‘গ্যালাকটিকোস’ শব্দটির শাব্দিক অর্থ তারকাপুঞ্জ। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদের গ্যালাটিকোস মানেই যেন ‘তারকাপতন’! রিয়ালের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করলে এই ভাবনা একেবারে অবান্তরও নয়। রিয়াল যখনই গ্যালাকটিকোসের ধারণাকে বাস্তবায়ন করতে গেছে, তখনই পরিণতি হয়েছে হতাশাজনক।
বিশ্বসেরা এই তারকারা বাস্তবের মাঠকে তখন আর সত্যিকারের নন্দনকানন বানাতে পারেন না। তাঁদের সাফল্যের ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর ‘আইডিয়াল স্টেট’ বা ‘আদর্শ রাষ্ট্র’–তে। তারকার হাট বসিয়ে সবকিছু জিতে নেওয়া যাবে—রিয়ালের কল্পনার জগতের এই ভাবনা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর মানুষের সামনে আর ধরা দেয় না!
ইতিহাস ঘেঁটে একবিংশ শতাব্দীতে রিয়ালে তিনটি গ্যালাকটিকোস–যুগের সন্ধান পাওয়া যায়। যার দুটিকে ব্যর্থ–যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং তৃতীয়টি মাত্রই শুরু হয়েছে। ২০০২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল গ্যালাকটিকোসের প্রথম যুগ। সে সময় লুইস ফিগো, ডেভিড বেকহাম, জিনেদিন জিদান, রোনালদো নাজারিও, মাইকেল ওয়েন, রবিনিওর মতো তারকার পদচারণে রিয়াল পরিণত হয়েছিল ফুটবলের স্বর্গরাজ্যে। সেই তারকাপুঞ্জেরও সাফল্য প্রত্যাশার তুলনায় খুবই নগণ্য।
এ সময়টাতে মাত্র একটি লা লিগা জিতেছে রিয়াল। ২০০২ সালে যে চ্যাম্পিয়নস লিগটি জিতেছিল, সেটা মূলত গ্যালাকটিকোস–যুগ শুরুর আগে। রোনালদো নাজারিও ও ডেভিড বেকহামের কপালে জোটেনি ইউরোপিয়ান শ্রেষ্ঠত্বের সেই মুকুট। তাঁরা রিয়ালে গিয়েছিলেন সেই ট্রফি জেতার পর। আর এ দুজন বার্নাব্যুর ক্লাবটিতে নাম লেখানোর পরই মূলত রিয়ালকে গ্যালাকটিকোস বলতে শুরু করেন ফুটবলপ্রেমীরা।
রিয়ালে দ্বিতীয় গ্যালাকটিকোস-যুগ শুরু হয় ২০০৯ সালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আসার পর। যেখানে রোনালদোর সঙ্গে শুরুতে ছিলেন কাকা, আনহেল দি মারিয়া ও মেসুত ওজিলের মতো তারকারা। কিন্তু একটি লা লিগা ছাড়া কিছুই জোটেনি কাকা ও ওজিলের ভাগ্যে। এ দুজনের বিদায়ের পর দি মারিয়া একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ও একটি লা লিগা জিতেছেন। এবার তৃতীয় গ্যালাকটিকোস–যুগের শুরুটাও ইতিবাচক বার্তা দিতে পারছে না। বরং তিন মাস না যেতেই অনেকে আরেকটি ব্যর্থ–গ্যালাকটিকোসের হিসাবও শুরু করেছে।
