গোলরক্ষক মহসিন এখন
গোলরক্ষক মহসিন এখন

জীবনের গোলপোস্টে অসহায় মহসিন

‘গোলবারে দাঁড়িয়ে বীর মহসিন...!’

আশির দশকে জনপ্রিয় এক বাংলা ছায়াছবির গানের কথা এটি। গানটি ছিল আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ নিয়ে। তুমুল জনপ্রিয়ও হয়েছিল জাফর ইকবাল ও সুচরিতা অভিনীত সিনেমার সেই গান। আর সেই গানের ‘বীর’ মহসিন কাল্পনিক কেউ ছিলেন না। তিনি বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক মোহাম্মদ মহসিন।

ফুটবলের একসময়ের সেই স্টাইল আইকন, গোলবারের নিচে অতন্দ্র প্রহরী মহসিন এখন ভালো নেই। সব হারিয়ে বলতে গেলে নিঃস্ব, রিক্ত এই তারকা গোলরক্ষক মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছেন। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের একটি ফ্ল্যাটে অনেকটা নীরবেই কেটে যাচ্ছে তাঁর জীবন। একসময়ের জনপ্রিয় এই তারকা ফুটবলার শারীরিকভাবেও অসুস্থ। অর্থের অভাবে চোখের চিকিৎসাও করাতে পারছেন না তিনি।

জীবনের গোলপোস্টে পরাস্ত মহসিন

তবে অসুস্থতার মধ্যেও নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের স্মৃতি ভোলেননি জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক এই অধিনায়ক। সেসব মনে করে এখনো যেন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠেন তিনি, ‘আমি একসময় আবাহনী, মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা—তিন দলেরই অধিনায়ক ছিলাম। বিদেশের মাটিতে অধিনায়ক ছিলাম বাংলাদেশের। ফুটবল খেলার জন্য কত যে দেশ ঘুরেছি! কত বড় বড় দলের সঙ্গে খেলেছি!’

এক সময় তরুণদের স্টাইল আইকন ছিলেন মহসিন

সিদ্ধেশ্বরীতে ছোট ভাই কোহিনূর ইসলামের সঙ্গে পারিবারিক ফ্ল্যাটে থাকেন মহসিন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় হুট করেই খেলা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন কানাডায়। বিয়ে করেছিলেন, সংসারও ছিল, কিন্তু সেটি টেকেনি। কানাডায় ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। কিন্তু খুব বেশি বৈষয়িক না হওয়ায় সেসবও এখন নেই। ২০১৪ সালে প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় দেশে ফিরে আসেন। কানাডায় আর ফেরত যাননি। তীব্র হতাশা থেকেই ধীরে ধীরে হারিয়েছেন মানসিক ভারসাম্য।

মহসিনের ভাই কোহিনূর ইসলাম বলেছেন, ‘আমার বড় ভাই খুব বৈষয়িক কখনোই ছিলেন না। ব্যবসা-বাণিজ্য টেকাতে পারেননি। অতিরিক্ত উদারতার কারণে মানুষের কাছে ঠকেছেন। যে মানুষটাকে আমরা আমাদের পরিবারের আদর্শ ভাবতাম, তাঁকে অনুসরণ করতাম, তাঁর কাছে বিভিন্ন বিষয়ে আবদার করতাম, আজ তিনিই সব হারিয়ে ফেলেছেন।’

১৯৯১ সালের ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে মোহামেডানের বিপক্ষে আবাহনীর গোলবারে বিশ্বস্ত প্রহরী মহসিন

মহসিনকে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোলরক্ষক বললেও খুব বেশি বাড়াবাড়ি হবে না। খুব অল্প বয়সেই উত্থান তাঁর আবাহনী শিবির থেকে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সে সময়ের দেশসেরা তারকা ফুটবলার আশরাফউদ্দিন চুন্নুর নজরে পড়েন তিনি। কোনো এক ম্যাচে বুলেটগতির এক শট ঠেকিয়ে চুন্নুকে মুগ্ধ করেছিলেন। আবাহনী ক্লাবে কিছুদিন অনুশীলন করে ১৯৮২ সালে নাম লেখান মোহামেডানে। জাতীয় দলে সুযোগ পান সে বছরই।

১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়ান গেমসে দ্বিতীয় গোলরক্ষক হলেও তিন ম্যাচের দুটিতে তাঁর ওপরই ভরসা রেখেছিল বাংলাদেশ দল। চীনের বিপক্ষে পেনাল্টি ঠেকিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন মহসিন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জাতীয় দলের গোলবারের নিচে টানা ১১ বছর ছিলেন ১ নম্বর পছন্দ। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব, এশিয়ান কাপ বাছাই, সাফ গেমস, এশিয়ান গেমস—আশি ও নব্বইয়ের দশকে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ৪০টির বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে মহসিন (বসা, বাম দিক দিয়ে পঞ্চম)

মোহামেডানের হয়েই তারকা হয়ে ওঠা মহসিনের। ১৯৮৫ সালে মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন, তবে সাফল্য পাননি। ১৯৮৭ সালে যোগ দেন আবাহনীতে। ১৯৯২ সালে সিনিয়র ডিভিশন ফুটবল লিগজয়ী আবাহনীর অধিনায়কত্ব করেছেন। ১৯৯৪ সালের দলবদলে আবাহনী, মোহামেডান, ব্রাদার্সের পুল ভেঙে শক্তিশালী দলে পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র। মহসিন যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধায়, অধিনায়কত্বও করেন। মুক্তিযোদ্ধাকে জেতান ফেডারেশন কাপ। মুক্তিযোদ্ধায় ওই এক মৌসুমই খেলেছেন তিনি। এরপরই চলে যান অন্তরালে। কানাডায় শুরু করেন নতুন জীবন।

আশির দশকের শুরুতে আরেক তারকা ফুটবলার ওয়াসিম ইকবালের সঙ্গে মোহাম্মদ মহসিন

দীর্ঘদিনের নিভৃতবাসে অনেক কিছুই ঘটে গেছে মহসিনের জীবনে। কোহিনূর ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাই প্রতি পদে পদে ঠকেছেন। এটা তাঁর দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছুই নয়। কিছুটা দোষ তাঁরও আছে। জীবন নিয়ে খুব চিন্তাশীল ছিলেন না। হচ্ছে, হবে, চলে যাচ্ছে...এমন জীবনই কাটিয়েছেন। যেটার মাসুল দিতে হয়েছে তাঁকে।’

দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকার এখন আর কিছুই নেই। দেশের ফুটবলের এক সময়ের ‘বীর’ মহসিনের এখনকার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখলে মনেই হবে না এই মানুষই একসময় দেশের বিখ্যাত সাময়িকী ‘বিচিত্রা’র ঈদ সংখ্যার প্রচ্ছদে মডেল হয়েছিলেন। তাঁর খেলা একসময় এ দেশের অসংখ্য ফুটবলপ্রেমী হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিল।

সেই মহসিনই এখন অসহায় জীবনের গোলপোস্টে। তাঁর মতো তারকার কি এমন জীবন প্রাপ্য ছিল!