পিএসজির দুই ক্লাব সতীর্থকে আজ সেমিফাইনালে দেখা যাবে প্রতিপক্ষ হিসেবে
পিএসজির দুই ক্লাব সতীর্থকে আজ সেমিফাইনালে দেখা যাবে প্রতিপক্ষ হিসেবে

কাতার থেকে উৎপল শুভ্র

সেমিফাইনালে দুই বন্ধুরও লড়াই

গল্প-উপন্যাসে এমন হয় কিংবা সিনেমায়। এক বন্ধু আরেকজনকে দুষ্টুমি করে বলছেন, বিশ্বকাপে তোমার সঙ্গে দেখা হবে আর আমি তোমাকে উড়িয়ে দেব। ওই বন্ধুও হেসে পাল্টা হুমকি দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। বন্ধুদের মধ্যে এমন মজা তো হয়ই।

মজা ছাড়া আর কী! ওই দুই বন্ধুর একজনের দল এসেছে চার বছর আগে জেতা বিশ্বকাপ ধরে রাখতে। আরেকজনের দল নিছকই সংখ্যা পূরণ করতে। দুজনের দেখা হবে কীভাবে! দল দুটি এক গ্রুপে পড়লে না হয় কথা ছিল। তারপরও সত্যি সত্যি যখন দুই বন্ধুর দেখা হয়ে যায়, সেটিও বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে; তখনই তা কল্পকাহিনির রূপ নেয়।

তা ফ্রান্স-মরক্কো সেমিফাইনাল তো কল্পকাহিনি আর বাস্তবের সীমারেখা মুছে দিতেই চায়। বছরের শুরুতে কাতারে এসে প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের দুই সতীর্থ ও বন্ধু যে ভিডিওটা করেছিলেন, তা এত দিনে এসে রীতিমতো ভাইরাল। কিলিয়ান এমবাপ্পে আর আশরাফ হাকিমির যে সত্যি সত্যিই বিশ্বকাপে দেখা হচ্ছে!

সেই দেখাও এমন নয় যে দুজন শুধু দুই দলে খেলবেন। আক্ষরিক অর্থেই আজ তাঁরা মুখোমুখি। আশরাফ হাকিমি খেলেন রাইটব্যাক পজিশনে। মাঠের ওই প্রান্তটা দিয়েই কিলিয়ান এমবাপ্পে সন্ত্রাস ছড়ান প্রতিপক্ষের বক্সে। দুই বন্ধুর লড়াইটা তাই সরাসরিই। আর তা এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে এই সেমিফাইনালের ভাগ্যও লেখা হয়ে যেতে পারে তাতে।

একটা বিশ্বকাপে কত কিছুই না হয়। আর এই বিশ্বকাপ তো শুরু থেকেই যেন নাটকের রঙ্গমঞ্চ। সব ছাপিয়ে এমবাপ্পে-হাকিমির গল্পটাই মনে হয় সবচেয়ে চমকপ্রদ। মরক্কোর অবিশ্বাস্য স্বপ্নযাত্রার গল্পও যেখানে লেখা আছে। আরবের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপে মরক্কো যেন আরব্য রজনীর রূপকথা। সেই রূপকথার শেষ অধ্যায়টা কি ফাইনাল, না তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ?

ওয়ালিদ রেগরাগুইয়ের কাছে প্রশ্নটাই আপত্তিকর বলে মনে হলো, ‘কেউ যদি মনে করে, আমরা সেমিফাইনালে উঠেই সন্তুষ্ট, তাহলে তা ভুল। আমাকে পাগল বলতে পারেন, কিন্তু আমরা ফাইনালে খেলতে চাই। আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। সেই স্বপ্নে ফাইনালও আছে।’

চেহারাছবি, টেকো মাথায় মিল আছে বলে আগে থেকেই ‘মরক্কোর গার্দিওলা’ বলে একটা পরিচিতি ছিল। এই বিশ্বকাপে রেগরাগুই এমনই আলোড়ন তুলেছেন যে আসল গার্দিওলাও নিশ্চয়ই জেনে গেছেন তাঁর নাম। গার্দিওলার নামটাও এল রেগরাগুইয়ের সংবাদ সম্মেলনে।

