রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে লুইস মেদিনা কান্তালেহোর অভিযোগটা বেশ গুরুতরই ছিল। স্পেনের ‘টেকনিক্যাল কমিটি অব রেফারিজে’র এই সভাপতি চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দাবি করেছিলেন, পৃথিবীর আর কোনো ক্লাব রিয়ালের মতো করে রেফারিদের ওপর চাপ তৈরি করে না। রিয়ালের প্রতিটি ম্যাচের আগে ক্লাবটির টেলিভিশনে রেফারিদের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের হাইলাইটস প্রচার করা হয়—যুক্তিতে এমনটাও তুলে ধরেছিলেন কান্তালেহো।
কাকতালীয়ভাবে এর ৯ দিন পর সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে অনুষ্ঠিত রিয়াল-আলমেরিয়া ম্যাচে রেফারির কাছ থেকে রিয়ালেরই সুবিধা পাওয়া নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। যে বিতর্ক ম্যাচে হেরে যাওয়া আলমেরিয়া বা রিয়ালের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বার্সেলোনা পর্যন্তই পৌঁছায়নি, ভিএআরে রেফারির কথোপকথন ফাঁস হয়ে যাওয়ার জের ধরে পুলিশি অভিযোগ পর্যন্ত গড়িয়েছে।
ক্লাব, সমর্থক, রেফারি হতে শুরু করে সাধারণ দর্শক—সবার কাছে রেফারির সিদ্ধান্ত যতটা সম্ভব গ্রহণযোগ্য করে তুলতে ফুটবলে ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি বা ভিএআর ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। ফুটবলের আইন ও বিধি প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বোর্ড (আইএফএবি) এটিকে ফুটবল আইনে যুক্ত করে ২০১৮ সালে।
কিন্তু অর্ধযুগের পথচলায় ভিএআরের আওতা ও ব্যবহার বাড়লেও রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক কমেনি। বরং ভিএআর সংযোজনের পর ভুলের সংখ্যা যতটা না কমেছে, তার চেয়ে বেশি এর ভুল ও অসংগতি নিয়ে সমালোচনা বেড়েছে। বেশির ভাগ ঘটনাতেই সমর্থকেরা রেফারিদের বিশ্বাস করেন না, আর কোচ, খেলোয়াড়েরা বুঝতে পারেন না কোন সিদ্ধান্তটা কেন নেওয়া হয়েছে। বার্সেলোনা সভাপতি হোয়ান লাপোর্তা তো বলেই দিয়েছেন, ফুটবলে সমাধান হিসেবে আসা ভিএআর এখন ‘সমস্যা’।
লাপোর্তার মন্তব্যটি এসেছে ২১ জানুয়ারির রিয়াল-আলমেরিয়া ম্যাচের পর। যে ম্যাচে ভিএআরের মাধ্যমে তিনটি সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছিল। এর দুটিতে রিয়াল মাদ্রিদ গোল পেয়েছে, অন্যটিতে আলমেরিয়ার গোল বাতিল হয়েছে। সেদিন রিয়ালের ৩-২ ব্যবধানের জয়টি আলমেরিয়ার কাছ থেকে ‘ছিনতাই’ করে নেওয়া হয়েছে অভিযোগ করেছিলেন দলটির মিডফিল্ডার গঞ্জালো মেরেলো।
পরে রেফারিদের কমিটি এ নিয়ে তদন্ত করে দেখতে পায়, কারণ ছাড়াই ক্ষুব্ধ হয়নি আলমেরিয়া। রিয়াল-আলমেরিয়া ম্যাচের তিনটির দুটি সিদ্ধান্তেই ভিএআর সঠিক ছিল না। পরিস্থিতি আরও বেগতিক হয়ে ওঠে ম্যাচে রেফারি ও ভিএআর কথোপকথনের একটি অডিও ফাঁস হলে। যে অডিওতে রিয়ালের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য পেনাল্টির ঘটনা রেফারি কর্তৃক এড়িয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত আছে। এমন অডিও ফাঁস হয়ে যাওয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের দ্বারস্থ হয় স্পেনের ফুটবল কর্তৃপক্ষ।
ভিএআরের ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়াটা নতুন দিক। তবে ফুটবলে প্রযুক্তির এই ব্যবহার ঘিরে ইউরোপজুড়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা চলছে অনেক ধরেই।
