স্টেডিয়ামগুলো হবে ‘অন্য রকম’। সবাইকে আমন্ত্রণ।
২০৩৪ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন নিয়ে এ দুটি কথা সৌদি আরবের প্রতিশ্রুতি। তবে এই প্রতিশ্রুতির মধ্যে বিতর্কও আছে। যে ১১টি স্টেডিয়ামে এক দশক পরের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে, তার একটিও এখনো তৈরি হয়নি। এই ১১টি স্টেডিয়ামের মধ্যে একটি স্টেডিয়াম হবে নতুন এক শহরে। সেই শহরও এখনো বানানো হয়নি।
কিন্তু সৌদি আরব বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২০৩৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পেয়েছে। গতকাল ফিফার বিশেষ কংগ্রেসে সৌদির পক্ষে ছিল ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনও (এফএ)। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের পর এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে।
২০২১ সালে সৌদির প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দেশের অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার কৌশলে খেলাধুলাকে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে যোগ করেন। দেশটিতে বড় কিছু খেলাধুলার আসরও অনুষ্ঠিত হয়েছে—হাই প্রোফাইল বক্সিং ম্যাচ ও ফর্মুলা ওয়ান। তিন বছর আগে প্রিন্স সালমানের সেই সিদ্ধান্তের পর খেলাধুলায় ৫০০ কোটি পাউন্ড (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৬ হাজার ২৭১ কোটি টাকা) বিনিয়োগ করেছে সৌদি আরব।
সৌদি প্রো লিগে এখন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, করিম বেনজেমা, নেইমারের মতো বিশ্ব মাতানো ফুটবল তারকারা খেলছেন। দেশটির সরকারি মালিকানাধীন পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ) ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব নিউক্যাসল ইউনাইটেডের মালিক। এ ছাড়াও ছেলেদের পেশাদার এলআইভি গলফ সিরিজও চালু করেছে সৌদি আরব।
তবে খেলাধুলায় সৌদি আরবের বস্তা বস্তা টাকা ঢালা ‘স্পোর্টসওয়াশিং’ হিসেবেও অভিযুক্ত হয়েছে। তেল-সমৃদ্ধ দেশটি মানবাধিকার ও পরিবেশ সুরক্ষা নিয়ে পূর্বতন সব বিতর্ক ধুয়ে মুছে ফেলতে টাকা ঢালছে খেলাধুলায়, এমন অভিযোগও নতুন নয়।
সৌদি আরবে বিশ্বকাপ আয়োজন করা হলে, সেটি কেমন হতে পারে, তা জানানোর চেষ্টা করেছে বিবিসি।
সৌদি আরবের বিশ্বকাপ আয়োজনের বিড নিয়ে ফিফার প্রতিবেদনে প্রশংসা করে বলা হয়েছে, একদমই ‘অন্য রকম’ স্টেডিয়ামের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘তাদের সম্ভাবনা প্রচুর এবং প্রস্তাবনা অনুযায়ী সন্দেহাতীতভাবে তারা ভবিষ্যৎ স্টেডিয়ামগুলোর নির্মাণশৈলী ও কাঠামো পাল্টে দেবে।’
আয়োজকেরা বলেছেন, সৌদি আরবে সব মিলিয়ে ১৫টি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ হবে। আয়োজক শহর পাঁচটি—রিয়াদ, জেদ্দা, আবহা, আল-খোবার ও নিওম। এর মধ্যে শেষ শহরটি সৌদি আরবে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে এখনো তৈরি করা হয়নি।
নিওম স্টেডিয়ামের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভূমি থেকে ৩৫০ মিটার উঁচুতে স্টেডিয়ামটি বানানো হবে। শুধু দ্রুতগতিসম্পন্ন লিফট ও চালকবিহীন যানবাহনে করে এই স্টেডিয়ামে প্রবেশ করা যাবে। সৌদির ‘দ্য লাইন’ প্রজেক্টের অংশ এটি, যে (নিওম) শহরটি হবে গাড়িবিহীন, প্রস্থে মাত্র ২০০ মিটার এবং দৈর্ঘ্যে ১৭০ কিলোমিটার। এই লাইন লম্বায় নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের চেয়েও উঁচু হবে। আর দূরত্ব লন্ডন থেকে ব্রিস্টলের সমপর্যায়ের।