মরক্কোর পাল্টা–আক্রমণনির্ভর রক্ষণাত্মক খেলা প্রসঙ্গে কোচ নিজেই যাঁকে টেনে আনলেন, ‘গার্দিওলা আমার হিরো। কিন্তু আমরা চাইলেই কি গার্দিওলার স্টাইলে খেলতে পারব?’ সাফল্য যে আত্মবিশ্বাসের সবচেয়ে বড় জ্বালানি, তার প্রমাণ রেখে উল্টো সাংবাদিকদের একটা সবক দিয়ে দিলেন, ‌‘আপনারা সাংবাদিকেরা বল পজেশন, গোলে শট—এসব নিয়ে বড় বেশি কথা বলেন। এতে কী আসে–যায়? ফুটবল ম্যাচে জয়টাই আসল কথা। ফ্রান্সকেই দেখুন না, ২০১৮ বিশ্বকাপে কী আক্রমণাত্মকই না খেলেছে, কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কেমন হিসাবি খেলা খেলে ম্যাচটা বের করে নিল।‌’

বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগালের মতো দলকে একে একে বিদায় করে দিয়েছে মরক্কো। এর চেয়েও চমকপ্রদ তথ্য হলো, এখন পর্যন্ত প্রতিপক্ষের কেউ মরক্কোর জালে বল পাঠাতে পারেনি। ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম তাই মরক্কোর ডিফেন্সকে ‘এই বিশ্বকাপের সেরা’ বলে স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছেন। তা ভাঙতে নিজেদের সেরা খেলাটাই যে খেলতে হবে, সেটাও বললেন একাধিকবার।

মাঠের পরিবেশ কেমন থাকবে, সেটাও দেশমের খুব ভালো জানা। মরক্কোর আগের ম্যাচগুলোতেই গ্যালারি মরক্কোময় হয়ে ছিল। ব্রাজিল বিদায় নেওয়ায় এই বিশ্বকাপে সমর্থনের দিক থেকে আর্জেন্টিনা ছাড়া মরক্কোর এখন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই। তার ওপর সেমিফাইনালের আগে মরক্কো থেকে সমর্থকবোঝাই ৩০টি বাড়তি ফ্লাইট আসছে দোহাতে।

আজ রাতে আল বায়ত স্টেডিয়ামের সেমিফাইনাল মরক্কোর জন্য তাই আরও বেশি ‘হোম ম্যাচ’। ফ্রান্সের অধিনায়ক উগো লরিস যে কারণে বলছেন, ‘মাঠে মরোক্কানরা অনেক আওয়াজ করবে, জানি। এ জন্য আমাদের মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে।‌’

এমবাপ্পে-হাকিমির আজ যে অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে, তা এরই মধ্যে হয়ে গেছে লরিসের। ফ্রান্স-ইংল্যান্ড ম্যাচটা দু–দুবার তাঁকে টটেনহাম সতীর্থ ও বন্ধু হ্যারি কেইনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রথম পেনাল্টি থেকে কেইন গোল করলেও দ্বিতীয়টাতে ব্যর্থতা ইংল্যান্ডকে ছিটকে দিয়েছে বিশ্বকাপ থেকে।

কেইনের পেনাল্টি মিস বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দিয়েছে ইংল্যান্ডকে

ড্রেসিংরুমে ফিরেই কেইনকে মেসেজ পাঠিয়েছেন লরিস। যদিও কী লিখবেন, শব্দ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এদিনও বন্ধুকে সমবেদনা জানালেন, ‘হ্যারি ইংল্যান্ডের জন্য যা করেছে, এতে তা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে না। ফুটবল ইতিহাসে অনেক বড় খেলোয়াড়ই পেনাল্টি মিস করেছে। মেসি, রোনালদো, এমবাপ্পে...কে তা করেনি!’

১৯৬২ সালে ব্রাজিলের পর আর কোনো দল বিশ্বকাপ ধরে রাখতে পারেনি। ফ্রান্স এবার সেই কীর্তি ছুঁয়ে ফেলতে পারে বলে শুরু থেকেই আওয়াজ উঠেছে। আজকের ম্যাচেও ফ্রান্স অবধারিত ফেবারিট। তবে মরক্কোর বিপক্ষে ম্যাচের আগে বেলজিয়াম, স্পেন ও পর্তুগালও কি তা-ই ছিল না! ম্যাচটা তাই অন্য সেমিফাইনালের চেয়ে একটুও কম রোমাঞ্চ ছড়াচ্ছে না।

সবচেয়ে বেশি তো অবশ্যই এমবাপ্পে আর হাকিমির মনে। স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে হাকিমির পানেনকা পেনাল্টিতে মরক্কোর জয়ের পর এমবাপ্পে টুইট করেছিলেন, হাকিমি: বিশ্বের সেরা রাইটব্যাক।

‌বিশ্বের সেরা রাইটব্যাক বনাম এই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ স্কোরার—আজকের সেমিফাইনালের সবচেয়ে ভালো ট্যাগলাইনও দেখছি দুই বন্ধুই!