লাতিন আমেরিকার ফুটবলের মুকুট ধরে রাখার লড়াইয়ে আর্জেন্টিনার সামনে কলম্বিয়া।
একটা ফাইনালের সঙ্গে কত রকম গল্পই না জড়িয়ে থাকে।
একটা ফাইনালে সেই গল্প কতভাবেই না শেষ হতে পারে!
মায়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় আগামীকাল ভোরে কোপা আমেরিকার সেই ফাইনালের গল্পটা কি শেষ পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হবে? কলম্বিয়াকে হারিয়ে দিলেই তো উরুগুয়েকে পেছনে ফেলে সবচেয়ে বেশি ১৬টি মহাদেশীয় ট্রফি জেতার রেকর্ডের একক মালিকানা। দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম দল হিসেবে কোপা-বিশ্বকাপ-কোপা—টানা এই তিন ট্রফি জেতার বিরল কীর্তির হাতছানি। দুটি মহাদেশীয় এবং একটি বিশ্বকাপ, টানা এই তিন ট্রফি জেতার যে কীর্তি এখন পর্যন্ত মাত্র একটি দলের—স্পেন।
গল্পটা কলম্বিয়ারও হতে পারে। টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত থেকে যারা নিজেদের রেকর্ডই নতুন করে গড়েছে এই টুর্নামেন্টে। আর্জেন্টিনার কাছে ফাইনালটা নির্ধারিত কিংবা অতিরিক্ত সময়ের মধ্যে না হারলেই সেই রেকর্ডটা ২৯ ম্যাচের হয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রফি না পেলে যে এই সংখ্যাটা আসলে মূল্যহীন। অপরাজিত এই যাত্রাটা রাঙানোর কী দারুণ সুযোগই না পেয়েছে কলম্বিয়া! যে আর্জেন্টিনার কাছে ২০২২–এর ফেব্রুয়ারিতে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে হারের পর থেকে এই অপরাজেয় যাত্রা, সেই আর্জেন্টিনাকে হারিয়েই কোপার ট্রফি জয়ের সুযোগ এবার।
কিংবা গল্পটা হবে আনহেল দি মারিয়ার। আর্জেন্টিনার জার্সিতে ফাইনাল মানেই তো দি মারিয়ার গোল। ২০২১ কোপা, ২০২২ লা ফিনালিসিমা, ওই বছরই কাতার বিশ্বকাপ, আর্জেন্টিনার এই তিনটি শিরোপা-উৎসবই তো দি মারিয়ার গোলে রঙিন। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালটা চোট পেয়ে খেলতে পারেননি, এ নিয়ে কত আক্ষেপ করেছেন, ‘প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’-এ কান্নাভেজা চিঠি লিখে ভক্তদের বলেছিলেন, মাঠে মরে গেলেও সেই ফাইনালটা সেদিন খেলতে চেয়েছিলেন।
পরে একটা বিশ্বকাপ জেতায় সেই আক্ষেপ হয়তো কিছুটা কমেছে। এখন আর অপ্রাপ্তি সম্ভবত কিছু নেই। আগামীকালই যে আর্জেন্টিনার জার্সিতে শেষ ম্যাচটা খেলবেন, সেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন আগেই। আরও একটা গোল, আর্জেন্টিনার আরও একটা শিরোপা-উৎসবে তাঁর এই গল্পটা শেষ হলে কী দারুণই না হবে!
অথবা হয়তো ফাইনালটা হবে হামেস রদ্রিগেজের। বিশ্ব ফুটবলে আগামীর মহাতারকা হওয়ার আভাস দিয়ে যার উত্থান ২০১৪ বিশ্বকাপে। ওই বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট, তারপর ইতিহাসের সবচেয়ে দামি কলম্বিয়ান ফুটবলার হয়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেওয়া, লা লিগা-চ্যাম্পিয়নস লিগ-ক্লাব বিশ্বকাপ জেতার পর কেন যেন হারিয়ে যেতে শুরু করলেন রদ্রিগেজ। জায়গা হারালেন কলম্বিয়া দলে, রিয়াল মাদ্রিদও তাঁকে ছেড়ে দিল। এভারটন, আল রাইয়ান, অলিম্পিয়াকস ঘুরে ঠিকানা এখন সাও পাওলো। এবং বিস্ময়করভাবে এবারের কোপায় অনেক দিন পর সেই চেনা রদ্রিগেজ!
মাত্র একটা গোল করলেও করিয়েছেন ৬টি, যা কোপার ১০৮ বছরের ইতিহাসে এক আসরে সবচেয়ে বেশি গোল করানোর রেকর্ড। কলম্বিয়ান কিংবদন্তি হওয়ার আভাস দিয়ে যে রদ্রিগেজের শুরু, ৩৩ বছর বয়সে এসে দেশের একটা শিরোপা জয়ের নায়ক হওয়ার সুযোগ। পারবেন কি?
গল্পের নায়ক তো হতে পারেন নেস্তর লরেঞ্জোও। আর্জেন্টিনা এই ফাইনালটা জিতলে তাঁর আনন্দে নাচার কথা। ৫৮ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইন ১৯৯০ বিশ্বকাপে ডিয়েগো ম্যারাডোনার সতীর্থ ছিলেন। পরে হোসে পেকারম্যানের সহকারী হয়ে ২০০৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত কোচিং করিয়েছেন আর্জেন্টিনার এই দলের অধিনায়ক লিওনেল মেসিসহ এখনকার কোচ লিওনেল স্কালোনি, সহকারী কোচ রবার্তো আয়ালা ও পাবলো আইমারদের। কলম্বিয়ার ২৮ ম্যাচের অপরাজেয় যাত্রা আর্জেন্টাইন লরেঞ্জোর অধীনেই, দেশটিকে ২৩ বছর পর কোপার দ্বিতীয় ট্রফিটা এনে দেওয়ার স্বপ্নও দেখাচ্ছেন তিনিই। কে জানে, হার্ড রক স্টেডিয়ামে হয়তো লরেঞ্জো হয়ে যাবেন আর্জেন্টিনার ‘বিভীষণ’!
অথবা গল্পটা হবে শুধুই মেসির। ৩৬ বছর অপেক্ষার পর যাঁর হাত ধরে আর্জেন্টিনার আরেকটি বিশ্বকাপ জয়ের অপেক্ষা ফুরিয়েছে, সেই মেসিকে এবারের কোপায় এখন পর্যন্ত ঠিক চেনা রূপে দেখা যায়নি। গোলের অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য খুঁজে পেয়েছেন কানাডার বিপক্ষে সেমিফাইনালে। হয়তো সেটাই ছিল তাঁর চেনারূপে ফেরার এবং কোপার এই গল্পের শেষটা নিজের মতো করে লেখার আভাস।
কে না জানে, গল্পের শেষটা তখনই সবচেয়ে সুন্দর হয়, যখন সেটা মেসি লেখেন।