কিদ্দিয়া কোস্ট স্টেডিয়ামের নির্মাণশৈলী হবে ঢেউখেলানো, যা গ্যালারিতে দর্শকদের ‘মেক্সিকান ওয়েভ’কে মনে করিয়ে দেবে। আর রিয়াদে প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান স্টেডিয়াম বানানো হবে পাহাড়ের ওপরে। বিশ্বকাপের সব কটি স্টেডিয়ামের মধ্যে ৮টি থাকবে রিয়াদে। এর মধ্যে রয়েছে পরিকল্পিত ৯২ হাজার ৭৬০ আসনের কিং সালমান স্টেডিয়াম। সেখানে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচ ও ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে। মোট ১৫টি স্টেডিয়ামের মধ্যে ৪টি এরই মধ্যে বানানো হয়েছে। ৮টির পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়েছে এবং বাকি ৩টি নির্মাণাধীন। যেগুলো বানানো হয়েছে এবং যেগুলো নির্মাণাধীন, সেসব স্টেডিয়ামে ২০২৭ এএফসি এশিয়ান কাপও অনুষ্ঠিত হবে।
মানবাধিকার ও নারী অধিকার লঙ্ঘন, সমকামিতাকে অপরাধীকরণ, মুক্ত বাকে বাঁধা এবং ইয়েমেনে যুদ্ধের কারণে সৌদি আরব সমালোচিত।
সাম্প্রতিক সময়ে এনজিওগুলো জানিয়েছে, ২০২৪ সালের প্রথম ৯ মাসে সৌদি আরব অন্তত ২০০ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে, যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌদির অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়ে ২০১৮ সালে জামাল খাসোগিকে হত্যার পর। খাসোগি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী সৌদি সংবাদকর্মী এবং সৌদি সরকারের কট্টর সমালোচক। মানবাধিকারকর্মীদের দাবি, দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবকে এসব বিষয়ের জন্য যে চোখে দেখা হচ্ছে, সেখান থেকে নজর অন্য দিকে নিতেই খেলাধুলাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আমরা এক শর বেশি খেলাধুলার আসর আয়োজন করেছি। মদ ছাড়াই বরণ করে নিয়েছি ৩০ লাখ ক্রীড়াপ্রেমীকে। তারা সময়টা উপভোগ করেছে এবং সৌদিতে কি আছে সেসবও আবিষ্কার করেছে—বিনোদন, শিল্পকলা, সংগীত, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।সৌদি আরবের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হাম্মাদ আলবালাওয়ালি
সৌদি সরকারের দাবি, অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যেই খেলাধুলায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাতে পর্যটনও প্রসারিত হবে এবং দেশের মানুষও আরও বেশি সক্রিয় হবে।
ফিফার নির্দেশনা অনুযায়ী, বিশ্বকাপ আয়োজনে বিড করা দেশগুলোকে অবশ্যই মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে। গত নভেম্বরে ফিফা সৌদির বিশ্বকাপ আয়োজনের বিড নিয়ে নিজেদের মূল্যায়নপত্রে দেশটিকে ‘মোট ৫–এর মধ্যে গড়ে ৪.২’ দিয়েছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
ফিফার দাবি ছিল, ‘কিছু ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সংস্কারের অনুঘটক হিসেবে টুর্নামেন্টটির ভালো সম্ভাবনা আছে এবং সৌদি আরব ও সে অঞ্চলের মানুষের মানবাধিকারেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে, যা টুর্নামেন্টের ব্যপ্তিকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।’
গত মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, মানবাধিকারে বড় সংস্কারের ঘোষণা দেওয়ার আগপর্যন্ত সৌদি আরবকে ২০৩৪ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া স্থগিত করতে হবে। তাদের দাবি ছিল, সেখানে টুর্নামেন্টটির আয়োজন করা হলে মানবাধিকারে বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে।
সৌদি আরবে মদ নিষিদ্ধ। বিশ্বকাপের আগে এই নিষেধাজ্ঞা যে তুলে নেওয়া হবে, সে বিষয়েও কিছু বলা হয়নি। সৌদি আরবে মদপানের শাস্তি হলো জরিমানা, কারাবাস এবং দেশ থেকে বিতাড়ন।
সৌদি আরবের ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হাম্মাদ আলবালাওয়ালি এ বছর সেপ্টেম্বরে স্কাই স্পোর্টসকে বলেছেন, ‘আমরা এক শর বেশি খেলাধুলার আসর আয়োজন করেছি। মদ ছাড়াই বরণ করে নিয়েছি ৩০ লাখ ক্রীড়াপ্রেমীকে। তারা সময়টা উপভোগ করেছে এবং সৌদিতে কি আছে সেসবও আবিষ্কার করেছে—বিনোদন, শিল্পকলা, সংগীত, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।’
