৯০ মিনিট, আরও ৩০ মিনিট এবং টাইব্রেকার! নাহ, মানুষটাকে এক মুহূর্তের জন্যও টলানো গেল না৷ এই মানুষটাই যে ফুটবল! হার না মানা এক মানুষের জীবনের গল্প যেন লেখা হলো ম্যাচজুড়ে, টিকে থাকার গল্প। বলছি লুকা মদরিচের কথা—যিনি যুদ্ধের সন্তান। লড়াইয়ের বীজটা তাঁর রক্তে। লড়েই জেতালেন ক্রোয়েশিয়াকে।
‘বুড়ো’ বলে যাঁকে, যাঁর দলকে বাতিলের খাতায় ফেলা হয়েছিল, টুর্নামেন্টজুড়ে দুর্দান্ত খেলা ফেবারিট ব্রাজিলকে ফিরতি টিকিট ধরিয়ে দিল সেই মদরিচের ক্রোয়েশিয়াই।
১৩০ মিনিট ধরে কখনো নিচে নেমে, কখনো মিডে আবার কখনো আক্রমণে, যখন যেখানে প্রয়োজন হয়েছে, নিজেকে উজাড় করে দিয়ে উপস্থিত ছিলেন মদরিচ।
একটি সুযোগ তৈরির সঙ্গে নিখুঁত পাস দিয়েছেন ৯০.৫২ শতাংশ। সব মিলিয়ে সম্পন্ন করেছেন ১০৫টি পাস এবং বল স্পর্শ করেছেন ১৩৯ বার। এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে ৩৭ বছর বয়সী মদরিচ ছিলেন এমনই সুন্দর। তবে মদরিচের জীবনের গল্পটা এত সুন্দর ছিল না।
বসনিয়া যুদ্ধের সময় সার্বিয়ার আগ্রাসনে পালিয়ে আসা এক পরিবারে ১৯৮৫ সালে মদরিচের জন্ম। জন্মস্থান ক্রোয়েশিয়ার জাদারে। মদরিচের দাদাকে শত্রুপক্ষ মেরে ফেলেছিল এবং ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মদরিচের বাবা স্টিপে মদরিচ ছিলেন সেনাবাহিনীর কার মেকানিক, আর মা রাদোকা মদরিচ ছিলেন টেক্সটাইলশ্রমিক। সে সময় মদরিচের পরিবারের খাবার, জামাকাপড় ও থাকার জায়গাটুকুও ছিল না।
ক্রোয়েশিয়ান যুদ্ধের সময় যাদারে রোমহর্ষ এক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছিলেন তাঁরা। সেসব যন্ত্রণা ভুলতে বলটাকে পায়ে তুলে নিয়েছিলেন মদরিচ। সে সময়ের মদরিচকে নিয়ে এনকে জাদারের চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটি সারাক্ষণ হোটেল পার্কিংয়ে বলে লাথি মারত।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘সে ছিল কঙ্কালসার এবং বয়সের তুলনায় অনেক ছোট। তবে তার দিকে তাকালে আপনি দেখবেন, বিশেষ কিছু তার মধ্যেও ছিল।’
শারীরিক গঠনের কারণে লুকাকে সারাক্ষণ কটাক্ষের মুখে পড়তে হতো। তিনি এতই ছোট এবং দুর্বল ছিলেন যে ভাবা হতো ফুটবল খেলার মতো শারীরিক গঠনই তাঁর নেই। যে কারণে ক্রোয়াট ক্লাব হাদুক স্পিল্টও তাঁকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। তবে লুকা তো সাধারণ কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন এমন একজন, যিনি গল্পটা বদলাতে চেয়েছিলেন।
তরুণ বয়সেই নিজের সামর্থ্য বাড়াতে কঠিন পরিশ্রম শুরু করেছিলেন লুকা। এরপর তাঁর সামর্থ্য নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁদেরও জবাব দিয়েছিলেন। দিনেমো জাগরেভের হয়েও নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন মদরিচ। এরপর ধারে খেলতে যান জিরনিস্কি মনস্টারে। এর মধ্যে আরও একটি ক্লাবে ধারে খেলে চলে আসেন জাগরেভে। সেখানে দুর্দান্ত সাফল্য পান মদরিচ। তিন লিগ শিরোপাসহ জেতেন বেশ কিছু ট্রফি।
সেই সাফল্য তাঁকে নিয়ে আসে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব টটেনহামে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর হাত ধরেই ৫০ বছরের মধ্যে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার সুযোগ পায় টটেনহাম। ২০১০-১১ সালে দলকে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতেও সহায়তা করেন মদরিচ। টটেনহাম থেকে ২০১০-১১ মৌসুমে ৩৩ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফার ফিতে চলে আসেন রিয়াল মাদ্রিদে। রিয়ালেই নিজেকে সময়ের অন্যতম সেরা তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন মদরিচ।
এক দশকের বেশি সময় ধরে রিয়ালের মিডফিল্ড জেনারেলের দায়িত্বপালন করছেন মদরিচ। ২০১৮ সালে নিজের সেরা সময়ে ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। পেয়েছেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় গোল্ডেন বলের পুরস্কার। এরপর ব্যক্তিগত অর্জনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ব্যালন ডি’অরও জিতেছেন মদরিচ। লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বৃত্ত ভেঙে এক দশক পর প্রথমবারের মতো তৃতীয় কোনো খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন মদরিচ।
চার বছর পর আবারও দেখা গেল মদরিচের জাদু। ব্রাজিলের বিপক্ষে সম্ভবত নিজের সেরা খেলাটাই খেললেন মদরিচ। যে খেলা মনে করিয়ে দিয়েছে ২০০৬ সালের কোয়ার্টার ফাইনালে রোনালদো-রোনালদিনিওদের হারানো জিনেদিন জিদানকে।
সেদিন এমনই জাদুকরী পারফরম্যান্স উপহার দিয়েছিলেন ফরাসি মহাতারকা। এখন মদরিচের সামনে গতবারের আক্ষেপ ঘোচানোর সুযোগ। শেষ ধাপে গিয়ে যে হেরেছিলেন সেবার। মদরিচ নিজেও নিশ্চয় চাইবেন শেষ বিশ্বকাপটাও রাঙিয়ে বিদায় নিতে। তাতে ফুটবলের সৌন্দর্যটাও বাড়বে বৈ কমবে না।