সমুদ্র শহর মালেতে আজ চোখ রাখবেন বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। বিশ্বকাপ প্রাক্–বাছাইয়ে বাংলাদেশ সময় বিকেল পাঁচটায় মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ–মালদ্বীপ। বাংলাদেশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরা এই ম্যাচকে ‘চলতি বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ’ বলছেন জামাল ভূঁইয়াদের জন্য।
মালদ্বীপের বিপক্ষে ২০২৬ বিশ্বকাপ প্রাক্–বাছাইপর্বের প্রথম রাউন্ডে হোম ও অ্যাওয়ে ভিত্তিতে দুটি ম্যাচ খেলবেন জামাল ভূঁইয়ারা। প্রথম ম্যাচটি আজ। দ্বিতীয়টি ১৭ অক্টোবর ঢাকায়। ঘরের মাঠের চেয়ে প্রতিপক্ষের মাঠে খেলাটা সব সময়ই কঠিন। তবে আজ জয়ই চাইছেন কাবরেরা।
মালদ্বীপ প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য কিছুটা অন্য রকমই। একসময় এই মালদ্বীপের বিপক্ষেই ছিল বাংলাদেশের একচ্ছত্র আধিপত্য। ১৯৮৫ ঢাকা সাফ গেমসে মালদ্বীপের বিপক্ষেই বাংলাদেশ পেয়েছিল ৮–০ গোলের বিশাল জয়। এর আগেও মালদ্বীপকে বড় ব্যবধানে হারায় বাংলাদেশ। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই মালদ্বীপই হয়ে ওঠে পরাক্রমশালী, অন্তত বাংলাদেশের সঙ্গে। মালদ্বীপের মাটিতে কখনোই জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ২০০০ সালে ড্র ছাড়া বাকি তিন ম্যাচেই হার। আজকের ম্যাচটি তাই বাংলাদেশের জন্য বড় পরীক্ষাই। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের মহা গুরুত্বপূর্ণ এ ম্যাচের আগে দুই দলের লড়াইয়ের ইতিহাসে একটু চোখ ফেরালে কেমন হয়!
ইতিহাসের বড় জয়
১৯৮৪ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে মালদ্বীপকে ৫–০ গোলে উড়িয়ে দেয় বাংলাদেশ। সেটি ছিল দুই দলের প্রথম সাক্ষাৎ। পরের বছর দ্বিতীয় ম্যাচেই ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে মালদ্বীপকে বাংলাদেশ উড়িয়ে দেয় ৮–০ গোলে। আন্তর্জাতিক ফুটবলে সেটিই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। সে ম্যাচে দুটি করে গোল করেছিলেন শেখ মোহাম্মদ আসলাম, কায়সার হামিদ ও ওয়াসিম ইকবাল। ইলিয়াস হোসেন ও মামুন বাবু করেন একটি করে গোল।
কায়সার হামিদের পেনাল্টি মিস
১৯৮৫ সাফের পর ৮ বছর আর মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশ কোনো ম্যাচ খেলেনি। তবে এ সময়ের মধ্যে এশিয়ার ক্লাব প্রতিযোগিতাগুলোয় নিয়মিতই মুখোমুখি হয়েছে দুই দেশের শীর্ষ ক্লাবগুলো। মালদ্বীপের সে সময়ের শীর্ষ ক্লাব ভ্যালেন্সিয়া, নিউ রেডিয়েন্ট, ক্লাব লেগুন্স বাংলাদেশের আবাহনী, মোহামেডানের বিপক্ষে জিততে পারেনি কখনো, হেরেছে বড় ব্যবধানে। ১৯৮৫ সালে কলম্বোয় এশিয়ান ক্লাব কাপে ভ্যালেন্সিয়াকে ৮–২ গোলে হারায় আবাহনী।
মোহামেডান ১৯৯০ সালে মালদ্বীপের ক্লাব লেগুন্সকে ঢাকায় উড়িয়ে দেয় ৫–০ গোলে। মোহামেডান ১৯৯৩ সালে ভ্যালেন্সিয়াকে ৮–০ গোলের বন্যায় ভাসায়। ১৯৯৩ সালে ঢাকার ষষ্ঠ সাফ গেমসে মালদ্বীপের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য একটা বড় ধাক্কা। সে ম্যাচে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশকে আটকে দিয়েছিল মালদ্বীপ (০–০)। পেনাল্টি মিস করেছিলেন কায়সার হামিদ। অথচ বাংলাদেশের ফুটবলে পেনাল্টি বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন কায়সার। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়কের সেই পেনাল্টি মিস নিয়ে অনেক আলোচনা–সমালোচনা হয়েছিল।
প্রথম হার যখন পয়া
একসময় সাফ গেমসের ফুটবল ইভেন্টে সোনার পদক জিততে না পারা ছিল বাংলাদেশের ফুটবলের দুঃখ। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১১ বছরে ৬টি সাফ গেমসে ফুটবলে ৪ বার ফাইনালে খেলে একবারও সোনা জিততে পারেনি বাংলাদেশ। এ নিয়ে ছিল অনেক হা–হুতাশ। সেই আক্ষেপের অবসান ঘটে ১৯৯৯ সালের কাঠমান্ডু সাফ গেমসে। নেপালকে ফাইনালে হারিয়ে বাংলাদেশ জেতে সাফ গেমস ফুটবলের সোনা।