সমকামিতাও নিষিদ্ধ সৌদি আরবে। ট্রান্সজেন্ডারদেরও স্বীকৃতি নেই।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট কার্যালয় সৌদি আরবে ভ্রমণার্থীদের সেখানকার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, আইন ও ধর্মকে সম্মানের পরামর্শ দেয় ‘যেন কেউ আঘাত না পায়।’ বলা হয় ‘যুক্তরাজ্যে যা নিষিদ্ধ নয়, তেমন কিছু করেও মারাত্মক খেসারত দিতে হতে পারে’ ভ্রমণার্থীদের। ব্যক্তিগত পরিচয়পত্র না থাকার ফলও হতে পারে জরিমানা কিংবা কারাবাস।
বিবিসি স্পোর্টসের সম্পাদক ড্যান রোয়ানের সঙ্গে গত বছর আলাপচারিতায় সৌদির ক্রীড়ামন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন তুর্কি আল ফয়সাল বলেছেন, ২০২২ বিশ্বকাপের আগে অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে আচরণ নিয়ে কাতারের যেমন সমালোচনা হয়েছিল, ‘তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না।’
সৌদির বিশ্বকাপ আয়োজনের বিডিংয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, বিমানবন্দরগুলো বড় করা হবে, দ্রুতগতিসম্পন্ন রেল এবং জনমানুষের যাতায়াতের পরিবহনও বাড়ানো হবে। তবে একটি স্টেডিয়াম থেকে অন্যটির বিশাল দূরত্বের কারণে, আয়োজক শহরে যাতায়াত করতে চাওয়া সমর্থকদের বিমানপথেই বেশি ভরসা রাখতে হবে।
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় দেশ। আয়তনে যুক্তরাজ্যের ৯ গুণ।
২০২২ কাতার বিশ্বকাপ হয়েছে ৩২ দলের। কিন্তু ২০২৬ বিশ্বকাপ থেকে অংশ নেবে ৪৮টি দল। ফিফা বলেছে, ‘জনমানুষের পরিবহন কাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন আগেই দেখা গেছে’ বিভিন্ন শহরে এবং রিয়াদে নতুন মেট্রো ব্যবস্থাও সংযুক্ত করা হয়েছে।
প্রতিটি ভেন্যু শহরে দুটি করে মোট ১০টি ফ্যান-পার্কের পরিকল্পনা করা হয়েছে। দল, অফিশিয়াল, মিডিয়া ও সমর্থকদের থাকা-খাওয়ার বিষয়ে ফিফার বিড প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘টুর্নামেন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই সব রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যাদির ব্যবস্থা আছে।’
অক্টোবর থেকে এপ্রিলের মধ্যে সৌদি আরবে তাপমাত্রা সবচেয়ে সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এসব মাসে বিশ্বকাপের আয়োজক শহরগুলোয় তাপমাত্রা ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে।
অতিরিক্ত গরম এড়াতে কাতারে ২০২২ বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে শীতকালে। সৌদিতে ২০৩৪ বিশ্বকাপও শীতকালে অনুষ্ঠিত হতে পারে। বিবিসি স্পোর্টসকে দেশটির ক্রীড়ামন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বলেছেন, আয়োজকেরা ‘অবশ্যই ভেবেছেন’ এটা গ্রীষ্মে আয়োজন করা যায় কি না।
প্রিন্স আবদুল আজিজের ভাষায়, ‘গ্রীষ্মে আয়োজনের সম্ভাবনা আছে কি না, সেটা কেন দেখা হবে না? শীতকাল না গরমকাল, সেটা আমাদের জন্য কোনো ব্যাপার না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা এমন এক ইভেন্ট আয়োজনের জন্য সঠিক পরিবেশের নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’
অক্টোবর থেকে এপ্রিলের মধ্যে সৌদি আরবে তাপমাত্রা সবচেয়ে সহনীয় পর্যায়ে থাকে। এসব মাসে বিশ্বকাপের আয়োজক শহরগুলোয় তাপমাত্রা ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। মে থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে মূল ভূখণ্ডের তাপমাত্রা দৈনিক গড় তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি থেকে ৪৩ ডিগ্রির মধ্যে থাকে। উপকূলীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা ২৭ থেকে ৩৮ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করে।