ইউরোপিয়ান ফুটবলে অতি তরুণ খেলোয়াড়দের গুরুত্ব কেন বাড়ছে

এ বছরের এপ্রিলে বেশ আলোড়ন তুলে অভিষেক হয় ১৫ বছর বয়সী লামিনে ইয়ামালের। বার্সেলোনার সবচেয়ে কম বয়সী ফুটবলারও এখন এই তরুণ উইঙ্গার। লা লিগায় রিয়াল বেতিসের বিপক্ষে ম্যাচের ৮৩ মিনিটে গাভির বদলি হিসেবে মাঠে নামার সময় ইয়ামালের বয়স ছিল ১৫ বছর ২৯০ দিন। শুধু কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবেই নয়, মাঠের পারফরম্যান্সেও সবার নজর কেড়েছেন ইয়ামাল। মরোক্কান বংশোদ্ভূত এই কিশোরের অভিষেকের ঠিক ৭ মাস পর গত নভেম্বরে সিরি আ’তে এসি মিলানের জার্সিতে অভিষেক হয় ফ্রান্সিসকো কামারদার।

তাঁর অভিষেক আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, ইয়ামাল একটা ক্লাবের সর্বকনিষ্ঠ তরুণ খেলোয়াড় হলেও কামারাদা কিন্তু একটা লিগের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। অভিষেকের সময় কামারদার বয়স ছিল ১৫ বছর ২৬০ দিন। এ ছাড়া বলা যায় পিএসজির ওয়ারেন জারা–এমেরির কথাও। ২০২২ সালের আগস্টে পিএসজির সবচেয়ে কম বয়সী তারকা হিসেবে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর ৩৩০ দিন।

প্রায় কাছাকাছি সময়ে কৈশোরের বৃত্তে থাকা দুজন ফুটবলারের এমন অভিষেক নিতান্ত কাকতালীয় কোনো ঘটনা নয়। এমনকি এসব স্রেফ ব্যতিক্রমী কোনো উদাহরণও নয়। বরং একটা সমধর্মী প্রক্রিয়া, উদ্দেশ্য ও প্রবণতার ভেতর দিয়েই ফুটবলের মঞ্চে অল্প বয়সে আগমন ঘটেছে তাঁদের। যা ধীরে ধীরে ফুটবলের মূলধারায় পরিণত হতে শুরু করেছে। কিন্তু কোন উদ্দেশ্য কোচ ও ক্লাবগুলোকে এ পথে চালিত করছে? কেন এখনো কৈশোরোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই খেলোয়াড়দের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে পেশাদার ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে?

এটা সবারই জানা যে ফুটবলার তৈরির মূল আঁতুড়ঘর হচ্ছে ক্লাবগুলোর একাডেমি। সারা দুনিয়া থেকে স্কাউটিং করে সম্ভাবনাময় শিশু–কিশোরদের খুঁজে বের করে আনে ক্লাবগুলো। এরপর বয়সভিত্তিক ভাগ করে তাদের তৈরি করা হয়। একটি একাডেমির সবাই যে শেষ পর্যন্ত প্রতিভার চূড়ান্ত স্ফুরণ ঘটাতে পারে, তা কিন্তু নয়। কিন্তু একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে ঠিকই বের হয়ে আসে অনেক উদীয়মান তরুণ মুখ। লিওনেল মেসি, জাভি হার্নান্দেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তারা যে বার্সার নিজস্ব একাডেমি থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তা তো সবারই জানা।

