‘হ্যালো, গণেশ থাপা?’
ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে সাড়া এল। বাংলাদেশি সাংবাদিক পরিচয় দিতেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন গণেশ। বাংলাদেশ যে তাঁর কাছে ভীষণ আপন। আশির দশকে প্রায় ১০ বছর বিভিন্ন মেয়াদে বাংলাদেশের চারটি ক্লাবে দাপিয়ে ফুটবল খেলেছেন। গণেশ সেই সব দিন ভোলেননি। মাঠ আর মাঠের বাইরে অনেক স্মৃতি আজও বয়ে চলেছেন নেপাল ফুটবলের এই কিংবদন্তি।
১৯৭৯-৮৯ পর্যন্ত নেপালের হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলেছেন। খেলেছেন কলকাতা ইস্ট বেঙ্গলেও। ১৯৯৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গণেশ থাপা ছিলেন অল নেপাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতিও। তাঁর হাত ধরেই বদলে গিয়েছিল নেপালের ফুটবল।
কাঠমান্ডু থেকে ১১৩ কিলোমিটার দূরের শহর হাতাউদাতে তাঁর বাস। ফোনে সেখান থেকেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে ফিরে গেলেন অতীতে। তবে শুরুতেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে নির্বাচনের খবর কী? কাজী সাহেব (সালাউদ্দিন) কেন নির্বাচন করছেন না ইত্যাদি। কায়সার (হামিদ) লড়ছেন না কেন নির্বাচনে? ‘ব্রাদার্সের বাবলু ভাই’ কেমন আছেন? তিনি কি প্রার্থী হয়েছেন? নানা কৌতূহল তাঁর।
ঢাকা যাওয়ার আগে আমি বুঝতেই পারিনি লিগ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট। নেপালে তখন লিগ অতটা গুরুত্ব পেত না। তখন নেপালে নকআউট–ভিত্তিক একটা টুর্নামেন্ট ছিল, যেটা দর্শকের মনোযোগ পেত। লিগটা কোনোমতে হতো। লিগ নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল না।গনেশ থাপা
সব কৌতূহল মেটানোর পর জানতে চাইলেন সালাম মুর্শেদী প্রসঙ্গে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক সংসদ সদস্য সালাম গ্রেপ্তার হন ১ অক্টোবর। শুনে গণেশ বলেন, ‘ওহ মাই গড! সে আমার রুমমেট ছিল। সে গ্রেপ্তার হয়েছে জেনে খুবই খারাপ লাগছে। অনেক হাসি–আনন্দে আমাদের সময়গুলো কাটত। একসঙ্গে অনুশীলনে যেতাম। ফিরতাম, খেতাম। আরও কত কী!’
গণেশ ফিরে যান আশির দশকের শুরুতে, ১৯৮১ সালে যখন তিনি মোহামেডানের জার্সিতে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে খেলার স্বাদ নেন প্রথম। শুধু মোহামেডানই নয়, গণেশ একটি টুর্নামেন্টে আবাহনীর জার্সিতেও খেলেছেন। সেটি ১৯৮২ সালে আগা খান গোল্ডকাপে। খেলেছেন ওয়ান্ডারার্স-রহমতগঞ্জেও।
আবাহনীতে সংক্ষিপ্ত সময়ে খেলার স্মৃতিকথা স্মরণে এনে বলেন, ‘সালাউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে খেলেছি। আবাহনীতে যখন খেলি, সালাউদ্দিন ভাই ব্রাদার্সে যাবেন গুঞ্জন ওঠে। শুনেছি, ব্রাদার্স থেকে তিনি টাকা নিয়েছেন। সেটা আসলে গুজব ছিল মনে হয়।’
গণেশ বলে যান, ‘আবাহনী থেকে ১০ নম্বর জার্সি আমাকে দেওয়ার কথা উঠেছিল। মনে আছে, আবাহনীর জার্সিতে এক ম্যাচে ব্রাদার্সের কাছে আমরা দুই গোল খেয়ে হারতে বসেছিলাম। পরে তিন গোল করে ম্যাচটা জিতেছি। কখনো ভুলব না ম্যাচটার কথা। সেটি ছিল সম্ভবত আগা খান গোল্ডকাপে।’
বাংলাদেশে যাওয়ার পরই আমার চোখ খুলে যায়। সেখানে দেখি পেশাদারি ফুটবল (তখন পেশাদার আসলে ছিল না), সমর্থকদের উন্মাদনা। এগুলোকে আমাকে ফুটবল সংস্কৃতি বুঝতে শিখতে সাহায্য করেছে।গনেশ থাপা
গণেশের অনেক স্মৃতি আছে বাংলাদেশ নিয়ে। সেই সময় তাঁর মনে হতো বাংলাদেশ একটা ‘ফুটবল-দেশ’। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘ঢাকা যাওয়ার আগে আমি বুঝতেই পারিনি লিগ হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় টুর্নামেন্ট। নেপালে তখন লিগ অতটা গুরুত্ব পেত না। তখন নেপালে নকআউট–ভিত্তিক একটা টুর্নামেন্ট ছিল, যেটা দর্শকের মনোযোগ পেত। লিগটা কোনোমতে হতো। লিগ নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল না।’