ভিনিসিয়ুস জুনিয়র, জুড বেলিংহাম, রদ্রিগো ও কিলিয়ান এমবাপ্পেকে নিয়ে গড়া নতুন গ্যালাকটিকোসকে নিয়ে এখনই রায় দিয়ে দেওয়া অন্যায্য হবে। তবে মৌসুমের এক–তৃতীয়াংশ পার হওয়ার পর খানিকটা মূল্যায়ন তো করাই যায়। সেই মূল্যায়নে রিয়ালের নতুন এই তারকাপুঞ্জকে পাস নম্বর দেওয়াটা কঠিনই বটে। বিশেষ করে গত দুই সপ্তাহের পারফরম্যান্স একেবারেই ভুলে যাওয়ার মতো। লা লিগায় এল ক্লাসিকোতে বার্সেলোনার কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার পর চ্যাম্পিয়নস লিগে ধরাশায়ী হয়েছে এসি মিলানের কাছে। আর রিয়ালের পারফরম্যান্সের এমন আশ্চর্যপতনের কেন্দ্রে যে দুটি মানুষ বিশেষভাবে সমালোচিত হচ্ছেন, তাঁরা কিলিয়ান এমবাপ্পে ও কার্লো আনচেলত্তি।
রিয়াল লা লিগায় এল ক্লাসিকোতে বার্সেলোনার কাছে বিধ্বস্ত হওয়ার পর চ্যাম্পিয়নস লিগে ধরাশায়ী হয়েছে এসি মিলানের কাছে।
শুরুতে এমবাপ্পেকে নিয়ে বলা যাক। রিয়ালের হয়ে খেলা ছিল এমবাপ্পের শৈশব–স্বপ্ন। কয়েক বছরের নাটকীয়তার যে স্বপ্ন পরিণতি পেয়েছে গ্রীষ্মের দলবদলে। স্বপ্ন পূরণ করে অবশেষে রিয়ালে এসেছেন এই ফরাসি তারকা। রিয়ালকে ঘিরে এমবাপ্পের যেমন অনেক স্বপ্ন আছে, তেমনি সান্তিয়াগো বার্নাব্যুরও তাঁকে নিয়ে অনেক আশা। প্রত্যাশার পারদটা তাই উঁচুতেই ছিল। কিন্তু এখনো সে প্রত্যাশার কাছাকাছি ঘেঁষতে পারেননি বিশ্বকাপজয়ী এই ফরোয়ার্ড।
এমনকি স্পেনে ব্যর্থতার দায় এমবাপ্পেকে শোধ করতে হচ্ছে ফ্রান্সেও। ছন্দহীনতার কারণে বাদ পড়েছেন জাতীয় দল থেকে। যদিও তাঁকে দলে না রাখার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে চোট থেকে পুরোপুরি সেরে না ওঠার কথা। অথচ সেই একই ফিটনেস নিয়ে তো রিয়ালের হয়ে ঠিকই খেলে যাচ্ছেন। তাই ফ্রান্স দলে এমবাপ্পের না থাকাটা খানিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণই বলা যায়।
এমবাপ্পের বাদ পড়ার অবশ্য আরেকটি কারণ হতে পারে গত মাসের আন্তর্জাতিক বিরতিতে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়া। সেবার বলা হয়েছিল, এমবাপ্পে এখন আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলো বেছে বেছে খেলতে চান এবং রিয়ালের হয়ে খেলাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ, ২০২৫ সালের ব্যালন ডি’অরকে পাখির চোখ করেছেন তিনি। এমবাপ্পের এই ভাবনাকে হয়তো ভালোভাবে নিতে পারেননি ফ্রান্স কোচ দিদিয়ের দেশম।
ফলস্বরূপ এ মাসের আন্তর্জাতিক বিরতির স্কোয়াড থেকেও বাদ পড়তে হলো তাঁকে। অনেকে অবশ্য এর সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনায় তাঁর নাম জড়ানোকেও কারণ হিসেবে দেখছেন। তবে কারণ যা–ই হোক, এমবাপ্পের জন্য এই বার্তা মোটেই ভালো কিছু নয়। বিশেষ করে রিয়ালের জার্সিতে তাঁর পারফরম্যান্স যেখানে খুবই সমালোচনার মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর পারফরম্যান্সকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে ‘উদ্বেগজনক’, ‘হাস্যকর’ এবং ‘নিম্নমানের’ শিরোনাম দিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থা কেন?
