটেছিল। ম্যাচটি ছিল পেরু বনাম আর্জেন্টিনার। রেফারির সিদ্ধান্তে সেদিন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন পেরুর সমর্থকেরা। একপর্যায়ে দর্শকেরা মাঠে নেমে আসেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করে। আতঙ্কিত হয়ে দর্শকেরা মাঠ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেন। ইস্পাতের তৈরি মূল ফটকটি ছিল বন্ধ। হুড়োহুড়ি আর গাদাগাদির কারণে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ৩২০টি তাজা প্রাণ।
মৃত্যু: ১২৬
ঘানার আক্রার ওহেন জান স্টেডিয়ামে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি আফ্রিকার তো বটেই, ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম কালো অধ্যায়। সেদিন ঘানার সবচেয়ে সফল দুটি ক্লাব আক্রা হার্টস অফ ওক এবং আসান্তে কোটাকো মুখোমুখি হয়েছিল। ২-১ গোলে হেরে যাওয়া হতাশ কোটাকোর দর্শকেরা মাঠে প্লাস্টিকের আসন ও বোতল ছুড়তে শুরু করেন। বিশৃঙ্খলা থামাতে কঠোর অবস্থান নেয় পুলিশ। একপর্যায়ে ছুড়তে শুরু করে কাঁদানে গ্যাস। আতঙ্কিত হয়ে দর্শকেরা ছোটাছুটি করে বেরোনোর চেষ্টা করলে পদদলিত হয়ে মারা যান ১২৬ জন।
মৃত্যু: ৯৭
‘হিলসবরো ট্র্যাজেডি’র বিপর্যয় থেকে এখনো বের হতে পারেননি লিভারপুলের অনেক সমর্থক। ফুটবল ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাগুলোর একটি এটি। ১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল এফএ কাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল লিভারপুল ও নটিংহাম ফরেস্ট। শেফিল্ডের হিলসবরো স্টেডিয়ামে সেদিন খেলা দেখতে স্টেডিয়ামের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন অসংখ্য লিভারপুল সমর্থক। চাপ কমাতে একপর্যায়ে নিরাপত্তারক্ষীরা দর্শকদের ভেতরে ঢোকার জন্য স্টেডিয়াম থেকে বাইরে বের হওয়ার একটি ফটকও খুলে দেন। যার ফল হয়েছে আরও ভয়াবহ। স্রোতের মতো দর্শক ঢুকতে শুরু করেন ভেতরে, যার ফলে পদদলিত হয়ে মারা যান ৯৭ জন।
মৃত্যু: ৯০ জন
নেপালের যে দশরথ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের মেয়েরা কদিন আগে শিরোপা জয়ের উল্লাসে মেতেছিলেন, সে মাঠেই ১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় মারা যান ৯০ জন ফুটবলপ্রেমী। সেদিনের সেই ঘটনার সঙ্গেও আছে বাংলাদেশের যোগ। ত্রিভুবন চ্যালেঞ্জ শিল্ডে বাংলাদেশের ক্লাব মুক্তিযোদ্ধার প্রতিপক্ষ ছিল জনকপুর সিগারেট ফ্যাক্টরি। সেদিন শিলাবৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য হুড়োহুড়ি করে স্টেডিয়াম থেকে বেরোতে গিয়েছিলেন দর্শকেরা। আহত হন শতাধিক মানুষ।
মৃত্যু: ৮০
ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি দর্শকের চাপে পদদলিত হয়ে ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে গুয়াতেমালায় মারা যান অন্তত ৮০ জন দর্শক। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে সেদিন মুখোমুখি হয়েছিল গুয়াতেমালা ও কোস্টারিকা। গুয়াতেমালা সিটির এস্তাদিও মাতেও ফ্লোরেসে সেদিন খেলা দেখতে গিয়েছিল অগুনতি মানুষ। দর্শকদের হুড়োহুড়ি থেকেই শুরু হয় মর্মান্তিক এ ঘটনার। তবে ঘটনার সূত্রপাত নিয়ে আলাদা কারণের কথা বলেছে ফিফা ও গুয়াতেমালা সরকার।
মৃত্যু: ৭৪
মিসরের দুই ক্লাব আল-মাসরি এবং আল-আহলির সমর্থকদের দাঙ্গায় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির সংঘর্ষে মারা যান অন্তত ৭৪ জন। এ ঘটনায় আহত হন হাজারের বেশি মানুষ। এরপর দুই বছরের জন্য মিসরীয় লিগ বন্ধ ছিল।
মৃত্যু: ৬৬