প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো লিগে সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে ভিএআর। যার বেশির ভাগ ভুল বা অসংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্তের কারণে। এর মধ্যে ফুটবলে তোলপাড় ওঠা ঘটনা আছে বেশ কয়েকটি। ২০২৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আর্সেনালের বিপক্ষে ব্রেন্টফোর্ডের ১-১ সমতা আনা গোলটিতে অ্যাসিস্ট করা ক্রিস্টিয়ান নরগার্ড অফসাইডে ছিলেন। ভিএআরে প্রতিটি গোল চেক করার কথা থাকলেও সেদিন তা হয়নি। যা নিয়ে পরে ইংল্যান্ডের পিজিএমওএল (প্রফেশনাল গেম ম্যাচ অফিশিয়ালস লিমিটেড) আর্সেনাল কোচ মিকে আরতেতার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে।
চলতি মৌসুমের শুরুর দিকে লিভারপুল-টটেনহাম ম্যাচে লুইস দিয়াজের গোল বাতিলে যা হয়েছে, তা আরও বেদনাদায়ক। দিয়াজ অনসাইডে থেকে গোল করলেও লাইন্সম্যান অফসাইডের পতাকা তোলেন। কিন্তু ভিএআরের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি ভেবে বসেন মাঠেই গোল দেওয়া হয়েছে, তিনি ভিডিওতে গোল বৈধ দেখে রেফারিকে খেলা চালিয়ে যেতে বলেন। স্রেফ যোগাযোগের অসংগতির কারণে গোল বাতিল হয় দিয়াজের, লিভারপুল ম্যাচ হারে ২-১ ব্যবধানে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে ছোট-মাঝারি আরও অনেক ঘটনা। যা নিয়ে ম্যাচ শেষে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায় কোচ, খেলোয়াড়দের।
মোটের ওপর ভিএআরের কাজ হচ্ছে ম্যাচের যেখানে যে সিদ্ধান্তটি সঠিক, সেটি তুলে ধরা বা স্পষ্ট করা। এ ক্ষেত্রে রেফারি নিজে থেকে ভিএআরের সহায়তা চাইতে পারেন, ভিএআর নিজেও রেফারিকে পরখ করে দেখতে বলতে পারেন। ভিএআর কর্মকাণ্ডের চারটি বিশেষ দিক আছে। প্রথমত, গোল হয়েছে বা হয়নি। এ ক্ষেত্রে দেখা হয় আক্রমণে ওঠা দল কোনো অপরাধ করেছে কি না, বল মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিল কি না, বল গোলপোস্টে প্রবেশ করেছে কি না, হ্যান্ডবল হয়েছে কি না।
দ্বিতীয়ত, পেনাল্টি হয়েছে বা হয়নি। এখানে দেখার আছে ঘটনার স্থান কোথায়, ভুলভাবে পেনাল্টি দেওয়া হয়েছে কি না কিংবা মাঠের রেফারি বৈধ পেনাল্টি প্রদান থেকে বিরত থেকেছেন কি না। তৃতীয়ত, সরাসরি লাল কার্ড হয় বা হয় না। আসলেই নিশ্চিত গোল আটকে দেওয়া হয়েছে কি না, ফাউল গুরুতর কি না, আক্রমণাত্মক আচরণ যেমন কামড়ে দেওয়া, থুতু মারা হয়েছে কি না, মানহানিকর/অপমানজনক/নিপীড়নমূলক ভাষা বা শারীরিক ভঙ্গি করা হয়েছে কি না। আর চতুর্থত, ভুল ব্যক্তিকে লাল বা হলুদ কার্ড দেখানো হয়েছে কি না।
আর এককভাবে দেখলে ভিএআরের কাজ—খেলা অনুসরণ করে যাওয়া। রেফারি কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এড়িয়ে গেছেন কি না, সেটা নিশ্চিত হয়ে তাঁকে বলে দেওয়া। তবে ভিএআর কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না বা দিতে পারে না। মাঠের রেফারির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। রিপ্লেতে দেখা যাওয়া গুরুতর অনেক কিছুই ম্যাচের ধারা বা গতি অনুসারে বড় কিছু নয়, এ ক্ষেত্রে বৈষয়িক দিক প্রাধান্য দিতে রেফারির হাতে চূড়ান্ত ক্ষমতা রাখা হয়েছে। কিন্তু আদতে দেখা যাচ্ছে, তাল মিলিয়ে ভুল হচ্ছে রেফারি, ভিএআর দুই দিক থেকেই।
