পেলে ও ম্যারাডোনার এই ছবিটি ১৯৯৫ সালে রিও ডি জেনিরোয় তোলা। একটি অনুষ্ঠানে
পেলে ও ম্যারাডোনার এই ছবিটি ১৯৯৫ সালে রিও ডি জেনিরোয় তোলা। একটি অনুষ্ঠানে

পেলে, অনন্তলোকে ম্যারাডোনা আপনাকে বরণ করবেন

‘সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রেখেছিলাম। মৃত্যু লেখা থাকলে হতো।’

কথাটা এমন একমুহূর্তে বলেছিলেন, যখন লোকে সৃষ্টিকর্তার ওপর বিশ্বাস রাখতে বাধ্য। হাজার ফুট ওপরে আন্দেজ পর্বতমালার ওপর বিমান উড়ছে। পেটে ব্রাজিল ফুটবল দল। এয়ার পকেট টার্বুল্যান্সের প্যাঁচে পড়ে বিমানে শুরু হলো দুলুনি। সবাই তো ওপরওয়ালার নাম নিতে শুরু করল। প্রশ্নটা যেহেতু প্রাণ বাঁচানোর, তাই সৃষ্টিকর্তার তুষ্টিতে সবার ছটফটানি ছাড়া পথ কী!

শুধু একজন নির্বিকার। নিজ আসনে বসে ছিলেন চুপটি করে। ওপরওয়ালার ওপর তাঁর বিশ্বাসের ধরনটা ঠিক বাকিদের মতো নয়। বিশ্বাসের সংযোগ তো মনে মনে, হুটোপুটি করে কী আর বিশ্বাসের নাগাল মেলে! বাঁচা-মরা যেহেতু সেই হাতে, তাই চুপচাপ বসে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তিনি মারতে চাইলে তো আর কোনো কিছুতে ঠেকবে না। সতীর্থরা যারপরনাই অবাক। পেলে পাগল নাকি!

বিমানটি ১৯৬২ বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ চিলিতে যাচ্ছিল। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ জিতে পেলে তত দিনে তারকা। কিন্তু নিজের শেকড় ভুলে যাননি। উঠে আসার পথটা সব সময় মনে থাকত। ছোটবেলায় গির্জায় ফাই-ফরমাশ খেটেছেন। বড় হয়ে ওঠা ক্যাথলিক বিশ্বাসে। ‘মারাকানাজ্জো’ বিপর্যয়ে পেলের ভেতরটা চুরমার হয়ে গিয়েছিল। দৌড়ে ছুটে গিয়েছিলেন বাবার রুমে। নোনা দেয়ালে লটকে থাকা ত্রাণকর্তা যিশুই তাঁর ভরসা। যখন আর কোথাও উত্তর মেলে না, যখন আর কিছুই করার থাকে না, তখন ৯ বছরের ছেলেটির যিশুর কাছে যাওয়া ছাড়া আর পথ ছিল না। প্রশ্নটা ছিল, ‘কেন, আমাদের সঙ্গে এমন হলো?’

১৯৭০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে গোলের পর পেলের উদ্‌যাপন

ঠিক এই প্রশ্নটাই এখন পুরো পৃথিবীর। কেন, আমাদের সঙ্গে এমন হলো? যেতে তো হবে সবাইকেই। কেউ এখানে একা থাকবে না। কিন্তু তাঁকে এখন কেন? তিনবার বিশ্বকাপজয়ী একজনই ছিল এই পৃথিবীতে। আয়তাকার সবুজ গালিচার সেই পৃথিবীর সবেধন নীলমণিকে পরম সত্তা কেন নিয়ে গেলেন, তা তিনিই ভালো জানেন। তবে গোটা পৃথিবী কিন্তু শোকে ম্যুহমান।

পেলে বাবার কাছে অনুযোগ করেছিলেন। বাবা বলেছিলেন যিশুই ভরসা। পরিবারের কাছেই শিখেছেন, সৃষ্টিকর্তার ওপর আর কেউ নেই। কিছু হতে পারে না। ৮২ বছর বয়সেও তাই পেলের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়াকে মনে হচ্ছিল, এই প্রস্থানের লগ্ন বড্ড অসময়। পৃথিবীর সব ভালোবাসা যে এখনো তাঁর পাওয়া হয়নি। এখনো যে ব্রাজিলের ‘হেক্সা’ জয় বাকি, যা কাতারে দেখার আশা করেছিলেন তিনি। সবার সব আশা পূরণ হয় না। এটাই বাস্তবতা।

তবু পেলের মৃত্যু ঘিরে এই যে আবেগের স্ফুরণ, এটাই সম্ভবত জাদু–বাস্তবতা।

পেলের ক্যারিয়ার সবার জানা। বুকের মধ্যে তা পদ্মার সর্বনাশা ঢেউ তুলতে যথেষ্ট। পৃথিবীর এই কোণ থেকে ওই কোণ পর্যন্ত তাঁর পরিচিতির পূর্বাপরও অজানা নয়। এমনকি সেই মিসটাও সবার দেখা অথবা জানা। ১৯৭০ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে উরুগুয়ের বিপক্ষে সেই ‘ডামি’টা!

