কিলিয়ান এমবাপ্পের গোল উদ্‌যাপন
কিলিয়ান এমবাপ্পের গোল উদ্‌যাপন

জ্বলে উঠলেন এমবাপ্পে, বার্সেলোনাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি

বার্সেলোনা ১ : ৪ পিএসজি

গোল তো নয় যেন কফিনে শেষ পেরেক! ৮৯ মিনিটে কিলিয়ান এমবাপ্পে যখন পিএসজির চতুর্থ গোলটা করলেন, বার্সেলোনার শোকবিহ্বল সমর্থকদের শুকনো মুখগুলোর দিকে তখন তাকানো যাচ্ছিল না। সমর্থকদের কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। ওই গোলেই যে বিদায়ের বিউগল বেজে গিয়েছিল তাঁদের মনে।

উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে নিষ্প্রভ এমবাপ্পে যে বার্সেলোনার মাঠে জ্বলে উঠতে পারেন, সেই শঙ্কা বার্সা সমর্থকদের মনে আগে থেকেই ছিল। এর আগেও বার্সার মাঠে এসে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। আজ করলেন জোড়া গোল।

দ্বিতীয়ার্ধে এমবাপ্পের দুই গোলের আগে উসমান দেম্বেলে ও ভিতিনিয়াও বার্সার জাল কাঁপিয়েছেন। তাতে রাফিনিয়ার গোলে কাতালান ক্লাবটির বিপক্ষে পিছিয়ে পড়েও ৪–১ ব্যবধানে জয় পেল পিএসজি। ঘুরে দাঁড়ানো এ জয়ে দুই লেগ মিলিয়ে ৬–৪ ব্যবধানে এগিয়ে থেকে সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল লুইস এনরিকের দল। বিদায় নিতে হলো জাভি হার্নান্দেজের বার্সাকে। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে পিএসজি প্রতিপক্ষ হিসেবে পেল জার্মান ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডকে

বার্সেলোনার ‘নতুন ঘর’ এস্তাদি অলিম্পিক লুইস কোম্পানিসে অনুষ্ঠিত ম্যাচটি ফুটবলপ্রেমীরা অনেক দিন মনে রাখবেন মাঠের উত্তেজনা আর বিতর্কিত রেফারিংয়ের কারণে। ম্যাচটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন ইস্তভান কোভাকস। রোমানিয়ার এই রেফারি দুই দল মিলিয়ে ১২টি কার্ড দেখিয়েছেন, যার মধ্যে লাল কার্ড ৩টি! কোভাকসের লাল কার্ড থেকে রেহাই পাননি বার্সার প্রধান কোচ জাভি এমনকি গোলকিপার কোচ হোসে রামোন দে লা ফুয়েন্তেও!

অথচ ম্যাচের প্রায় আধঘণ্টা সবকিছু বার্সেলোনার নিয়ন্ত্রণেই ছিল। পিএসজির মাঠ পার্ক দে প্রিন্সেসে রাফিনিয়ার জোড়া গোলে প্রথম লেগে ৩–২ ব্যবধানের জয় নিয়ে ফিরেছিল বার্সা। ১২ মিনিটে সেই রাফিনিয়ার গোলেই কাতালান ক্লাবটি আজ এগিয়ে গিয়েছিল। দুই লেগে মিলিয়ে ৪–২ গোলে এগিয়ে থাকা জাভির দলকেই তখন ফেবারিট মনে হচ্ছিল।

কিন্তু ২৯ মিনিটে পিএসজির ব্রাডলি বারকোলাকে ফাউল করে সরাসরি লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয় রোনাল্‌দ আরাউহোকে। ম্যাচের আধঘণ্টা পেরোনোর আগেই ১০ জনের দলে পরিণত হওয়া বার্সা যে কঠিন পরীক্ষায় পড়তে যাচ্ছে, সেটা তখনই আঁচ করা গিয়েছিল।

৪০ মিনিটে সমতা ফিরিয়ে সেই ধারণাকে সত্যি করেন উসমান দেম্বেলে। এ মৌসুমেই বার্সা ছেড়ে পিএসজিতে যোগ দেওয়া ফরাসি ফরোয়ার্ডের জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে সব ধরনের আয়োজন করে রেখেছিল কাতালান ক্লাবটির সমর্থকেরা। কেউ কেউ দেম্বেলের বিকৃতি করা মুখের ছবি নিয়ে মাঠে আসেন, অনেকেই তাঁকে উদ্দেশ্য করে দুয়ো দিতে থাকেন। কিন্তু কোনো কিছুই দেম্বেলেকে টলাতে পারেনি।