কিন্তু সবাই নিজ নিজ ক্লাবের হয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পারেন না। একটা ক্লাবে তৈরি হওয়ার পর অন্য ক্লাবে গিয়ে নিজেকে মেলে ধরার অসংখ্য উদাহরণ আছে। মূলত একাডেমিতে থাকার সময় যেসব খেলোয়াড়ের খেলার ধরনকে নিজেদের মূল দলের দর্শনের চেয়ে আলাদা মনে হয়, তাঁদের অন্য ক্লাবে বিক্রি করে দেয় ক্লাবগুলো। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন খেলোয়াড়কে আরও পরিণত হতে এবং ম্যাচ টাইমের সুযোগ করে দিতে অন্য ক্লাবে ধারে পাঠানো হয়। এ ছাড়া মাঝারি মানের ক্লাব যেমন বরুসিয়া ডর্টমুন্ড, পোর্তো কিংবা বেনফিকা খেলোয়াড় তৈরিই করে বিক্রির উদ্দেশ্যে। সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের গড়ে বড় ক্লাবগুলোর কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে দেয় তারা।

এই মুহূর্তে আলোচিত তিন তরুণ জারা–এমেরি, লামিনে ইয়ামাল ও ফ্রান্সিসকো কামারদা

আর যেসব ফুটবলারকে ক্লাবগুলো অমিত সম্ভাবনাময় এবং যুগ পরিবর্তনের ক্রীড়নক বলে মনে করে, তাঁদের সরাসরি মাঠেই নামিয়ে দেওয়া হয়। সেই উদীয়মান কিশোরেরা পরবর্তী সময়ে মহাতারকা হিসেবে বেরিয়ে আসেন। এগুলো মূলত ক্লাব ফুটবলের দল গঠন ও পরিচালনার খুবই মৌলিক বিষয়। লম্বা সময় ধরেই ক্লাব ফুটবলে এসব চলে আসছে। কিন্তু এখন এসে যে বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো ক্লাবগুলো ব্যাপকভাবে কিশোর বা কৈশোর পেরোনো খেলোয়াড়দের মাঠে নামাচ্ছে। ফলে কম বয়সে মাঠে নামার ক্লাব ও লিগের রেকর্ডও ভেঙে যাচ্ছে। এই প্রবণতার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেখানে অর্থনৈতিক চাপ কমানো, কোচদের দৃষ্টিভঙ্গি, প্রজন্মের পরিবর্তন, নতুন প্রতিভার স্ফুরণের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ও বিপুল প্রাণশক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে কিশোর কিংবা কৈশোর পেরোনো প্রতিভাবানদের দিকে মুখ ঘোরানোর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত বার্সেলোনা। জাভি হার্নান্দেজ যখন ক্লাবের দায়িত্ব নেন, তখন কাতালান ক্লাবটি রীতিমতো অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম করছিল। অর্থনৈতিক সংকট ও সীমাবদ্ধতা ক্লাবকে খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছিল। ক্লাবের এ বিপর্যয়কেই সম্ভাবনায় বদলে দেওয়ার কাজ শুরু করেন জাভি। আর্থিক চাপ কাটাতে বড় খেলোয়াড় কেনায় লাগাম টেনে দেন বার্সা কিংবদন্তি এবং ‘বার্সা ডিএনএ’ ফেরানোর লক্ষ্য নিয়ে শুরু করেন নিজের কাজ। একের পর এক একাডেমির খেলোয়াড়কে মূল দলে সুযোগ দিতে শুরু করেন, যা জাভিকে দারুণ সাফল্যও এনে দিচ্ছে।

ইয়ামালের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এ ছাড়া অন্যদের মধ্যে কাসাদো ও এলেক্স গারিদোর মতো খেলোয়াড়দেরও খেলাতে শুরু করেছেন জাভি। তাঁদের বাইরে পেদ্রি কিংবা গাভিরাও অল্প বয়সে বার্সার বড় দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছেন। যাঁদের তুলনামূলকভাবে কম দামেই কিনে আনতে পেরেছে বার্সা। ফুটবলভিত্তিক বিশ্লেষণী পোর্টাল অ্যানালিস্টের একটি হিসাবে দেখা গেছে, বার্সা গত মৌসুমে অনূর্ধ্ব–২১ বছর বয়সী খেলোয়াড়দের মাঠে ৮ হাজার ৫৫৫ মিনিট সময় দিয়েছে, যা কিনা ইউরোপের শীর্ষ লিগে লিওঁর (১১ হাজার ১৫৩ মিনিট) পর সর্বোচ্চ। এ ছাড়া গড়ে কম বয়সীদের খেলানোর ক্ষেত্রে শীর্ষ চারে আছে আর্সেনাল। যাদের শুরুর একাদশের গড় বয়স ছিল ২৫ বছর ৫১ দিন। এ তালিকায় আছে ভ্যালেন্সিয়া, লেভারকুসেন ও সাউদাম্পটনের মতো ক্লাবও।

ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলোয় কোচদের মধ্যে এ মুহূর্তে দুই বিপরীত দর্শনে এগোনোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একদিকে পেপ গার্দিওলা, ইয়ুর্গেন ক্লপ কিংবা জাভিরা যেখানে নিজেদের দর্শন বাস্তবায়নে খেলোয়াড়দের গড়ে তোলার পথে হাঁটেন, সেখানে কার্লো আনচেলত্তি, জোসে মরিনিও, মরিসিও পচেত্তিনো বা টেন হাগরা খোঁজেন চটজলদি সাফল্যের টোটকা। ফলে প্রথম দলের কোচরা খেলোয়াড় বাছাইয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণদের বেশি সুযোগ দিচ্ছেন। মূলত অভিজ্ঞতার সঙ্গে তারুণ্যের সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে দল গঠন করে তরুণদের তৈরি করেন তাঁরা।

আলো ছড়াচ্ছেন তরুণ জুড বেলিংহাম

পেপ গার্দিওলা যেমন ১০০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে জ্যাক গ্রিলিশকে কেনার বিলাসিতা দেখান। তিনিই আবার হুলিয়ান আলভারেজ, ফিল ফোডেন বা জেরেমি ডোকোদের মতো অখ্যাতদের মাঠে নামিয়ে চমক উপহার দেন। গত ফেব্রুয়ারিতে তরুণদের বেশি সুযোগ দেওয়া নিয়ে গার্দিওলা বলেছিলেন, ‘এটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। পরিবর্তনের সময় বয়স খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মাতেও কোভাচিচের মতো একজন খেলোয়াড়কে যখন কিনি, তখন আমাদের চেষ্টা করতে হবে অন্যজন যেন তরুণ কেউ হয়। তাদের ক্যারিয়ারও গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেন সুযোগ পেয়ে ফুটবল–দুনিয়ায় নিজেদের সুনাম তৈরি করতে পারে।’

গার্দিওলার মতো তরুণ খেলোয়াড়দের একই কাজ করছেন জাভি ও ক্লপও। দুজনের দলে যেমন উচ্চ মূল্যের তারকা আছে, তেমনি আছেন অনেক তরুণও। এই কোচরা যতটা সম্ভব নিজেদের দর্শনগত জায়গাগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে তাঁদের দলে তরুণেরা সুযোগও বেশি পাচ্ছেন।

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি, নেইমার কিংবা করিম বেনজেমার মতো তারকারা ইউরোপ ছেড়ে গেছেন। এই তারকা ফুটবলারদের বিদায়ে শেষ হয়েছে একটি প্রজন্মও। এর ফলে তৈরি হয়েছে বড় একটি ফাঁকা জায়গা। এরই মধ্যে কিলিয়ান এমবাপ্পে-আর্লিং হলান্ডরা তারুণ্যের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের মেলে ধরেছেন। কিন্তু এই দুটি নামই যথেষ্ট নয়। ফলে প্রতিভাবান অন্য তরুণদেরও সুযোগ দিতে হয়েছে ক্লাবগুলোকে। জুড বেলিংহাম, রদ্রিগো, আলভারেজ, গাভি, জামাল মুসিয়ালা, ফোডেনরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দারুণভাবে জ্বলে উঠেছেন। এ ধারাবাহিকতায় মঞ্চে নিয়ে এসেছে ইয়ামাল-কামারদার মতো অতি তরুণদেরও। তাঁরাই মূলত সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন ফুটবলের নতুন দিনের পতাকাকে।