গ্যালারি বা টিভির সামনে থাকা দর্শকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দর্শক বুঝতে পারেন না ভিএআরে কী চেক করা হচ্ছে, আর কেনই–বা করা হচ্ছে বা করা হচ্ছে না। আবার নাক, আঙুল বা হাতের কনুইয়ের কারণে অফসাইড দেওয়ার কঠোরতা নিয়েও প্রশ্ন অনেকের। আর খেলার গতি নষ্ট হয়ে যাওয়া, রিপ্লেতে কিছু একটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাওয়ার পরও রেফারির সিদ্ধান্তে তার প্রতিফলন না থাকার মতো বিষয়গুলো তো আছেই।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে সর্বশেষ দুই মৌসুমের ভিএআরের ঘটনাগুলো সংরক্ষণ করছে ইএসপিএন। সংবাদমাধ্যমটির হিসাব অনুসারে, ২০২২-২৩ মৌসুমের প্রথম ২০ রাউন্ডে ভিএআর ব্যবহার হয়েছিল ৬১ বার। এর সঙ্গে এমন আরও ১৮টি ঘটনা ছিল, যখন ভিএআর নিজেই রেফারিকে ‘চেক করা দরকার’ জানিয়ে দেওয়ার কথা, কিন্তু সেটি জানাননি। আবার এমন ৭টি ঘটনায় ভিএআর রেফারিকে মনিটরের কাছে পাঠিয়েছে, যেগুলোয় কোনো ভুল ছিল না। চলতি ২০২৩-২৪ মৌসুমেও প্রায় একই ধারা। এবার রেফারিকে ভুলভাবে মনিটরে পাঠানো হয়েছে মাত্র ২ বার। কিন্তু ১৭টি ঘটনা ভিএআর নিজেই রেফারিকে জানাতে পারেনি।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ এ ক্ষেত্রে স্রেফ উদাহরণ। একই ধরনের চিত্র স্পেনের লা লিগা, ইতালির সিরি আ, জার্মানির বুন্দেসলিগা আর ফ্রান্সের লিগ আঁ-তেও। চলতি মাসের শুরুর দিকে ইতালির রেফারি প্রধান জিয়ানলুকা রচ্চি স্বীকার করেন, ৬ জানুয়ারি ভেরোনার বিপক্ষে ইন্টারের ২-১ ব্যবধানের জয়সূচক গোলটি বাতিল করতে ব্যর্থ হয়েছে ভিএআর। একই দিনে ফিওরেন্তিনার বিপক্ষে ভুল অফসাইডে সাসসুয়োলোর গোলও ভুলভাবে বাতিল করা হয়েছে।
মিলানের কাছে ভিএআর-ভোগান্তিতে হারের পর এম্পলি কোচ অরেলিও আন্দ্রেজোলি তো ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ‘এটা ফালতু। প্রতি সন্ধ্যায় আমরা খেলার জায়গায় ভিএআর নিয়ে কথা বলি। আবারও বলছি, এটা ফালতু। এখানে রেফারির ভুল নেই। তারা এই পরিস্থিতিও আগেও সামলেছেন। একটা ঘটনা হাজারভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু ভিএআরে ব্যাপারটা যেভাবে ঘটেছে, তা ভিন্ন হতে পারত। এই খেলার ভবিষ্যৎ বিপন্ন।’
গত মাসে বুন্দেসলিগায় বায়ার লেভারকুসেনের বিপক্ষে একটি পেনাল্টি আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর বরুসিয়া ডর্টমুন্ড কোচ এদিন তারজিচও কথা বলেছেন একই সুরে, ‘প্রতি সপ্তাহে আমরা ভিএআর নিয়ে কথা বলি। আমরা ভুল সিদ্ধান্ত, হ্যান্ডবল, ফাউল—এসব নিয়ে বলি। কিন্তু আসল জিনিসটাই এ ক্ষেত্রে বাদ পড়ে যাচ্ছে, কোনটা পেনাল্টি আর কোনটা পেনাল্টি নয়।’
ফ্রান্সে ভিএআর পরিস্থিতি তো আরও নাজুক। গত ১৮ জানুয়ারি লে’কিপের খবরে বলা হয়, ব্রেস্ত প্রেসিডেন্ট দেনিস লে সেইন্ট লিগ আঁ গভর্নিং বডির কাছে ভিএআর বাদ দিতে চিঠি পাঠিয়েছেন।
টটেনহাম কোচ অ্যাঞ্জে পোস্তেকগলুর মন্তব্য এ ক্ষেত্রে বাস্তবিক, একই সঙ্গে প্রথাগত, ‘আমার মনে হয় ভিএআর নিয়ে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। তারা মনে করে ভিএআর ত্রুটিহীন হবে। কিন্তু কোনো প্রযুক্তি সেটা করতে পারে বলে আমি মনে করি না। কারণ, ফুটবলের অনেক কিছুই কার্যকারণভিত্তিক। এখানে অনেক কিছু ব্যাখ্যাকেন্দ্রিক। সুতরাং ফুটবল এখনো মানুষকেন্দ্রিকই।’
জার্মান ফুটবল লিগের সুপারভাইজরি বোর্ডের চেয়ারম্যান হান্স-ইওয়াখিম ওয়াটজকে অবশ্য ভিএআরের কার্যক্রম পুনর্মূল্যায়নে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন, ‘ভিএআরকে টিকে থাকতে হলে এর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ দরকার। ফুটবলে আবেগের স্ফুরণ থাকে। বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। আমাদের কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।’
পরিবর্তন বা পুনর্মূল্যায়নের ভাবনা আছে লিগ কর্তাদের মধ্যে। ফিফা আর আইএফএবি শুনছে তো?