বার্সা সমর্থকদের দুয়োর জবাব এভাবেই দিয়েছেন উসমান দেম্বেলে

নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রথম লেগে খেলতে না পারা আশরাফ হাকিমি আজ দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ঝলক দেখান। ম্যাচের ৫৪ মিনিটে হাকিমির কাছ থেকে বল পেয়েই পিএসজিকে এগিয়ে দেন ভিতিনিয়া।

একে তো দল পিছিয়ে পড়েছিল, তার ওপর দলের খেলোয়াড়দের একের পর এক কার্ড দেখিয়ে যাচ্ছিলেন রেফারি কোভাকস। রেফারিং নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা জাভি চতুর্থ অফিশিয়ালের সামনেই একটি বিজ্ঞাপনী বোর্ডে লাথি মেরে বসেন। এ ঘটনায় জাভিকেও লাল কার্ড দেখিয়ে ডাগআউট থেকে তাড়িয়ে দেন কোভাকস। প্রতিবাদ জানাতে গেলে লাল কার্ড দেখতে হয় বার্সার গোলকিপার কোচ দে লা ফুয়েন্তেকেও।

উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে ১২টি কার্ড দেখান রেফারি

কিছুক্ষণ পর বার্সার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যায়। জোয়াও কানসেলো দেম্বেলেকে নিজেদের বক্সে ট্যাকল করে ফেলে দিলে পেনাল্টি পায় পিএসজি। সফল স্পট কিকে প্যারিসের ক্লাবটিকে ৩–১ ব্যবধানে এগিয়ে দেন এমবাপ্পে। এ গোলে অনন্য কীর্তিও গড়েন ফ্রান্সের বিশ্বকাপজয়ী তারকা। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনি চ্যাম্পিয়নস লিগে টানা পাঁচ ম্যাচে স্প্যানিশ প্রতিপক্ষের মাঠে গোলের রেকর্ড গড়েন।

৬৪ মিনিটে ভিতিনিয়ার সঙ্গে ধাক্কা লেগে ইলকাই গুন্দোয়ান পিএসজির বক্সে পড়ে গেলে পেনাল্টির আবেদন জানায় বার্সা। কিন্তু বার্সার আবেদনে সাড়া দেননি রেফারি কোভাকস। ভিএআর যাচাইয়ের পর তিনি আগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকেন।

৭৩ মিনিটে গোলের সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেন রবার্ট লেভানডফস্কি। পিএসজি গোলকিপার জিয়ানলুইগি দোন্নারুম্মাকে একা পেয়েও ফাঁকি দিতে পারেননি লেভা। তাঁর শট দোন্নারুম্মা রুখে দিলে বল পেয়ে যান ফেরান তোরেস। তোরেসের ফিরতি শটে বল বিপদমুক্ত করেন পিএসজি অধিনায়ক মার্কিনিওস।

একে তো সময় শেষ হয়ে আসছিল, তার ওপর একাধিক গোলের সুযোগ হাতছাড়া—সব মিলিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে বার্সা। ম্যাচের শেষ দিকে পিএসজি সেই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করে।

৮৯ মিনিটে দ্রুত প্রতি আক্রমণে ওঠে দলটি। এমবাপ্পে ও মার্কো আসেনসিওর প্রচেষ্টা বার্সা গোলকিপার মার্ক আন্দ্রে টের স্টেগেন রুখে দিলেও ডিফেন্ডার জুলস কুন্দে বল বিপদমুক্ত করতে ব্যর্থ হন। বলটা আবারও আসে এমবাপ্পের পায়ে। এবার তিনি আর ভুল করেননি। কাছাকাছি দূরত্বে থেকে ডান পাশের কোণায় নেওয়া নিচু শটে বার্সার জাল খুঁজে নেন এমবাপ্পে।

কিছুক্ষণ পর রেফারি শেষ বাঁশি বাজাতেই উৎসবে মেতে ওঠে পিএসজি। ম্যাচের অন্যতম নায়ক এমবাপ্পেকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ করতে থাকেন কোচ এনরিকে। ৯ বছর আগে যে এনরিকের হাত ধরে ট্রেবল জিতেছিল বার্সা, আজ সেই এনরিকেই পিএসজির কোচ হিসেবে সাবেক ক্লাবকে দুঃস্বপ্ন উপহার দিয়ে এলেন। তাঁর কাছে এ জয়ের মাহাত্ম্য বিশেষ হওয়ারই কথা।