সাম্প্রতিক সময়ে এমবাপ্পের পারফরম্যান্সকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে ‘উদ্বেগজনক’, ‘হাস্যকর’ এবং ‘নিম্নমানের’ শিরোনাম দিয়ে।
রিয়ালে এমবাপ্পের শুরুটা হওয়ার কথা ছিল রাজসিক। রিয়ালে তিনি সঙ্গী হিসেবেও পেয়েছেন এই মুহূর্তে বিশ্বসেরা তারকাদের। ভিনিসিয়ুস, বেলিংহাম ও রদ্রিগোকে নিয়ে গড়া আক্রমণভাগে তাঁর হওয়ার কথা ছিল ‘চেরি অন দ্য কেক’। কিন্তু সেটি না হয়ে উল্টো এমবাপ্পে এখন যেন ‘বোঝা’য় পরিণত হয়েছেন! অথচ এমবাপ্পেকে ছাড়াই গত মৌসুমে অপ্রতিরোধ্য এক দল তৈরি করেছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। যারা লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ দুটোই জিতেছিল। সে বিবেচনায় এবার তো এমবাপ্পেকে নিয়ে আরও দুর্দান্ত কিছু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দলটিতে এখন ‘অধিক সন্ন্যাসীতে গাঁজন নষ্ট’ অবস্থা।
দলের সেরাটা কোনোভাবেই বের করে আনতে পারছেন না ইতালিয়ান কোচ।
এমনকি কৌশলজনিত ‘ব্রেন ফেড’ অবস্থায়ও পড়তে দেখা গেছে দলটিকে। নয়তো এল ক্লাসিকোতে একই ভুল বারবার করে ১২ বার অফসাইডের ফাঁদে পা দেবে কেন? যার মধ্যে আটবারই অফসাইডে পড়া খেলোয়াড়টির নাম এমবাপ্পে। অথচ এমবাপ্পেকেই এ সময়ের সবচেয়ে আগ্রাসী ও বৈচিত্রম্যয় ফুটবলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যাঁর সঙ্গে ফুটবল নামের গোলক বস্তুটির অদ্ভুত এক সম্পর্কও আছে।
বলা হয়, বলটিকে নিয়ে তিনি এমন কিছু করতে পারেন, যা করার জন্য তাঁকে মোটেই কষ্ট করতে হয় না। সেই ক্ষুরধার এমবাপ্পেকে রিয়ালের জার্সিতে এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে এমবাপ্পে যে এখন তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে সময় পার করছেন, সেটা বলাই যায়।
এমবাপ্পের বাজে সময়ের প্রতিচ্ছবিই আবার আনচেলত্তির বর্তমান অবস্থা। দলীয় সমন্বয়ে এমবাপ্পেকে ঠিকঠাক ব্যবহার করতে না পারার খেসারত দিতে হচ্ছে তাঁকেও। একের পর এক ব্যর্থতায় আনচেলত্তি যেন চিরচেনা জাদুর বাক্সটি কোথাও হারিয়ে ফেলেছেন। এমনকি মাঝ মৌসুমেই নাকি সদ্য ব্যালন ডি’অর জেতা এই কোচকে বদলানোর কথা ভাবছে রিয়াল। এমন খবর আনচেলত্তি, রিয়াল কিংবা এমবাপ্পের জন্য মোটেই সুখকর নয়।
এদিকে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মুন্দো দেপোর্তিভো জানিয়েছে, এমবাপ্পেও নাকি আনচেলত্তির কোচিংয়ের ধরন নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমটি লিখেছে, যে কৌশলে আনচেলত্তি রিয়ালকে খেলাচ্ছেন, সেটা পছন্দ হচ্ছে না এমবাপ্পের। তাঁর ধারণা, এমন কৌশলের কারণেই নিজের সেরাটা দিতে পারছেন না তিনি। শুরুতেই কোচকে নিয়ে এমন মনোভাব রিয়ালের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। যেখানে এরই মধ্যে লা লিগায় শীর্ষে থাকা বার্সার চেয়ে এক ম্যাচ কম খেলে ৯ পয়েন্টে পিছিয়ে আছে তারা। আর চ্যাম্পিয়নস লিগে অবস্থা আরও শোচনীয়। চার ম্যাচ শেষে রিয়ালের অবস্থান ১৮ নম্বরে।
এ অবস্থায় পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে শিরোপা লড়াই থেকে ছিটকে যাবে রিয়াল। তাই যা করার দ্রুতই করতে হবে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অবশ্য রিয়াল কর্তৃপক্ষও বুঝতে পেরেছে। ফলে জানুয়ারিতে খেলোয়াড় না কেনার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে তারা। বিশেষ করে রক্ষণভাগকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা চলছে। যেখানে লিভারপুলের ট্রেন্ট আলেকজান্ডার–আরনল্ডসহ বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে পাখির চোখ করেছে ক্লাবটি। তবে দলবদলের দুয়ার খোলার আগেই আপৎকালীন সমাধান খুঁজে বের করতে হবে আনচেলত্তিকে। নয়তো পরিত্রাণের পথ খোঁজার আগেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে উত্তরণের দ্বার। তেমন কিছু হলে সেটি শেষ পর্যন্ত রিয়াল, এমবাপ্পে ও আনচেলত্তির জন্য বিয়োগান্ত এক ঘটনাও হয়ে যেতে পারে!