বার্সেলোনা ফরোয়ার্ড লামিন ইয়ামাল

বলা হয়, আধুনিক ফুটবল হচ্ছে নন্দন থেকে বন্ধনের দিকে যাত্রা। তবে সেই বন্ধন কিছু বাড়তি সুবিধাও দিয়েছে। ফুটবলকে যা একটা কাঠামো ও শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসেছে। যে কারণে অতীতের মতো প্রতিভার ফুলগুলো আর যত্রতত্র নষ্ট হয়ে ঝরে পড়ছে না। তা ছাড়া এখন স্কাউটিংও আগের চেয়ে অনেক বেশি নিয়মতান্ত্রিক ও পরিকল্পনা ধরে সামনে এগোচ্ছে। এমনকি ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে দূর পৃথিবীর প্রতিভাও আর আড়ালে থাকছে না। ফলে যেখানেই সম্ভাবনা দেখছে, ক্লাবগুলো ছুটে যাচ্ছে এবং খেলোয়াড় সংগ্রহ করে নিজেদের ছায়াতলে নিয়ে আসছে। যে কারণে একই সময় প্রচুর তরুণ প্রতিভার স্ফুরণ দেখা যাচ্ছে ফুটবল–দুনিয়ায়। যা সামগ্রিকভাবে ফুটবলে বেশ ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।

আধুনিক ফুটবল হচ্ছে নন্দন থেকে বন্ধনের দিকে যাত্রা। তবে সেই বন্ধন কিছু বাড়তি সুবিধাও দিয়েছে। ফুটবলকে যা একটা কাঠামো ও শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসেছে। যে কারণে অতীতের মতো প্রতিভার ফুলগুলো আর যত্রতত্র নষ্ট হয়ে ঝরে পড়ছে না।

তরুণদের সুযোগ পাওয়ার পেছনে তাঁদের ফিটনেসও বড় ভূমিকা রাখছে। যতই দিন যাচ্ছে, ফুটবল আরও বেশি শরীরী খেলা হয়ে উঠছে। যে কারণে সৃষ্টিশীলতার চেয়ে গতিময়তার গুরুত্বও অনেক বেড়েছে। কোচরাও এখন ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখানোর চেয়ে খেলোয়াড়দের দলগত ভূমিকাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, যা মূলত ফিটনেসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। আর তরুণদের গতি ও প্রাণশক্তি নিঃসন্দেহে অভিজ্ঞদের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকে। তাঁরা যেমন দ্রুতগতিতে প্রতিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়তে পারেন, তেমনি ট্যাকল করার ক্ষেত্রেও তাঁরা বেশি বয়সীদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। গতিময় তরুণেরা প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের কাছ থেকে ফাঁকা জায়গাও বের করতে পারেন অনেক বেশি। এর সঙ্গে যদি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সেই খেলোয়াড় অন্যদের চেয়ে যোজন দূরত্বে এগিয়ে থাকেন।

ওপরের কারণগুলোর সঙ্গে আনা যায় প্রতি তিন দিন অন্তর মাঠের নামার বিষয়টিও। চোট ও ক্লান্তি খেলোয়াড়দের রীতিমতো নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ে। ফলে তরুণ ও অতি তরুণদের প্রস্তুত রাখতে হয় দলগুলোকে। যাঁরা শারীরিকভাবে অন্যদের চেয়ে অধিক চাপ নিতে সক্ষম। কয়েক দিন আগে কামারদার অভিষেকও কিন্তু এসি মিলানের একের পর এক খেলোয়াড়ের চোটে পড়ার কারণেই। তবে সব মিলিয়ে এটা হয়তো অতি তরুণদের অধিক গুরুত্ব পাওয়ার শুরু মাত্র। সামনের দিনে হয়তো এটাই হয়ে উঠবে নিয়মিত চিত্র।