২০ অক্টোবর ১৯৮২ সালে উয়েফা কাপের ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল রাশিয়ার ক্লাব স্পার্তাক মস্কো ও ডাচ ক্লাব এইচএফসি হার্লেম। তবে খেলা দেখতে আসা দর্শকেরা জানতেন না, কী বিপর্যয় অপেক্ষা করছে। ‘লুজিনিকি বিপর্যয়’ নামে পরিচিত এ দুর্ঘটনায় পদদলিত হয়ে সেদিন মারা গিয়েছিলেন ৬৬ জন দর্শক। রাশিয়ার ক্রীড়াজগতে এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা। তবে মৃতের সংখ্যা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। এ ঘটনার সাত বছর পর্যন্ত মৃতের আনুষ্ঠানিক সংখ্যা গোপন রাখা হয়েছিল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলেছে, সেদিন ৩৪০ জন দর্শকের প্রাণহানি হয়ে থাকতে পারে।
মৃত্যু: ৫৬
ব্র্যাডফোর্ডের ভ্যালি প্যারেড স্টেডিয়ামে এ দুর্ঘটনা ১৯৮৫ সালের ১১ মে। তৃতীয় বিভাগের ম্যাচে ব্রাডফোর্ডের মুখোমুখি হয়েছিল লিংকন সিটি। পুরোনো দিনের ঐতিহ্যের ছাপ থাকায় স্টেডিয়ামটির বিশেষ পরিচিতি ছিল। যার প্রধান স্ট্যান্ডটি ছিল কাঠের নির্মিত। স্ট্যান্ডের বসার জায়গার নিচে বড় গহ্বরে আবর্জনার স্তূপ তৈরি হওয়ায় আগে থেকে সতর্কবার্তাও দেওয়া হয়েছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে এ স্ট্যান্ড নিন্দাও জানানো হয়েছিল। মৌসুম শেষে ইস্পাত দিয়ে নতুন স্ট্যান্ডটি তৈরি করার কথাও বলা হচ্ছিল। তবে সে পর্যন্ত আর সময় মেলেনি। মৌসুমের শেষ ম্যাচের দিনই দর্শকে যখন গ্যালারি পরিপূর্ণ, আগুন লেগে যায় স্টেডিয়ামে। শুরুতে আগুনের তীব্রতা কম থাকলেও, বাতাসের কারণে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় সেদিন মারা যান ৫৬ জন, আহত হন ২৬৫ জন।
মৃত্যু: ৪৩
দক্ষিণ আফ্রিকার এলিস পার্ক স্টেডিয়ামে জোরপূর্বক প্রবেশ করতে গিয়ে ২০০১ সালের এপ্রিলে মারা যান অন্তত ৪৩ জন।
মৃত্যু: ৪০
১৩ জানুয়ারি, ১৯৯১ সাল। ওপেনহেইমের স্টেডিয়ামে প্রাক্–মৌসুম ম্যাচের সময় পদদলিত হয়ে মারা যান ৪২ জন। দক্ষিণ আফ্রিকার খনি-শহর অর্কনিতে সেদিন মুখোমুখি হয়েছিল কাইজার চিফস এবং দ্য অরলান্ডো পাইরেটস। ২৩ হাজার আসনের গ্যালারিতে দর্শক ছিল প্রায় ৩০ হাজার। দলের সমর্থনের ভিত্তিতে সেদিন দর্শকদের আলাদা করে বসার ব্যবস্থাও ছিল না। কাইজারের করা গোল রেফারি বাতিল না করায় প্রতিবাদ জানান অরলান্ডোর সমর্থকেরা। একপর্যায়ে তাঁরা কাইজারের সমর্থকদের দিকে পানীয়র ক্যান এবং ফল ছুড়ে মারেন। এমনকি ছুরি নিয়েও কাইজার সমর্থকদের ওপর হামলা চালান অরলান্ডোর সমর্থকেরা। এরপর আতঙ্কিত হয়ে দর্শকেরা হুড়োহুড়ি শুরু করলে পদদলিত হয়ে ঝরে যায় ৪০টি প্রাণ।
মৃত্যু: ৩৯
ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালে জুভেন্টাস–লিভারপুল ম্যাচ ঘিরে সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যান ৩৯ জন, আহত হন ছয় শতাধিক। ব্রাসেলসের হেইসেল স্টেডিয়ামে ম্যাচ শুরুর আগেই শুরু হয় সংঘর্ষ। একপর্যয়ে পালাতে গিয়ে দেয়াল ধসে পড়ে মারা যান দুই ক্লাবের সমর্থকেরা। তবে মৃতের তালিকায় জুভেন্টাসের সমর্থকই ছিল বেশি।
মৃত্যু: ১৯
আইভরি কোস্ট ও মালাউইয়ের বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচের আগে ২০০৯ সালের মার্চে পদদলিত হয়ে মারা যান ১৯ জন।
মৃত্যু: ১৮
১৯৯২ সালের ৫ মে ফ্রেঞ্চ কাপের সেমিফাইনালে ঘটেছিল এ দুর্ঘটনা। মার্শেই–বাস্তিয়ার খেলা শুরুর আগেই ধসে পড়ে একটি স্ট্যান্ড। এ দুর্ঘটনায় ১৮ জন মারা যান, আহত হন ২ হাজার ৩০০। গত বছর দেশটির সংসদে ক্ষতিগ্রস্তদের স্মরণে ৫ মে ম্যাচ আয়োজন নিষিদ্ধ করা হয়।