কাঠমান্ডু সাফ গেমসে সেবার বাংলাদেশের গ্রুপে ছিল মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা। সোনা জয়ের লক্ষ্য নিয়ে কাঠমান্ডুতে গিয়ে প্রথম গ্রুপ ম্যাচেই মালদ্বীপের কাছে ২–১ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। সেটি ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে মালদ্বীপের প্রথম জয়। কিন্তু সেই হারের পর ভাগ্য খুলেছিল বাংলাদেশের। শেষ গ্রুপ ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে সেমিতে উঠে ভারতকে হারায় বাংলাদেশ। ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে জয়ের কথা তো আগেই বলা হয়েছে।
শেষ মুহূর্তের সেই গোলে জয়
২০০৩ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। ঘরের মাঠের সেই সাফে বাংলাদেশের গ্রুপ সঙ্গী ছিল নেপাল ও মালদ্বীপ। প্রথম ম্যাচে নেপালকে হারানোর পর দ্বিতীয় ম্যাচে মালদ্বীপের সঙ্গে ম্যাচেও বাংলাদেশ জিতেছিল ১–০ গোলে। কিন্তু ঘাম ঝরানো সেই ম্যাচে আরিফ খান জয়ের জয়সূচক গোলটি আসে ম্যাচের যোগ করা সময়ে। আরিফ খানের সেই গোলের উল্লাসের মধ্যেই সে ম্যাচে বেজেছিল শেষ বাঁশি।
ঐতিহাসিক টাইব্রেকার
২০০৩ সালে বাংলাদেশ সাফ জিতেছিল মালদ্বীপকে টাইব্রেকারে হারিয়ে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে গ্যালারিভর্তি দর্শকের সামনে সে ম্যাচে প্রথমে বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েছিল রোকনুজ্জামান কাঞ্চনের গোলে। তবে দ্বিতীয়ার্ধে গ্যালারির দর্শকদের স্তব্ধ করে দিয়ে সমতায় ফিরিয়ে আনে মালদ্বীপ। শঙ্কায় পড়ে যান সবাই। এর আগে কোনো টুর্নামেন্টের ফলনির্ধারণী টাইব্রেকারে যে বাংলাদেশের জয় ছিল মাত্র একটি। ১৯৮৫ সালে ঢাকা সাফের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরেছিলেন আসলাম–কায়সাররা।
১৯৯৫ সালে কলম্বোয় সার্ক গোল্ডকাপ (এখন সাফ ফুটবল) সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষেই টাইব্রেকারের পরীক্ষা উতরাতে পারেননি মোনেম মুন্নারা। টাইব্রেকারের সাফল্য বলতে শুধু ছিল ১৯৯৫ সালে মাদ্রাজ (এখন চেন্নাই) সাফের সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়। তাই ২০০৩ সালের সাফ ফাইনালের টাইব্রেকার ছিল চরম উৎকণ্ঠার। কিন্তু সেই টাইব্রেকারে বাংলাদেশ মালদ্বীপকে হারায় গোলকিপার আমিনুল হকের বীরত্বে।
১৮ বছরের খরা
২০০৩ সাফের গ্রুপ পর্বে আরিফ খানের শেষ মুহূর্তের গোলের সেই জয়ের পর মালদ্বীপকে হারাতে যে বাংলাদেশের ১৮ বছর অপেক্ষা করতে হবে, সেটি কে ভেবেছিল! ফাইনালে টাইব্রেকারে জিতলেও সেটি নিয়মানুযায়ী ড্র হিসেবেই গণ্য। মাঝখানের সময়টা মালদ্বীপ আধিপত্য দেখিয়েছে বাংলাদেশের ওপর। যদিও ২০০৩ সালের পর বাংলাদেশ মালদ্বীপের সঙ্গে পরের ম্যাচটি খেলেছিল ২০১১ সালের দিল্লি সাফে। সেই ম্যাচে বাংলাদেশকে ৩–১ গোলে হারিয়েছিল মালদ্বীপ। ২০১৫ সালে কেরালা সাফেও মালদ্বীপ জিতেছিল ৩–১ গোলে। ২০১৬ সালে মালেতে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলতে গিয়ে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। সেই ম্যাচে মালদ্বীপ বাংলাদেশকে উড়িয়ে দিয়েছিল ৫–০ গোলে।
এরপর ২০২১ সালে মালেতে সাফ ফুটবলে মালদ্বীপের কাছে আবারও ২–১ গোলে হারে বাংলাদেশ। সে সময় মালদ্বীপকে প্রবল প্রতিপক্ষই মনে হতো বাংলাদেশের। টানা চারটি ম্যাচে হারের পর ২০২১ সালেই কলম্বোর চার জাতি টুর্নামেন্টে ১৮ বছরের খরা কাটে বাংলাদেশের। ২–১ গোলে আসে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত জয়। তারপর গত বছর আরেকটি প্রীতি ম্যাচে মালদ্বীপ জয় তুলে নেয় নিজেদের মাঠে। সেই হারের পর গত জুনে মালদ্বীপের বিপক্ষে ২০ বছর পর সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ৩–১ গোলে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। দুই দলের শেষ লড়াইয়ে শেষ হাসি অবশ্য বাংলাদেশের।
সেই হাসি আজ ধরে রাখতে পারবেন তো জামাল ভূঁইয়ারা?