নেপাল ও বাংলাদেশের ফুটবলে তখন অনেক পার্থক্য। সেই পার্থক্য নিয়ে গণেশ থাপা বলে যান, ‘বাংলাদেশের তখন একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে এক বছরের চুক্তি হতো। এটা ছিল আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। নেপালের সেরকম কিছু ছিল না। নেপালের ফুটবল সমর্থকেরা লিগ ম্যাচ দেখত না, দেখত শুধু নকআউট টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশে যাওয়ার পরই আমার চোখ খুলে যায়। সেখানে দেখি পেশাদারি ফুটবল (তখন পেশাদার আসলে ছিল না), সমর্থকদের উন্মাদনা। এগুলোকে আমাকে ফুটবল সংস্কৃতি বুঝতে শিখতে সাহায্য করেছে।’
অল নেপাল ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার পর গণেশ থাপা বাংলাদেশের ফুটবল সংস্কৃতি চালু করেন নেপালেও। বলে যান, ‘সে সময় লিগ-টুর্নামেন্ট চালু করি। খেলোয়াড়দের সঙ্গে এক বছরের চুক্তি চালু করি। এগুলো আমি বাংলাদেশ থেকে শিখেছি। বাংলাদেশকে অনেক ভালোবাসি। অনেকে এখনো আমাকে স্মরণ করে। মোহামমেডান, আবাহনী, ওয়ান্ডারার্স, রহমতগঞ্জকে মনে পড়ে।’
কায়সার হামিদের কথা বলব, কৌতুকপ্রিয় একটা মানুষ। খুবই মজার। কোহিনুরের কথা মনে হচ্ছে। সে সময় একজন খুব শক্তিশালী ডিফেন্ডার ছিল, নামটা ভুলে গেছি। ওই ইউসুফ, ইউসুফ। অনেকের নাম মনে পড়ছে না।বাংলাদেশ নিয়ে স্মৃতিচারণায় গনেশ থাপা
গণেশ বাংলাদেশের ফুটবল–উন্মাদনার কথা তুলে এনে ডুব দেন স্মৃতিতে, ‘সে সময় মোহামেডান ক্লাব ছিল ঢাকা স্টেডিয়ামেই পাশেই। ওয়ান্ডারার্সও তা–ই। ম্যাচের আগে স্টেডিয়ামে যাওয়া খুব কঠিন ছিল। প্রচুর দর্শক রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত ক্লাব থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত। ১৯৮১ সালের কথা, মোহামেডানে তখন খুব ব্যক্তিত্ববান দুজন মানুষ ছিলেন। একজন কোচ গোলাম সারোয়ার টিপু ভাই, অন্যজন হাফিজ (মেজর অব. হাফিজ) ভাই। তাঁরা খুবই ভালো ছিলেন। মোহামেডানের ফুটবল সম্পাদক তখন হেলাল (আনোয়ারুল হক হেলাল) ভাই। মনিরুল হক চৌধুরী ছিলেন।’
বাদল রায়ের সঙ্গে বন্ধনটা অনেক দৃঢ় ছিল গণেশ থাপার। বাদল রায় প্রয়াত হয়েছেন। তাঁকে স্মরণ করে গণেশ বলেন, ‘ঈশ্বর ওর আত্মাকে শান্তি দিন। আবাহনীর গোলাম রব্বানী হেলালও মারা গেছে।’ গণেশ যোগ করেন, ‘কায়সার হামিদের কথা বলব, কৌতুকপ্রিয় একটা মানুষ। খুবই মজার। কোহিনুরের কথা মনে হচ্ছে। সে সময় একজন খুব শক্তিশালী ডিফেন্ডার ছিল, নামটা ভুলে গেছি। ওই ইউসুফ, ইউসুফ। অনেকের নাম মনে পড়ছে না।’
গত রাতে কাঠমান্ডুর এক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন গণেশ। সেখানে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের অতীত নিয়ে স্মৃতিচারণা করলেন। ভিডিও কলে কথা বলেন আবদুল গাফফার, ছাঈদ হাসান কানন, কায়সার হামিদের সঙ্গে। কথায় কথায় জানালেন, এখন আর সক্রিয় নেন ফুটবলে। নাতির সঙ্গে বাড়িতে সময় কাটান বেশি।
২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক একটি সংবাদ সংস্থায় খবর বেরোয়, কাতারের ফুটবল কর্তা মোহাম্মদ বিন হাম্মামের কাছ থেকে অবৈধভাবে এক লাখ ডলার নিয়েছেন থাপা। ২০১৫ সালে দুর্নীতির এক মামলায় ফিফার এথিকস কমিটি তাঁকে ১০ বছর ফুটবলে নিষিদ্ধ করে। সে সময় ব্রিটিশ সংবাদপত্রে খবর বেরোয়, এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি ও ফিফার নির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ বিন হাম্মামের কাছ থেকে গণেশ থাপা ১ লাখ ১৫ হাজার পাউন্ড অবৈধভাবে নিয়েছেন। এসব নিয়ে তীব্র চাপে পড়ে নেপাল ফুটবলের নেতৃত্ব ছাড়তে হয় তাঁকে। এ নিয়ে তাঁর দুঃখ আছে। গনেশের দাবি, তিনি ফুটবল রাজনীতির শিকার।