কোনো মিসও যে এত সুন্দর, এত মাধুর্যমণ্ডিত হতে পারে, তা কী ওই ‘ডামি’টার আগে দেখা গেছে! হয়তো গেছে, হয়তো যায়নি, তা তর্কসাপেক্ষ। তবে সেদিন ওই ‘ডামি’টা থেকে গোল হলে বোঝা যেত, অসম্ভব সব ইচ্ছাই সৃষ্টিকর্তা পূরণ করেন। যেহেতু হয়নি, তার মানে সব পূরণ হয় না। তার মানে গোটা পৃথিবী না চাইলেও সেটাই হতে পারে। তার মানে গোটা পৃথিবীর ইচ্ছার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সৃষ্টিকর্তা পেলের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন। ডিয়েগো ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর পেলে যে বলেছিলেন, স্বর্গে তাঁর সঙ্গে খেলার আশায় আছেন। সেই আশা পূরণ হয়েছে।

কিন্তু সেদিন যেভাবে টোস্টাওয়ের থ্রু ধরতে এগিয়ে আসা পেলেকে ঠেকাতে দৌড়ে সামনে চলে এসেছিলেন উরুগুয়ে গোলরক্ষক লাদিস্লাও মাদুরোউকিচ, সামনে বল পেয়েও পেলে তাঁকে ‘ডামি’ করেছিলেন। বল আর পেলে, উভয়কেই হারিয়ে উরুগুয়ে গোলকিপার তখন মহা ফ্যাসাদে। তার পেছনে গিয়ে দুরূহ কোণ থেকে পেলে শট নিলেও গোল হয়নি। লক্ষ্যটা ফসকে যায়! কিন্তু গোলটি পেলে যেভাবে করতে চেয়েছিলেন, সেই ভাবনাটা অমর হয়ে গেল।

গোলকিপারের সামনে বল পেলে সবাই এক কিকে ফিনিশ করার চেষ্টা করে। পেলে দেখিয়েছিলেন, ওটাই চূড়ান্ত কৌশল নয়। কল্পনার আবির থেকেও ছবি আঁকা যায় সবুজ ক্যানভাসে। সৃষ্টিকর্তা চাননি বলে সেই ছবিটা পূর্ণতা পায়নি। বল পোস্টের পাশ ঘেঁষে চলে যায়। মাথায় হাত দিয়ে পেলে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে ছিলেন। কতটা চাইলে সৃষ্টিকর্তা দেন!

পেলে যেদিন প্যালিয়েটিভ কেয়ারে ভর্তি হলেন তার ঠিক ২ বছর ৭ দিন আগে ফেসবুকে ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে নিয়ে একটি পোস্ট করেছিলেন। ম্যারাডোনার মৃত্যুর ঠিক ৭ দিন পর এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে সেটাই সম্ভবত তাঁর প্রথম পোস্ট। সেখানে ম্যারাডোনাকে হারানোর দুঃখ, অনুতাপ, অনুযোগ থেকে প্রশংসা, মুগ্ধতা সব ছিল। আর একটা কথা, ‘আমি জানি এই পৃথিবী আরও ভালো হতো যদি আমরা নিজেদের মধ্যে তুলনাটা কম করে প্রশংসা করতাম। তাই আমি এখন তোমাকে বলতে চাই, তোমার তুলনা নেই।’

সাও পাওলোয় পেলে ও ম্যারাডোনার দেয়ালচিত্র

ম্যারাডোনা শুনতে পাচ্ছেন, আপনার প্রতি অকৃত্রিম টান না থাকলে সৃষ্টিকর্তা সবকিছু এভাবে মিলিয়ে দিতেন না। পেলে তো সৃষ্টিকর্তার ওপর কখনো বিশ্বাস হারাননি। তাঁর ডাকেই সাড়া দিয়েছেন।

ওখানে আপনি নিশ্চয়ই তাঁকে বুকে টেনে নেবেন—যেখানে পৃথিবীর কেউ কখনো আপনাদের বিরক্ত করতে পারবে না। রক্তমাংসের মানুষের তুলনার শাঁখের করাতেও আর বিভক্ত হবেন না। দেখা হওয়া মাত্রই বলটা পাস দিয়ে হয়তো বলবেন, বন্ধু কী খবর বলো!