রোনালদোর কান্না অনেক বেশি ব্যক্তিগত। উপেক্ষা আর অপমানের জবাব দিতে না পারার যন্ত্রণা, ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তি ঘোচাতে না পারার দুঃখ।
শেষের দৃশ্যটা তো এখনো আপনার চোখে ভাসছে বলেই অনুমান করি। শুরুটা মনে আছে তো? মনে আছে, কেমন করে বিশ্ব কাঁপিয়ে এই বিশ্বকাপে এসেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো!
পিয়ার্স মরগ্যানকে দেওয়া বিধ্বংসী সেই সাক্ষাৎকার। যেটির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে বিচ্ছেদ। বিশ্বকাপের ডামাডোলেও এত বড় খবর যে বিশ্বজুড়ে তোলপাড়। এরই মধ্যে সাংবাদিকদের চমকে দিয়ে পর্তুগালের বেস ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে হাজির। সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, ঠিক আছে। কিন্তু টাইমিংটা কি ঠিক হলো? তিনি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তাঁর মতো করেই ঘোষণা করলেন, ‘ইন মাই লাইফ দ্য বেস্ট টাইমিং ইজ অলওয়েজ মাই টাইমিং।’
তাঁর নিজের ঠিক করা সময়ই সেরা সময়—তাই বুঝি? তাহলে এর ১৯ দিন পর আল তুমামা স্টেডিয়াম শেষের যে ছবিটা আঁকল, সেটার ব্যাখ্যা কী! শেষ বাঁশি বাজতেই দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ার ওই ছবিটাই তো চিরদিনের জন্য ‘রোনালদোর বিশ্বকাপ’ হয়ে রইল। এরপর কোনো দিকে না তাকিয়ে সটান টানেলের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বলেই মাঠের বদলে ক্যামেরা অনুসরণ করল তাঁকেই। টানেল দিয়ে ড্রেসিংরুমের দিকে হেঁটে যেতে যেতে চোখ মুছছেন রোনালদো। একসময় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বিশ্বকাপ থেকেও।
আগের দিন নেইমারের কান্নাভেজা বিদায় দেখেছে বিশ্বকাপ। সেটিও চোখ ভিজিয়েছে আরও অনেকের। তবে বড় একটা পার্থক্য তো আছেই। নেইমারের ওই কান্নায় যত না ব্যক্তিগত দুঃখ, তার চেয়ে বেশি দলীয় ব্যর্থতার শোক। রোনালদোর কান্নাতেও দলীয় ব্যর্থতা আছে, তবে তা অনেক বেশি ব্যক্তিগত। উপেক্ষা আর অপমানের জবাব দিতে না পারার যন্ত্রণা, ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তি ঘোচাতে না পারার দুঃখ।
ফুটবল থেকে যা পাওয়া সম্ভব, তার সবই পেয়েছেন। শুধু বিশ্বকাপটা ছাড়া। লিওনেল মেসি সম্পর্কে যতবার এ কথা বলা হয়েছে, রোনালদো সম্পর্কে তার এক শ ভাগের এক ভাগও নয়। কারণ, মেসির আর্জেন্টিনা বরাবরই বিশ্বকাপ জয়ের দাবি নিয়ে খেলতে আসে, রোনালদোর পর্তুগাল তা নয়। তারপরও মেসির আগেই মহাদেশীয় শিরোপা জিতেছেন রোনালদো। এই বিশ্বকাপটাও পর্তুগাল জিততে পারে বলে বিশ্বাস ছিল তাঁর। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে যখন এই ঘোষণা দিচ্ছেন, তখন রোনালদো কল্পনাও করেননি, এই বিশ্বকাপ তাঁর এত দিনের চেনা পৃথিবী এমন ওলটপালট করে দেবে।
ক্লাব ফুটবলে প্রথমবারের মতো দলে অপরিহার্যতা হারানোর অভিজ্ঞতা হয়েছে কিছুদিন আগেই। কিন্তু এটা তো পর্তুগাল, এটা তাঁর দল। শুধু তো আর অধিনায়ক নন, দেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরা খেলোয়াড়ও। সেই দলে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তাঁকে তুলে নেবেন কোচ, প্রথম একাদশেই রাখবেন না—এটা মেনে নেওয়া যে কারও জন্যই কঠিন। আর তিনি তো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, অহংবোধই যাঁকে মাদেইরার পর্ণকুটির থেকে তুলে এনেছে রাজপ্রাসাদে। তিনি কীভাবে তা মানেন!
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সবকিছুই যে খবর, তা বোঝাতে ব্রুনো ফার্নান্দেজ এই বিশ্বকাপের আগেই বলছিলেন, মিডিয়ার কাজই হলো যাঁকে নিয়ে মানুষের বেশি আগ্রহ, তাঁকে নিয়েই পড়ে থাকা। তা রোনালদোর চেয়ে বেশি আগ্রহ আর কাকে নিয়ে! ইনস্টাগ্রামে প্রথম মানুষ, যাঁর ৫০ কোটি ফলোয়ার। এই বিশ্বকাপেই দেখুন না! প্রতিটি ম্যাচেই তো সংবাদ শিরোনাম রোনালদো। ম্যাচের আগেও। এক এক করে আসুন:
ঘানার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই রেকর্ড। এর আগে শুধু মার্তাকেই পাঁচ বিশ্বকাপে গোল করতে দেখেছে বিশ্বকাপ, কোনো পুরুষ ফুটবলারকে নয়।
উরুগুয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচেও তো আলোচনায় সেই রোনালদোই। ব্রুনো ফার্নান্দেজের ক্রসে হেড করতে লাফিয়ে গোলের উদ্যাপন। যে গোল আসলে তাঁর নয়।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচে কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের তাঁকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তে প্রকাশ্যেই অসন্তোষ জানিয়ে দেওয়া।
দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ম্যাচ। ফুটবল ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবারের মতো মাঠের চেয়ে বেশি আগ্রহ ডাগআউটে।
বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেওয়ার পরও রোনালদোকে প্রথম একাদশ থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন ফার্নান্দো সান্তোস।
সিদ্ধান্তটা যে শৃঙ্খলাজনিত কারণে নয়, কৌশলগত কারণে, এটা তো বলেছেন আগেই। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার ম্যাচে কোচের সিদ্ধান্তে ওভাবে অসন্তোষ না জানালে সান্তোস রোনালদোকে বাদ দেওয়ার ‘সাহস’ করতেন কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন জাগেই। সান্তোসের কাজটা আসলে সহজ করে দিয়েছেন রোনালদোই।
রোনালদোর বোন আবেগের কথা বলেছেন। রোনালদো–ভক্তদের মনেও যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি কাজ করবে স্বাভাবিক। তবে নিষ্ঠুর সত্যি তো এটাই যে এই বিশ্বকাপের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো এত দিনের চেনা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ছায়ামাত্র। এই বিশ্বকাপে এসেছিলেন পুরোনো দিন ফিরিয়ে আনতে। দারুণ পারফরম্যান্স করবেন, আবার তাঁকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যাবে। আবার চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলতে পারেন, এমন একটা ক্লাব বেছে নেবেন।
সেই বিশ্বকাপই যে রোনালদোকে এমন রাজ্যপাট হারানো এক রাজা বানিয়ে দেবে, কে জানত!